বিশ্বের সর্বোচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ইউরেনিয়াম সিলেট ও মৌলভীবাজারে

সন্ধানের ৩৯ বছর পরও উত্তোলনের উদ্যোগ নেই

Dibir Haorডেস্ক রিপোর্টঃ সিলেটের জৈন্তাপুর ও মৌলভীবাজারের হারাগাছায় ইউরেনিয়ামের সন্ধান মিললেও তা উত্তোলনে নেওয়া হচ্ছে না কোনো উদ্যোগ। ফলে মাটির নিচে অব্যবহৃতভাবেই পড়ে আছে এ মূল্যবান খণিজ সম্পদ। ইউরেনিয়াম উত্তোলন না করার ব্যাপারে এতোদিন সংশ্লিষ্টদের পক্ষ থেকে আন্তর্জাতিক বিধিনিষেদের কথা বলা হলেও আন্তর্জাতিক পারমানবিক শক্তি সংস্থা বাংলাদেশকে পারমানবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের অনুমতি দেওয়ার পর উঠে যায় সকল বিধিনিষেধ।
বিশেষজ্ঞদের মতে, সিলেটের ইউরেনিয়াম ব্যবহার করে গড়ে ওঠতে পারে পারমানবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। যা দেশের ক্রমবর্ধমান বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। পারমাণবিক চুল্লিতে শক্তি উৎপাদক হিসেবে ইউরেনিয়াম ব্যবহৃত হয়ে থাকে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
গত বুধবার রাজধানীর আগারগাঁওস্থ বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের (বাপশক) সম্মেলন কক্ষে ‘ইউরেনিয়াম সার্চিং অ্যান্ড কোয়ান্টিফিকেশন: এন অ্যাটেম্পট অ্যান্ড সাকসেস’ শীর্ষক এক সেমিনারে বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. এ কে এম ফজলে কিবরিয়া জানান, ‘সিলেট ও মৌলভীবাজার জেলার পাহাড়ি অঞ্চলে মূল্যবান পারমাণবিক জ্বালানি ইউরেনিয়ামের সন্ধান পাওয়া গেছে। এসব অঞ্চলে এই তেজস্ক্রিয় খনিজের ঘনত্বও অনেক বেশি। এখন সরকার এগিয়ে এলেই এই খনিজ থেকে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব।’
ড. কিবরিয়ার এ তথ্যের পর আবার উঠে আসে সিলেট ও মৌলভীবাজারে ইউরেনিয়াম প্রাপ্তির বিষয়টি।
জানা যায়, ১৯৭৫ সালে মৌলভীবাজার জেলার জুড়ি উপজেলার ফুলতলা ও সাগরনাল ইউনিয়নের মধ্যবর্তী হারাগাছা (ষাড়েরগজ) পাহাড়ে সন্ধান মিলে দেশের প্রথম ইউরেনিয়াম খনির। বাংলাদেশ আণবিক শক্তি কমিশনের তৎকালিন জেষ্ঠ্য ভূতত্ত্ববিদ ড. ইউনূসের নেতৃত্বে একটি বিশেষজ্ঞ দল হারাগাছা পাহাড়ে অনুসন্ধান চালিয়ে ইউরেনিয়াম প্রাপ্তির সম্ভবনার ব্যাপারে নিশ্চিত হন। এরপর ওই পাহাড়কে তেজষ্ক্রিয় এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করে কমিশন। কিন্তু বাংলাদেশে ইউরেনিয়াম ব্যবহার ও উত্তোলনের অনুমতি না থাকায় এ প্রকল্পের কাজ ওই পর্যন্তই থেমে যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ১৯৮৫ সালে সিলেটে খনিজ সম্পদ অনুসন্ধান করতে গিয়ে আবারো আলোচনায় আসে হারগাছার ইউরেনিয়াম প্রকল্প। এসময় ওই প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে পুনরায় পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাজ শুরু হয়। সেই সাথে সিলেটের বিভিন্ন স্থানেও ইউরেনিয়াম অনুসন্ধান চালায় আনবিক শক্তি কমিশন। ওই সময় মৌলভীবাজারের বড়লেখার হারাগাছা ও সিলেটের জৈন্তাপুর থেকে সংগৃহিত মাটি পরীক্ষা করে দেখা যায়, প্রতি ১০ লাখ মাটি কণার মধ্যে রয়েছে ৫০০-১৩০০ ইউরেনিয়াম কণা। অর্থাৎ পরীক্ষিত স্থানের মাটিতে ইউরেনিয়াম প্রাপ্তির হার ৫০০-১৩০০ পার্টস পার মিলিয়ন (পিপিএম)।
১৯৯১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর হারাগাছায় ফের শুরু হয় অনুসন্ধান কাজ। ওই সময় হারাগাছা থেকে সংগৃহিত ইউরেনিয়াম আকরিক জাপানের আণবিক শক্তি কমিশনের জ্বালানি বিষয়ক গবেষণাগারে পাঠানো হয়। পরীক্ষায় হারাগাছায় উন্নতমানের ইউরেনিয়াম প্রাপ্তির বিষয়টি শতভাগ নিশ্চিত হয়। পরে ওই এলাকায় কয়েকটি কূপ খনন হলেও আন্তর্জাতিক বিধি নিষেধের কারণে শেষ পর্যন্ত ইউরেনিয়াম উত্তোলনের কাজ শুরু করা সম্ভব হয়নি।
১৯৮৫ সালে অনুসন্ধান চালিয়ে সিলেটের জৈন্তাপুরে ইউরেনিয়ামের সন্ধান পায় পারমানবিক শক্তি কমিশন। অনুসন্ধান কাজে তাদেরকে সহায়াতা করেছিল ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদপ্তর। কিন্তু সীমান্তবর্তী এলাকায় ইউরেনিয়ামের সন্ধান পাওয়া গেলেও আন্তর্জাতিক বিধি-নিষেধে কারণে জৈন্তাপুরে ইউরেনিয়াম খনি নিয়ে গবেষণা বেশি দূর অগ্রসর হয়নি।
এদিকে, জৈন্তাপুরের সীমান্তবর্তী ডিবির হাওর ও কেন্দ্রীর হাওরের ওপারে ইউরেনিয়ামের সন্ধান পায় ভারত। ২০০৯ সালের নভেম্বরে ইউরেনিয়াম করপোরেশন অব ইন্ডিয়া লিমিটেড (ইউসিআইএল) বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী ভারতের মেঘালয় রাজ্যের পশ্চিম খাসিয়া পার্বত্য এলাকায় ইউরেনিয়াম উত্তোলনের উদ্যোগ নেয়। কিন্তু ওইসময় সেদেশের পরিবেশবাদীদের আন্দোলনের মুখে ইউরেনিয়াম উত্তোলনের কাজ বন্ধ রাখে। বাংলাদেশের এই দুই হাওরে ইউরেনিয়াম প্রাপ্তির সম্ভাবনা থাকায় হাওর দুইটি দখলে ভারত বেশ কয়েকবার আগ্রাসি তৎপরতাও চালায় বলে একাধিক সূত্র দাবি করেছে।
মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালের ২৯ নভেম্বর মৌলভীবাজার সফরে গিয়ে এক সমাবেশে তৎকালীন জ্বালানী ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এনামুল হক বলেন, হারাগাছার ইউরেনিয়াম আকরিক নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। আন্তর্জাতিক বিধি নিষেধ না থাকায় এ প্রকল্প থেকে শীঘ্রই ইউরেনিয়াম উত্তোলন কাজ শুরু হবে।
এছাড়া ২০১০ সালের ৩ এপ্রিল সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জে একটি বেসরকারী বিদ্যুৎকেন্দ্র উদ্বোধনে এসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্রমবর্ধমান বিদ্যুৎ চাহিদা পুরণে দেশে পারমানবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের ঘোষণা দেন। তবে সরকারের এমন আশ্বাসের পরও ইউরেনিয়াম উত্তোলনে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয় নি।
২০০৯ সালে এ অনুমতি প্রদানের পর সিলেট অঞ্চল থেকে ইউরেনিয়াম উত্তোলনের সম্ভাবনা দেখা দেয়। বিভিন্ন সময় সরকারের উচ্চমহল থেকে আশ্বাস দেওয়া হলেও অদ্যাবদি ইউরোনিয়াম উত্তোলনের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয় নি।
সর্বশেষ শনিবার (৫ ডিসেম্বর) রাজধানীর বসুন্ধরা কনভেনশন সিটিতে আয়োজিত ‘বাংলাদেশ প্রাথমিক জ্বালানি’ শীর্ষক এক সেমিনারে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এ কে এম ফজলে কিবরিয়া জানান, সিলেট ও মৌলভীবাজারে পাহাড়ি অঞ্চলে আবিস্কৃত ইউরেনিয়াম বিশ্বের সর্বোচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন।
ফজলে কিবরিয়া বলেন, বিশ্বের যেসব খনি থেকে ইউরেনিয়াম সংগ্রহ করা হয়। সেগুলোতে ৩শ’ থেকে এক হাজার পিপিএম ইউরেনিয়াম রয়েছে। আর আমাদের সিলেট ও মৌলভীবাজারে রয়েছে ৫শ’ পিপিএম ইউরেনিয়াম।
তিনি বলেন, কতটুকু এলাকা জুড়ে এই ইউরেনিয়াম রয়েছে, আমরা সেটার সমীক্ষা শুরু করেছি। বাণিজ্যিকভাবে উত্তোলনযোগ্য কিনা সেটাও বিবেচনা করা হচ্ছে।
এ ব্যাপারে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যামিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড পলিমার সায়েন্স বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. আবু ইউসূফ বলেন, মৌলভীবাজারের হারাগাছ ও জৈন্তাপুরে কি পরিমাণ ইউরেনিয়াম মজুদ আছে এবং তা উত্তোলনযোগ্য কি-না এসব বিশেষজ্ঞ দিয়ে দ্রুত যাচাই করা উচিত। উত্তোলনযোগ্য ইউরেনিয়াম পাওয়া গেলে তা অযত্নে ফেলে না রেখে তা উত্তোলন করে কাজে লাগানো উচিত।
ড. আবু ইউসূফ আরো বলেন, ইউরেনিয়াম প্রধানত নিউক্লিয়াস চুল্লিতে তেজস্ক্রিয় পদার্থ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। ইউরেনিয়াম পাওয়া গেলে দেশে নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট নির্মাণ সম্ভব। এছাড়া মূল্যবান ইউরেনিয়ামের বিশাল মজুদ পাওয়া গেলে বিদেশে রফতানি করে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটানো যাবে। জাপান, জার্মান ও যুক্তরাষ্ট্র তাদের নিউক্লিয়ার বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য ইউরেনিয়াম কিনে থাকে বলে জানান তিনি।