কমলগঞ্জে পৃথক ৩টি স্থানে আজ বুধবার অনুষ্টিত হবে ঐতিহ্যবাহী মহারাসলীলা ও মেলা

MONIPURI RAKHAL DANCE PIC- Aবিশ্বজিৎ রায়, কমলগঞ্জ: বর্ণাঢ্য আয়োজন ও কঠোর নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে আগামী ২৫ নভেম্বর বুধবার সিলেট বিভাগের মৌলভীবাজারের সীমান্তবর্তী কমলগঞ্জ উপজেলার মাধবপুর ও আদমপুরে সাড়ম্বরে অনুষ্ঠিত হবে মণিপুরী সম্প্রদায়ের প্রধানতম ধর্মীয় উৎসব মহারাসলীলা। তবে এবার প্রথমবারের মত মীতৈ মণিপুরী সম্প্রদায়ের লোকেরা আদমপুর এলাকায় পৃথক দুটি স্থানে এবার রাসোৎসব করবে। এ উপলক্ষে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। মণিপুরী সম্প্রদায়ের মাঝে বিরাজ করছে ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনা। মণিপুরী সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মীয় উৎসব মহারাসলীলা উপলক্ষে বিভিন্ন কর্মসুচী গ্রহণ করা হয়েছে। রাসোৎসবে জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে লাখো মানুষের ঢল নামবে বলে আয়োজকরা জানান।
কমলগঞ্জ উপজেলার মাধবপুর (শিববাজার) জোড়ামন্ডপ প্রাঙ্গনে মণিপুরী মহারাসলীলা সেবা সংঘের উদ্যোগে বিষ্ণুপ্রিয়া মনিপুরীরা ১৭৩ তম বার্ষিকী এবং আদমপুর ইউনিয়নের তেতইগাঁও সানাঠাকুর মন্ডপ প্রাঙ্গনে রাসোৎসব উদযাপন কমিটির উদ্যোগে মনিপুরী মৈ-তৈ সম্প্রদায়ের লোকজন ৩০ তম মহারাস উৎসব উদযাপন করবে। এছাড়াও এবার আদমপুর তেতইগাঁওস্থ শ্রীমধুমঙ্গল শর্ম্মার মন্ডপে মীতৈ মণিপুরীদের আয়োজনে এবার প্রথমবারের মত রাসোৎসবের আয়োজন করা হয়েছে। রাস উৎসব উপলক্ষে তিনটি স্থানেই বসবে বিরাট মেলা। মণিপুরী সম্প্রদায়ের লোকজনের পাশাপাশি অন্যান্য জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে হাজার হাজার লোকজন মেতে উঠবে আনন্দ উৎসবে। মহারাত্রির আনন্দের পরশ পেতে আসা হাজার হাজার নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোর, কবি-সাহিত্যিক, সাংবাদিক, দেশী-বিদেশী পর্যটক, বরেণ্য জ্ঞাণী-গুণী লোকজনসহ প্রশাসনের উর্দ্ধতন কর্মকর্তাদের পদচারনায় মুখরিত হয়ে উঠবে গোটা উৎসব অঙ্গন। মণিপুরী সম্প্রদায়ের পূণ্যস্থাণ হিসাবে বিবেচিত মাধবপুর ও আদমপুরে রাসোৎসবের জন্য তৈরী সাদাকাগজের নকশায় সজ্জিত মন্ডপগুলো এই একটি রাত্রির জন্য হয়ে উঠবে লাখো মানুষের মিলনতীর্থ। মণিপুরী শিশু নৃত্যশিল্পীদের সুনিপুন নৃত্যাভিনয় রাতভর মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখবে ভক্ত ও দর্শনার্থীদের।
মণিপুরী মহারাসলীলা সেবা সংঘের সভাপতি এ্যাড. চাঁদ মুরারী সিংহ স্বপন ও সাধারণ সম্পাদক নৃপেন্দ্র কুমার সিংহ জানান, কমলগঞ্জ উপজেলার মাধবপুর জোড়া মন্ডপ প্রাঙ্গনে মণিপুরী মহারাসলীলা সেবা সংঘের উদ্যোগে গৌড়িয় বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বী (বিষ্ণুপ্রিয়া) মণিপুরী সম্প্রদায়ের ১৭৩ তম শ্রী শ্রী কৃষ্ণের মহারাসলীলানুসরন উৎসব উপলক্ষে কর্মসূচীর মধ্যে রয়েছে ২৫ নভেম্বর বুধবার সকাল ১১টা থেকে গোধূলীলগ্ন পর্যন্ত রাখাল নৃত্য (গোষ্ঠলীলা), সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা থেকে রাত ৯ টা পর্যন্ত গুণীজন সংবর্ধনা, আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। রাত সাড়ে ৯টা থেকে সাড়ে ১০টা পর্যন্ত নট সংকীর্তন, রাত ১১ টা থেকে পরদিন বৃহষ্পতিবার ঊষালগ্ন পর্যন্ত শ্রী শ্রী কৃষ্ণের মহারাসলীলানুসরণ অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত থাকবেন বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন এমপি। সম্মানিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন সাবেক চিফ হুইপ উপাধ্যক্ষ মো. আব্দুস শহীদ এমপি। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন মৌলভীবাজার জেলা পরিষদ প্রশাসক আজিজুর রহমান, জেলা প্রশাসক মো. কামরুল হাসান, পুলিশ সুপার মোহাম্মদ শাহ জালাল, কমলগঞ্জ উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. রফিকুর রহমান, উপজেলা নির্বাহী অফিসার সফিকুল ইসলাম।
এদিকে মহারাস উদযাপন কমিটি ২০১৫ এর আহবায়ক বীরেন্দ্র সিংহ ও সদস্য সচিব রানাবাবু সিংহ জানান, আদমপুর তেতইগাঁও উন্মুক্ত মঞ্চে মীতৈ মণিপুরী সম্প্রদায়ের রাস উৎসবে কর্মসূচীর মধ্যে রয়েছে বুধবার সকাল ১০ টায় রাখাল নৃত্য, সন্ধ্যা সাড়ে ৫টায় আলোচনা সভা, সন্ধ্যা ৭টায় মণিপুর ভারত ও বাংলাদেশের স্থানীয় শিল্পীবৃন্দ মণিপুরী গানের দল “মৈরিক” এর অংশগ্রহণে মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, রাত ১১টায় নিপাপালা, রাত সাড়ে ১১টায় মহারাসলীলা। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের হুইপ আলহাজ্ব শাহাব উদ্দিন এমপি। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন মৌলভীবাজার-২ আসনের সংসদ সদস্য মো. আব্দুল মতিন, জেলা প্রশাসক মো. কামরুল হাসান, জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বিধায়ক রায় চৌধুরী, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) প্রকাশ কান্তি চৌধুরী, কমলগঞ্জ উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আলহাজ্ব অধ্যাপক মো. রফিকুর রহমান, উপজেলা নির্বাহী অফিসার সফিকুল ইসলাম, আদমপুর ইউপি চেয়ারম্যান সাব্বির আহমদ ভুঁইয়া।
অপরদিকে কমলগঞ্জ উপজেলার আদমপুর তেতইগাঁওস্থ শ্রীমধুমঙ্গল শর্ম্মার মন্ডপে মীতৈ মণিপুরীদের আয়োজনে এবার প্রথমবারের মত রাসোৎসবের আয়োজন করা হয়েছে। মহারাস উৎসব উদযাপন কমিটি ২০১৫ এর আহবায়ক চন্দ্রকীর্তি সিংহ ও সদস্য সচিব ব্রজগোপাল সিংহ জানান, তেতইগাঁও মণিপুরী কালচারাল কমপ্লেক্স প্রাঙ্গনের উন্মুক্ত মঞ্চে ২৫ নভেম্বর বুধবার সকাল ১১টায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণের রাখাল নৃত্য, সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় আলোচনা সভা, রাত ৭টায় মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা, এছাড়া তেতইগাঁওস্থ শ্রীমধুমঙ্গল শর্ম্মার মন্ডপ প্রাঙ্গনে রাত ১০টায় নটকীর্ত্তন অধিবাস, রাত ১১টায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মহারাসলীলা। অনুষ্ঠান উদ্বোধন করবেন জাতীয় সংসদের সাবেক চিফ হুইপ ও মৌলভীবাজার জেলা আওয়ামীলীগ সভাপতি উপাধ্যক্ষ মো. আব্দুস শহীদ এমপি। প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের হুইপ আলহাজ্ব শাহাব উদ্দিন এমপি। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন মৌলভীবাজার-২ আসনের সংসদ সদস্য মো. আব্দুল মতিন, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ এর শ্রীমঙ্গস্থ সেক্টর কমান্ডার কর্ণেল মো. তারিকুল ইসলাম খান পিএসসি, জেলা প্রশাসক মো. কামরুল হাসান, শ্রীমঙ্গলস্থ ৪৬ বর্ডার গার্ড ব্যাটালিয়ানের অধিনায়ক লে: কর্ণেল নাসির উদ্দিন আহমেদ পিএসসি, কমলগঞ্জ উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আলহাজ্ব অধ্যাপক মো. রফিকুর রহমান, উপজেলা নির্বাহী অফিসার সফিকুল ইসলাম, আদমপুর ইউপি চেয়ারম্যান সাব্বির আহমদ ভুঁইয়া।
মণিপুরী সম্প্রদায়ের অপেক্ষাকৃত সংখ্যালঘু মীতৈ ও বিষ্ণুপিয়া মণিপুরীদের আয়োজনে কমলগঞ্জের আদমপুর ও মাধবপুরের রাসোৎসবের জন্যে তৈরী মন্ডপগুলো ঐ একটি রাত্রির জন্যে হয়ে উঠে হাজারো মানুষের মিলন কেন্দ্র। সাদা কাগজের নকশায় সজ্জিত মন্ডপগুলোতে দূর-দূরান্ত থেকে আগত শিশু নৃত্য শিল্পীদের সুনিপুণ অভিনয় যেন মন্ত্র মুগ্ধ করে রাখে দর্শনার্থীদের। রাসোৎসবের দিন যতোই ঘনিয়ে আসছে ততোই রাসোৎসবের আকর্ষণ বাড়ছে, সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে উৎসবে দর্শনার্থীর সমাগম। তুমুল হৈচৈ, আনন্দ উৎসাহ ঢাক-ঢোল, খোল-করতাল আর শঙ্খ ধ্বনীর মধ্য দিয়ে হিন্দু ধর্মের অবতার পুরুষ শ্রী কৃষ্ণ ও তার সখি রাধার লীলাকে ঘিরে এই একটি দিন বছরের আর সব দিন থেকে ভিন্ন আমেজ নিয়ে আসে কমলগঞ্জবাসীর জন জীবনে।
রাসলীলায় মনিপুরী নৃত্য শুধু কমলগঞ্জের নয়, গোটা ভারতীয় উপমহাদেশের তথা সমগ্র বিশ্বের নৃত্য কলার মধ্যে একটি বিশেষ স্থান দখল করে নিয়েছে। ১৯২৬ সালের সিলেটের মাছিমপুরে মনিপুরী মেয়েদের পরিবেষ্টিত রাস নৃত্য উপভোগ করে মুগ্ধ হয়েছিলেন বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। পরে কবিগুরু কমলগঞ্জের নৃত্য শিক্ষক নীলেশ্বর মুখার্জীকে শান্তি নিকেতনে নিয়ে প্রবর্তন করেছিলেন মণিপুরী নৃত্য শিক্ষা। কমলগঞ্জে প্রায় এক মাস আগ থেকেই চলছে রাসোৎসবের প্রস্তুতি। মনিপুরী সম্প্রদায়ের বাড়ি বাড়ি কুমারী কিশোরদের রাস লীলায় অংশগ্রহণ করার জন্যে নৃত্য ও সংগীতের তালিম নেয়ার ধুম পড়ে যায়। এ ক্ষেত্রে তাবৎ বাড়িতে রাসধারী ও রাস লীলার উস্তাদ এনে শিক্ষা দেয়ার রেওয়াজ প্রচলিত। আনুমানিক ৪০/৫০ জন কিংবা ততোধিক সংখ্যার কিশোরী এ রাস লীলায় অংশগ্রহণ করে থাকে।