কানাডার প্রেইরী অঞ্চলে বাংলাদেশের অধিকতর বাণিজ্য ও কারিগরি সহযোগিতার সম্ভাবনা
সদেরা সুজন (সিবিএনএ) কানাডা ।।ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিক্ষা ক্ষেত্রে কানাডার প্রেইরী অঞ্চলের অন্যতম প্রদেশে সাস্কাচুয়ানে বাংলাদেশের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশ-কানাডা দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের বর্তমান পরিমাণ প্রায় ১.৮ বিলিয়ন ডলার, এর মধ্যে ২০১৪ সালে সাস্কাচুয়ান প্রদেশের অংশ ছিলো ৪১০ মিলিয়ন ডলার (যা ২০১৩ সালের চাইতে ২৬ শতাংশ বেশি)। উচ্চশিক্ষা, কারিগরি সহযোগিতা এবং ইমিগ্রেশনের ক্ষেত্রেও সাস্কাচুয়ান হতে পারে বাংলাদেশের অন্যতম অংশীদার। ২০০৭ সালের পর থেকে এ পর্যন্ত কানাডার সাস্কাচুয়ানেই ১৪০০ বাংলাদেশেী দক্ষ পেশাজীবী ইমিগ্রেশন নিয়ে এসেছেন । কেবল ২০১৫ সালেই ১০০ জন বাংলাদেশেী শিক্ষার্থী আন্ডারগ্র্যাড প্রোগ্রামে সাস্কাচুয়ানের বিভিন্ন বিশ্বাবদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে।
বিদ্যমান এ সম্পর্ক বৃদ্ধির বিষয়ে প্রাদেশিক গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীবর্গ এবং সাস্কাচুয়ান লেজিসলেটিভ এ্যাসেম্বলীর স্পীকারের সাথে গত ২৮ ও ২৯শে অক্টোবর বৈঠক করেন কানাডায় নিযুক্ত বাংলাদেশের হাই কমিশনার কামরুল আহসান। গুরুত্বপূর্ণ এ সফরকালে কানাডায় বাংলাদেশের হাই কমিশানার কামরুল আহসান এবং তাঁর সফরসঙ্গী প্রথম সচিব (বাণিজ্যিক) দেওয়ান মাহমুদকে সাস্কাচুয়ান পার্লামেন্টের চলতি অধিবেশনে অানুষ্ঠানিকভাবে পরিচয় করিয়ে দেন সাস্কাচুয়ানের প্রাদেশিক প্রধানমন্ত্রী (প্রিমিয়ার) ব্রাড ওয়াল । উল্লেখ্য ২০১১ সালে প্রিমিয়ার ব্যাড ওয়াল একটি বাণিজ্যিক প্রতিনিধিদল নিয়ে বাংলাদেশে সফর করেন। সে সময়ে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হানিসার সাথে তাঁর সাক্ষাতের বিষয়টি তুলে ধরে প্রিমিয়র ব্যাড ওয়াল বলেন তারঁ সেই সফরের পর থেকে কানাডা-বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে যার অন্যতম অংশীদার সাস্কাচুয়ান প্রভিন্স। এজন্য বাংলাদেশ সরকারকে ধন্যবাদ জানান প্রিমিয়ার ব্যাড ওয়াল এবং বলেন এ বাণিজ্যিক সুসম্পর্ক ভবিষ্যতে আরো জোরদার করার বিষয়ে তাঁর দেশ কানাডার, বিশষতঃ সাস্কাচুয়ানের প্রাদেশিক সরকার সদা সচেষ্ট থাকবে।
সাস্কাচুয়ান লেজিসলেটিভ এ্যাসেম্বলীর স্পিকার ড্যান ডি অটরেমন্ট -এর সাথে বৈঠককালে কমনওয়েলথ পার্লামেন্টারী এ্যাসোসিয়েশন (সিপিএ)’র চেয়ার হিসেবে বাংলাদেশের নির্বাচিত হবার ক্ষেত্রে কানাডার ভূমিকার জন্য কানাডাকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন হাই কমিশনার কামরুল আসহান। তিনি বাংলাদেশ এবং কানাডার পার্লামেন্টের মধ্যে অভিজ্ঞতার বিনিময় ও সংসদীয় কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষনের বিষয়ে গুরুত্ব আরোপ করেন। স্পীকার এ বিষয়ে তাঁর সহযোগিতার আশ্বাস প্রদান করেন।
এরপর সাস্কাচুয়ানের কৃষি মন্ত্রী লাইল স্টুয়ার্টের সাথে বৈঠক করেন বাংলাদেশের হাই কমিশনার। বাংলাদেশের মতো কৃষিপ্রধান দেশে কানাডার সাস্কাচুয়ান থেকে মসুর ও বুটের ডাল, পটাশ সার ইত্যাদি রপ্তানী হচ্ছে উল্লেখ করে কৃষিমন্ত্রী স্টুয়ার্ট বলেন এ সুযোগ ভবিষ্যতে বাড়বে বলে তিনি আশা করেন। বাংলাদেশের হাই কমিশনার বাংলাদেশের কৃষিক্ষেত্রে ইউরিয়া ও ডিএপি সারের এবং খাদ্যপণ্যের বাজারে গমের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে উল্লেখ করে বলেন এ সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে কানাডার অধিকতর অংশগ্রহণের সুযোগ রয়েছে। এ সময় কৃষিমন্ত্রী গত বছরে কানাডার সার সরবরাহকারী কোম্পানীসমূহের জোট ‘ক্যানপোটেক্স’ এর মাধ্যমে পটাশ সার সরবরাহে বাংলাদেশের সাথে সম্পাদিত চুক্তির জন্য বাংলাদেশকে ধন্যবাদ জানান। বাংলাদেশের কৃষি বিভাগে মাঠ পর্যায়ে উন্নত প্রযুক্তির সরবরাহ ও কৃষি বিভাগের কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ প্রদানে কানাডার সহযোগিতা কামনা করেন হাই কমিশনার। উল্লেখ্য, সাস্কাচুয়ান প্রদেশ বছরে প্রায় আট মাস তীব্র শীত ও বরফাচ্ছাদিত থাকা স্বত্ত্বেও পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ সশ্য উৎপাদনকারী অঞ্চল হিসেবে তারা নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছে তারা উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে যা বাংলাদেশের মতো কৃষিপ্রধান দেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। সাস্কাচুয়ানের কৃষিমন্ত্রীকে সুবিধাজনক সময়ে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানান হাই কমিশনার। তিনি এ বিষয়ে ইতিবাচক সাড়া প্রদান করে ভবিষ্যতে বাংলাদেশ সফরের আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
উচ্চশিক্ষা বিষয়ক মন্ত্রী স্কট মো’র সাথে তাঁর পার্লামেন্টে ভবনস্থ কার্যালয়ে বৈঠককালে বাংলাদেশ হতে অধিক হারে কৃষি ও কারিগরি প্রশিক্ষণে ছাত্রবৃত্তি প্রদানের আহ্বান জানানা বাংলাদেশের হাই কমিশনার। তিনি বলেন, বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পসহ বিভিন্ন শিল্প কারখানায় প্রশিক্ষিত সুপারভাইজার তৈরির জন্য কানাডার সাস্কাচুয়ানের সহযোগিতা খুব গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। এ বিষয়ে সাস্কাচুয়ান পলিটেকনিট ইন্সটিটিউটের অভিজ্ঞতার বিবরণ দিয়ে উচ্চশিক্ষামন্ত্রী স্কট মো বলেন, তাঁর দেশ বাংলাদেশের প্রস্তাব গুরুত্বের সাথে বিবেচনায় রাখবে। এ পর্যায়ে বাংলাদেশী শিক্ষার্থী ও গবেষক যাঁরা কানাডার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং কারিগরি ও কমিউনিটি কলেজগুলোতে বিভিন্ন বিষয়ে ভর্তি হতে ইচ্ছুক বা ইতোমধ্যেই ভর্তির প্রক্রিয়াধীন, তাদের ভিসা পাবার ক্ষেত্রে জটিলতার অবসানে কানাডার বিশেষতঃ সাস্কাচুয়ানের সহযোগিতা কামনা করেন বাংলাদেশের হাই কমিশনার। জবাবে মন্ত্রী স্কট মো সর্বাত্মক সহযোগিতার আশ্বাস দিয়ে বলেন, বিষয়টি নিয়ে তিনি অন্যান্য প্রাদেশিক ইমিগ্রেশন বিষয়ক মন্ত্রীবর্গের সাথে যোগাযোগপূর্বক কানাডার ফেডারেল সরকারের ইমিগ্রেশন মন্ত্রীর কাছে তুলে ধরবেন, এবং এ জটিলতার যাতে অবসান হয় সে চেষ্টা করবেন। বাংলাদেশের ছাত্র-ছাত্রী, গবেষক ও শিক্ষকরা যাঁরা এদেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করছেন, তাঁরা সাস্কাচুয়ানসহ সমগ্র কানাডাতেই অত্যন্ত মেধার স্বাক্ষর রাখছেন বলে মন্ত্রী উল্লেখ করেন।
সাস্কাচুয়ানের অর্থনীতি বিষয়ক মন্ত্রী বিল বয়েডের সাথে বৈঠককালে হাই কমিশনার বাংলাদেশের সড়ক যোগাযোগ, বন্দর, রেলওয়ে, মেট্রোরেল ও কয়লাভিত্তিক বিদ্যুত উৎপাদন ইত্যাদি চলমান উন্নয়ন প্রকল্পে কানাডার অংশগ্রহণ ও সহযোগিতার আহ্বান জানান। অর্থমন্ত্রী বিল বয়েড এজন্য ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন এবং বলেন, বাংলাদেশের সাথে বিদ্যমান বাণিজ্যিক সম্পর্ক বৃদ্ধিতে সাস্কাচুয়ান অত্যন্ত আগ্রহী এবং এ বিষয়ে তাঁরা কাজ করে যাবেন।
এরপর বাংলাদেশের হাই কমিশনার সাস্কাচুয়ান ট্রেড এন্ড এক্সেপোর্ট পার্টনারশীপ – STEP এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ক্রিস ডেকারের সাথে বৈঠক করেন। বৈঠককালে বাংলাদেশে ভোজ্যতেল ক্যানোলা ও উন্নতমানের মসুর ডালের চাহিদার উল্লেখ করে এ পণ্য সরবরাহে ‘স্টেপ’ এর অধিকতর উদ্যোগের আহ্বান জানান। ‘স্টেপ’ সিইও ক্রিস ডেকার বাংলাদেশে ক্যানোলা অয়েলের উপর আরোপিত অধিকতর শুল্ক (যা বর্তমানে ৪০ শতাংশ) কমানোর বিষয়ে বাংলাদেশের সহযোগিতা কামনা করেন। বাংলাদেশ হাই কমিশনের প্রথম সচিব (বাণিজ্যিক) এবং STEP এর মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ এশিয়া ও উত্তর আফ্রিকা বিষয়ক পরিচালক মোর্তজা তরফদারও এ বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।
সাস্কাচুয়ান পলিটেকনিক ইন্সটিটিউরেটর প্রেসিডেন্ট ড. ল্যারি রোসিয়া’র সাথে বৈঠক করেন বাংলাদেশের হাই কমিশনার। বৈঠককালে বাংলাদেশে তাঁদের একটি এক্সটারনাল ক্যাম্পাস প্রতিষ্ঠার জন্য আহ্বান জানান তিনি। বাংলাদেশ থেকে অধিকতর ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি, বৃত্তির পরিমাণ বাড়ানো এবং শিল্প-চেম্বারগুলোর সাথে পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে উদ্যোগী হবার আহ্বান জানান তিনি। সাস্কাচুয়ান পলিটেকনিক ইন্সটিটিউরেটর প্রেসিডেন্ট ড. ল্যারি রোসিয়া এ বিষয়গুলো সক্রিয়ভাবে বিবেচনার আশ্বাস দেন । সাস্কাচুয়ান বিদ্যুত উন্নয়ন বোর্ড, ‘সাস্কপাওয়ার’ পরিদর্শনকালে এর ভাইস প্রেসিডেন্ট গাই ব্রুস বাংলাদেশের হাই কমিশনােরের জন্য একটি বিশদ উপস্থাপনায় সেদেশে কার্বন ক্যাপচার সিকুয়েস্ট্রেশন (CCS) প্রযুক্তির মাধ্যমে পরিবেশবান্ধব বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং নিঃসৃত কার্বন সংরক্ষণ করে তেল উৎপাদনের কাজে ব্যবহারের ব্যয়বহুল প্রকল্পের বিস্তারিত তুলে ধরেন । এ বিষয় বাংলাদেশের সাথে ভবিষ্যতে সহযোগিতার আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।
সফরের শেষ দিনে কানাডার গর্ব হিসেবে পরিচিত রয়েল কানাডিয়ান মাউন্টেড পুলিশ – আরসিএমপি’র হেরিটেজ সেন্টার পরিদর্শন ও সার্জেন্ট’স প্যারেড প্রত্যক্ষণ করেন বাংলাদেশের হাই কমিশনার। বৈঠকসমূহে ও পরিদর্শনকালে বাংলাদেশ দূতাবাসের প্রথম সচিব (বাণিজ্যিক) দেওয়ান মাহমুদ এবং সাস্কাচুয়ান গভর্ণমেন্টের সিনিয়র প্রটোকল অফিসার মেলিন্ডা কার্টার ও ইন্টারন্যাশনাল ডিপার্টমেন্টের কর্মকর্তা লিসা হার্ডার উপস্থিত ছিলেন।