মৌলভীবাজারে সিলেট বিভাগের ‘রাসলীলা ’ শুরু হচ্ছে ২৫ নভেম্বর ২০১৫
রঞ্জন সিংহ: মণিপুরী ঐতিহ্যবাহী স্বতন্ত্র মুদ্রার তালে তালে দুলছে অঙ্গ ও কিশোরীদের হাত। এ যেনো রাঁধাকৃষ্ণের যুগলবন্দি। বাড়িময় রং বেরংয়ের সাজ। বছর ঘুরে আসছে বাংলাদেশের মণিপুরী সম্প্রদায়ের সর্ববৃহৎ ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক উৎসব মণিপুরী মহারাসলীলা। মণিপুরী মহারাসোৎসব সিলেট বিভাগের অন্যতম প্রধান ও বৃহত্তম লোক-নৃতাত্ত্বিক উৎসব। বিপুল আনন্দ উদ্দীপনার এই দিনটির জন্য শুধু মণিপুরীরাই নয়, স্থানীয় বাঙালীসহ জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে অন্যান্য সকল সম্প্রদায়ের লোকজন বছরব্যাপী প্রতীক্ষায় থাকে। এ বছর মহারাসলীলার ১৭৪ তম বর্ষপুর্তি উৎযাপিত হচ্ছে। ২৫ নভেম্বর, ২০১৫ সিলেটের মৌলবীবাজার জেলার কমলগঞ্জ থানার মাধবপুর জোড়ামন্ডপ এবং আদমপুর সানাঠাকুর মন্ডব হয়ে উঠবে লাখো মানুষের মিলনমেলা। সাদা কাগজ দিয়ে কারুকার্যময় নকশায় সাজানো ম-পগুলোতে দূর-দূরান্ত থেকে জড়ো হওয়া মণিপুরী নৃত্যশিল্পীদের সুনিপুণ নৃত্যগীতি মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখবে দর্শনার্থীদের।
বৈষ্ণব সাহিত্যের রাধা-কৃষ্ণের প্রেমলীলার এক নৃত্যগীতাভিনয় অনুষ্ঠান হচ্ছে রাসলীলা। রাস শব্দটি রস শব্দের বিবর্তিত রূপ বলে অনুমান করা হয়। মণিপুরীদের প্রথম রাসলীলা বা রাসলীলানুসরণ অনুষ্ঠান হয় মণিপুরীদের আদিভূমি মণিপুরে ১৭৬৯ খৃস্টাব্দে রাজা ভাগ্যচন্দ্র সিংহের আয়োজনে। বর্তমান যুগের ভারত ও বঙ্গে যে রাসলীলা কেন্দ্রিক রাস উৎসব হয়ে আসছেতার প্রচারক হচ্ছেন প্রখ্যাত এই মণিপুরী রাজা। গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মমতে মোহবিষ্ট রাজা স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে কন্যা লাইরোবিকে রাধার ভূমিকায় অবতীর্ণ করে রাস অনুষ্ঠানটির আয়োজন করেছিলেন। মৈথিলী ও ব্রজবুলি ভাষার বিভিন্ন পদের মণিপুরী সঙ্গীতের নিজস্ব গায়কী ও মুদ্রা-পদবিক্ষেপে জটিল এবং ধ্রুপদী ধারার এই গীতিনৃত্যধারা মণিপুরীদেরকে ভারতীয় উপমহাদেশের তথা সমগ্র বিশ্বের নৃত্যকলার মধ্যে একটি বিশেষ স্থান করে দিয়েছে।
বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীদের আয়োজনে জোড়া মন্ডপ ও মণিপুরী ললিতকলা একাডেমীর প্রাঙ্গনে ২৫ নভেম্বর বুধবার সকাল ১১ টা থেকে গোধূলী লগ্ন পর্যন্ত গোপরাস (স্থানীয় ভাষায় রাখুয়াল) অনুষ্ঠিত হবে। এই রাস পুরুষদের। শ্রীকৃষ্ণ, সখা বলরাম ও অন্যান্য গোপবালকদের গোষ্ঠে গরু চরাতে গিয়ে সম্মুখীন নানা ঘটনার চিত্র এই রাসে রূপাযড়ত হয়। মণিপুরী শাস্ত্রীয় নৃত্যের বৈষ্ণব ভক্তিভাবাপন্ন নরম কোমল ভাবের বিপরীতে এখানে তান্ডব ধারার নৃত্যই প্রধান। অজা বা গুরু বসেন মৃদঙ্গ নিয়ে। আর মানকসাপি বা যশোদা ও রোহিনী-রূপী নারীদ্বয় মন্ডলীর এককোনে বসে গান ও অভিনয় কর্ম সম্পন্ন করেন। ১২ টি কলাগাছ দিয়ে বেষ্টিত তিনটি পৃথক মঞ্চে শতাধিক তরুন ঐতিহ্যবাহী পোষাকে সজ্জিত হয়ে গোপরাস বা গোষ্ঠলীলায় অংশ নেয়। সন্ধ্যা ৬ টা থেকে রাত ৯ টা পর্যন্ত লোক ঐতিহ্যমুলক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এই সময় দর্শকরা ঘুরে দেখতে পারেন রাস মেলা। রাস উৎসব প্রাঙ্গনেই বসে বিরাট এই গ্রাম্য মেলা। মেলায় অন্যান্য স্টলের পাশাপাশি বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষার বইপত্র ও পত্রপত্রিকার অনেকগুলো স্টল থাকবে। মণিপুরী ভাষার অডিও ভিডিও গানের ক্যাসেট বা সিডির দোকানও থাকবে। তাছাড়া রাসমেলায় মণিপুরী হস্তচালিত তাঁতের কাপড়ের প্রদর্শনী ও বিক্রির ব্যবস্থা রাখা হবে।
এরপর রাত সাড়ে ৯ টা থেকে সাড়ে ১০ পর্যন্ত মণিপুরী নটপালা কীর্তন। রাত ১১ টা থেকে পরদিন ভোর পর্যন্ত চলবে শ্রীশ্রী কৃষ্ণের মহারাসলীলানুসরণ। বাঁশ ও কাগজ কেটে বিশেষ কারুকাজে রাসের মন্ডলী তৈরী করা হয়। মন্ডলীর দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে বসে রাসধারী বা রাসের গুরু, সূত্রধারীগণ এবং বাদকগণ। পাশাপাশি তিনটি মন্ডপে আনুমানিক প্রায় ২০০ জন কিংবা ততোধিক সংখ্যক তরুণী এ রাসলীলায় অংশ নিয়ে থাকে। রাসের সাধারণ ক্রম হচ্ছে- সূত্রধারী কর্তৃক রাগালাপ ও বন্দনা, বৃন্দার কৃষ্ণ আবাহন, কৃষ্ণ অভিসার, রাধা ও সখীদের অভিসার, রাধা ও কৃষ্ণের সাক্ষাৎ ও মান-অভিমান, ভঙ্গীপারেং, রাধার কৃষ্ণ-সমর্পন, যুগলরূপ প্রার্থনা, আরতি ইত্যাদি।
মণিপুরী মৈতৈ সম্প্রদায়ের উদ্যোগে আদমপুর বাজারে সানাঠাকুর মন্ডপ প্রাঙ্গনে রাসলীলা উৎসবে কর্মসূচীর মধ্যে রয়েছে ২৫ নভেম্বর বুধবার সকাল ১১ টায় রাখাল নৃত্য, সন্ধ্যা ৬ টা থেকে ১০টা পর্যন্ত মণিপুরীদের ঐতিহ্যবাহী লোকনৃত্য ওমার্শাল আর্টের শিল্পিত রূপ থাঙ-টা পরিবেশনা। রাত ১১ টায় বরাবরের মতো পালা ও রাত ১২ টায় মহারাসলীলা।