নিজ বাড়িতে ফিরে গেলেন ‘ফজলু মামু’

Fazlu Miahসুরমা টাইমস ডেস্কঃ বিনাদোষে ২২ বছর সিলেট কারাগারে বন্দিজীবন কাটিয়ে জামিনে মুক্ত হওয়ার পর দীর্ঘ ২৮ বছর পর নিজবাড়ি জামালপুরে ফিওে গেলেন ফজলু মিয়া। এর আগে সোমবার সন্ধ্যায় সড়ক পথে রওয়ানা দেন ফজলুর মা মজিরন বেওয়াসহ তার পরিবারের সদস্যরা।

গত শনিবার বিকেলে জামালপুরের এনডিসি জোর্তিময় বড়ুয়া, ফজলুর মা মজিরন বেওয়া, বোন হামিদা বেগম, ভগ্নিপতি মন্টু মিয়া, নানা মৌলভী হাসমত উল­াহসহ পরিবারের সাত সদস্যকে সাথে নিয়ে মাইক্রোবাসযোগে সিলেটের দক্ষিণ সুরমা থানার ধরাধরপুর এসেছিলেন ফজলু মিয়াকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। অবশেষে সোমবার আইনি বিভিন্ন প্রক্রিয়া শেষে ছেলে ফজলু মিয়াকে সাথে নিয়ে বাড়ি ফিরে যান মা মজিরন বেওয়া। দুই দিন সিলেটে অবস্থান করে মঙ্গলবার ভোর রাতে তাকে নিয়ে জামালপুরে পৌছেন পরিবারের সদস্যরা। তবে আগামী ২২ নভেম্বর সিলেট মহানগর হাকিম আদালতে ফজলু মিয়ার হাজিরার ধার্য্য তারিখ রয়েছে।

সোমবার বিকেলে বোন হামিদা বেগম, মামা আবদুল হালিম ও মফিজ উদ্দিনের জিম্মায় ফজলুকে জামালপুর যেতে দেয়া হয় বলে জানান ফজলু মিয়ার জিম্মদার সাবেক ইউপি সদস্য ও ছোট বেলার বন্ধু কামাল উদ্দিন রাসেল।

জামালপুরের জেলা প্রশাসক মো. শাহাবুদ্দিন খান নির্দেশে ফজলু মিয়াকে আমরা তার বাড়ি জামালপুরে নিয়ে যাচ্ছি। তাকে আইনী ও চিকিৎসা সহায়তাও প্রদান করা হবে। আগামি ২২ নভেম্বর আদালতে হাজিরা ধার্য্য তারিখের আগেই তাকে সিলেট নিয়ে আসা হবে বলে পারিবারিক সূত্রে জানাগেছে।

প্রসঙ্গত, ৫৪ ধারায় গ্রেফতার করে দীর্ঘ ২২ বছর কারাগারে বন্দি ছিলেন ফজলু মিয়া। গত ১৫ অক্টোবর তিনি জামিনে মুক্তি পান। কারগারে যাওয়ার ৬ বছর আগে ফজলু মিয়ার বয়স যখন ১০ থেকে ১২ তখন জামালপুরের গ্রামের বাড়ি শাহবাজপুর ইউনিয়নের সাউনিয়া থেকে পালিয়ে এসেছিলেন তিনি। সেই থেকে মায়ের সথে দেখা হয়নি তাঁর।

দীর্ঘ ২৮ বছর পর গণমাধ্যমে ছবি দেখে ফজলু মিয়াকে সনাক্ত করেন তার স্বজনরা। পরে ছেলের সন্ধান পেয়ে গত ২৪ অক্টোবর শনিবার জামালপুর থেকে সিলেট আসেন ফজলু মিয়ার মা মজিরন বেওয়া ও ফজুলর বোনসহ পরিবারের সাত সদস্য। সাথে ছিলেন জামালপুরের এনডিসি জোর্তিময় পাল। জামালপুরের জেলা প্রশাসক মো. শাহাবুদ্দিন খান নিজ খরচে ফজলু মিয়ার পরিবারের ৭ সদস্যদের সিলেট পাঠিয়েছিলেন ।

গত শনিবার সন্ধ্যায় দক্ষিণ সুরমা উপজেলার তেলিবাজারে তেতলী ইউনিয়ন পরিষদ ভবনে দেখা হয় মা-ছেলের। কারামুক্তির পর থেকে সেখানেই বসবাস করে আসছিলেন ফজলু মিয়া। দেখা হওয়ার পর মা-ছেলে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ওঠেন। ফজলু মিয়ার মা বাকপ্রতিবন্ধি। চোখেও দেখেন না। ফজলুও অসুস্থ। তেমন কথা বলতে পারেন না। মানসিকভাবেও অপ্রকৃতস্থ।

এর আগে গত ২৩ অক্টোবর শুক্রবার ফজলু মিয়াকে দেখতে এসেছিলেন তাঁর মামা মফিজ উদ্দিন।

জানা যায়, জামালপুর সদর উপজেলার নারায়ণপুর এলাকার সাউনিয়া বাঁশছড়া এলাকায় ফজুল মিয়ার বাড়ি। ১০ থেকে ১২ বছর বয়সে ফজলু বাড়ি থেকে পালিয়ে ঢাকায় চলে যান। সেখানেই তাঁর সঙ্গে দেখা হয় সিলেটের দক্ষিণ সুরমা উপজেলার ধরাধরপুর গ্রামের সৈয়দ গোলাম মাওলার সঙ্গে। তিনি ফজলুকে তাঁর বাড়ি নিয়ে আসেন।

ফজলু মিয়ার মামা মফিজ উদ্দিন জানান, প্রায় ২৮ বছর আগে ফজলু মিয়া বাড়ি ছেড়ে চলে আসেন। তারপর দীর্ঘদিন ধরে নিখোঁজ ছিলেন। ২০-২১ বছর তাঁর বড় ভাই (ফজলুর বড় মামা) আবদুস সাত্তার ফজলুর খবর নিতে সিলেট আসেন।
তিনি সিলেটের দক্ষিণ সুরমার ধরাধরপুর গ্রামের গোলাম মওলার বাড়ি যান। সেখানে গিয়ে জানতে পারেন গোলাম মওলা ও তাঁর স্ত্রী মারা যাওয়ার পর ফজলু উন্মাদ হয়ে বাড়ি থেকে চলে গেছেন। ফজলুর স্ত্রীও সেখানে নেই। গোলাম মওলার বাড়ির কেউ ফজলু মিয়ার কোনো খবর জানেন না। এর পর থেকে তাঁদের ধারণা ছিল, ফজলু মিয়া হয়তো আর বেঁচে নেই।

মফিজ উদ্দিন বলেন, কিছুদিন আগে টেলিভিশনে ফজলু মিয়াকে দেখে তাঁর ভাতিজা রাজু মিয়া ফোন করে জানান, ফজলু বেঁচে আছেন। এরপর বিভিন্ন পত্রিকায় ফজলু মিয়ার সচিত্র প্রতিবেদন দেখে তাঁরা নিশ্চিত হন, এই ফজলুই তাঁদের হারিয়ে যাওয়া ফজলু। এরপর তাঁরা প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করেন।

জানা যায়, ফজলু মিয়া একসময় গলায় ডালা বেঁধে সিলেট নগরে পান-সিগারেট বিক্রি শুরু করেন। সিলেট শহরের বন্দরবাজার আদালতপাড়ায় তিনি ফেরি করে পান-সিগারেট বিক্রি করতেন। ১৯৯৩ সালের ১১ জুলাই তিনি আদালতপাড়ায় পান-সিগারেট বিক্রি করছিলেন। জাকির হোসেন নামের এক ট্রাফিক সার্জেন্ট সন্দেহজনকভাবে ঘোরাফেরা করার জন্য তাঁকে গ্রেফতার করেন। ৫৪ ধারায় কোতোয়ালি থানায় ফজলু মিয়ার বিরুদ্ধে ডায়েরি করেন সার্জেন্ট জাকির। এরপর পুলিশ প্রতিবেদন দিয়ে ফজলু মিয়ার বিরুদ্ধে পাগল আইনের ১৩ ধারায় অভিযোগ আনে। তাঁকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় কারাগারে। কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ গঠন করা হয়নি। প্রায় ২২ বছর পর গত ১৪ অক্টোবর তিনি মহানগর হাকিম আদালত থেকে জামিন পান। এরপর দিন ১৫ অক্টোবর কারাগার থেকে মুক্তি পান ফজলু।

ফজলু মিয়া তার জন্ম ভূমি জামালপুর যাওয়ার পূর্বে সিলেটের দক্ষিণ সুরমার ধরাধরপুর গ্রামের সৈয়দ গোলাম মাওলার (পালক পিতা) কবর জিয়ারত করেন। ফজলু মামুকে বিদায় দিতে তেতলী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান উসমান আলীসহ তেতলী ইউনিয়নের গণমান্য ব্যাক্তি বর্গ উপস্থিত ছিলেন। এসময় ফজলু মামুর পরিবার সিলেটের সকল গণমাধ্যম ব্যাক্তিদের ধন্যবাদ জানান।