দৃশ্যমান শক্তির চেয়ে অদৃশ্য শক্তি ভয়ঙ্কর
পীর হাবিবুর রহমানঃ দুই-দুই বিদেশির রহস্যজনক মৃত্যু, একজন প্রকৌশলীর রহস্যজনক হত্যাকান্ডে এক অস্থির, অশান্ত ভয় মিলিয়ে দুশ্চিন্তা ও অস্থিরতার ভেতর দিয়ে পার হচ্ছে সময়। শুধু কূটনৈতিক পল্লিতেই বিজেবির টহল বাড়ানো হয়নি, মন্ত্রী-এমপিদেরও নিরাপত্তা জোরদার হয়েছে। সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। কার্যত গোটা দেশেই এখন রেড অ্যালার্ট। শেয়ারবাজারে দরপতন ঘটেছে, পাঁচতারকা হোটেলের কক্ষগুলো ফাঁকা, বিদেশিরা চলে যাচ্ছেন, বিনিয়োগ তুলে নিচ্ছেন। সবাই বলছেন লিখতে। কী লিখব, তা বুঝতে পারি না। কালের পথপরিক্রমায় পোড় খাওয়া দীর্ঘ পেশাদারিত্বের জীবন আমার। প্রথাগত চাকরি না করার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিউজ পোর্টাল পূর্বপশ্চিমবিডি.কমের কাজ নিয়েই ব্যস্ত। তবুও চারপাশের উদ্বেগ, আতঙ্ক, হতাশা সংক্রমিত হয় শরীরে। ভেতরে টান টান অস্থিরতা ও উত্তেজনা অনুভব করি কখনো-সখনো। বিদেশিদের কাছে খবর নিশ্চয়ই আছে অনেক। এমনটিই মনে করেন পর্যবেক্ষকরা। তাই তাদের লোকদের সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। এর আগে অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট দল আসেনি। আমাদের উদীয়মান, বিশ্বনন্দিত ক্রিকেটের জন্য এটি অশনিসংকেত। সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদকবলিত সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র পাকিস্তানে এক সময় ক্রিকেট দল যেত না। সর্বশেষ জিম্বাবুয়ে গেছে। বিশ্বনন্দিত ক্রিকেট দলগুলো সেখানে না যাওয়ায় পাকিস্তানের ক্রিকেট সূর্য এখন অস্তগামী প্রায়। স্বাধীনতা-উত্তরকাল থেকেই বাংলাদেশে জাতীয়-আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র মাথা তুলেছে বারবার। পরিবার-পরিজনসহ বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের মধ্য দিয়ে অনেক জাতীয় বীরের রক্তে লেখা হয়েছে ইতিহাসের আরেক কালো অধ্যায়। অনেক জঙ্গি সংগঠনের আত্মপ্রকাশ যেমন ঘটেছে, তেমনি ধরাও পড়েছে।
যশোর থেকে পল্টন, পল্টন থেকে রমনা হয়ে বঙ্গবন্ধু এভিনিউ বোমা ও গ্রেনেডে রক্ত ঝরেছে অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক শক্তির। প্রকাশ্যে জনসভা থেকে বর্বরোচিত গ্রেনেড হামলায় উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে আজকের প্রধানমন্ত্রীসহ জাতীয় নেতাদের। বোমার আঘাতে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অর্থনীতিবিদ শাহ এএমএস কিবরিয়ার রক্তাক্ত ও নিথর দেহ দেখেছে বিশ্ব। রাতের আঁধারে ধরা পড়েছে ১০ ট্রাক অস্ত্র। জেএমবির আস্ফালন ও বাংলাভাইদের ফাঁসি দেখেছে দুনিয়া। একই সময়ে দেশের পার্শ্বজায়গায় বোমা বিস্ফোরণই নয়, একের পর আদালতপাড়ায় হয়েছে রক্তাক্ত হামলা। একটি শক্তি অদৃশ্য মহাশক্তির ইন্ধনে রক্তস্নাত মুক্তিযুদ্ধের ভেতর দিয়ে জন্ম নেওয়া অসাম্প্রদায়িক-গণতান্ত্রিক বাংলাদেশকে তালেবানি রাষ্ট্র বানানোর চেষ্টা করেছে। নানা ঘটনাপ্রবাহের ভেতর দিয়ে ওই দুঃসময় অতিক্রম করেছে বাংলাদেশ। জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জিরো টলারেন্স প্রসংশিত হয়েছে দুনিয়াজুড়ে। অসংখ্যবার মুজিবকন্যা শেখ হাসিনাকে হত্যার মধ্য দিয়ে ক্ষমতা থেকে উৎখাতের অপচেষ্টা হয়েছে।
পিলখানা হত্যাকান্ড জাতির জীবনে রক্তক্ষরণ ঘটিয়েছে। কালের যাত্রাপথে অনেক কলঙ্কিত ঘটনার রহস্য এখনো উন্মোচিত হয়নি। অনেক ঘটনার বিচারও শেষ হয়নি। একটি অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র চেতনার জায়গা থেকে কখনোই সাম্প্রদায়িকতা, সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গিবাদকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিতে পারে না। কিন্তু নির্মম হলেও সত্য ক্ষমতার প্রাসাদ রাজনীতি, রাজনীতির দাবার চালে ভুল করে হলেও কেউ কেউ ধর্মান্ধ শক্তিকে গণতন্ত্রের কথা বলে কাছে টেনেছেন। সরকার, প্রশাসন, রাজনৈতিক শক্তি ও সিভিল সোসাইটি আর গণমাধ্যম মিলেই জাতীয় ঐক্যের পথে কেবল অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের চেতনা কার্যকর করতে পারে। এক্ষেত্রে উদার গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার যেমন বিকল্প নেই’ তেমনি সংবিধান, আইন, বিধি-বিধান বলে নির্মোহচিত্তে রাষ্ট্র পরিচালনা ছাড়া বিকল্প নেই। গণতন্ত্রের পথ রুদ্ধ হলেই ষড়যন্ত্রের দরজা খোলে, গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধ হলেই সমাজে অস্থিরতা বাড়ে। দুর্নীতি, দলীয়করণ, স্বজনপ্রীতি কখনোই নাগরিকের হৃদয়ে প্রশান্তি দিতে পারে না। সরকারবিরোধী রাজনৈতিক শক্তি যেমন উগ্র হঠকারী রাজনীতির পথ নিয়ে সমর্থকদের হতাশার চোরাবালিতে ডুবিয়েছে, নিজেদের শক্তি ক্ষয় করেছে, মানুষের আস্থার জায়গা থেকে সরেছে- তেমনি সরকার ও তার দলের দায়িত্বশীলদের লাগামহীন কথাবার্তা আর কান্ডজ্ঞানহীন কাজকর্ম জনগণকে আস্থার জায়গা থেকে সরিয়েছে। সরকার ও বিরোধী শক্তি উভয়েরই শক্তির উৎস জনগণ। কিন্তু ওই জায়গা থেকে উভয়েই সরেছে। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় ভ্যাট নিয়ে ছাত্র বিক্ষোভ জানান দিয়েছে অসুস্থ ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত না থাকলেও সমাজের মূল শক্তি তারুণ্যের ভেতরে দ্রোহ কাজ করছে। এই ঘটনা শিক্ষামন্ত্রী পর্যায়ের নেতারা বা অর্থমন্ত্রীর জায়গা থেকে দায়িত্বশীলরা সমাধান করতে পারতেন। তাদের ব্যর্থতার পথ ধরে শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীকেই পরিস্থিতি সামাল দিতে হয়েছে। অশান্ত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় সংকট জিইয়ে রাখা হতো। অথচ শেখ হাসিনার শাসনামলে উন্নয়নের চাকা গতিময় হয়েছে।
চ্যালেঞ্জ নিয়ে পদ্মা সেতু প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে। ঢাকা এখন ফ্লাইওভারের নগরীতে পরিণত হচ্ছে। কিন্তু অল্প বৃষ্টিতেই ডুবে যায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহানগরী। জনদুর্ভোগ থেকে নগরবাসীকে মুক্তি দিতে মেয়রদের হাতে পর্যাপ্ত ক্ষমতা নেই। মন্ত্রী-নেতা-উপদেষ্টাদের মধ্যে সমন্বয়হীনতা চরমে। আমার প্রেম ও জলজ্যোৎস্নার শহর সুনামগঞ্জ সফরে গিয়েছিলাম মতিহার ক্যাম্পাসের বন্ধুদের নিয়ে। সিলেটের সুরমা নদীতে কাজীরবাজার সেতু হয়েছে। সিলেট থেকে সুনামগঞ্জ যেতে যেতে দেখলাম ১১টি নতুন সেতুর ভেতর দিয়ে যানবাহন চলছে। জ্যোৎস্না প্লাবিত রাতে গানের জলসায়ই বসিনি, বন্ধুদের নিয়ে বজরায় চড়ে সুরমা ও হাওড় ভ্রমণ করেছি। আমার তারুণ্যে কত রাত যে লালন সাঁইজির গানের আশ্রমে বসেছি, বাউলদের মাটির সন্তান মরমি সাধক হাসন রাজা, রাধারমণ, শাহ আবদুল করিমের গান শুনে হৃদয়কে মানুষের জন্য কোমল করেছি! হাওড়ের বিস্তীর্ণ এই শহরে কবিতা আর গানই নয়, জ্যোৎস্না ও বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে বেড়ে উঠেছি। আমাদের ঝরঝঞ্জাকবলিত রাজনৈতিক সময়ে জন্মেই শুনেছি বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবের নাম। তার কাছ থেকেই আমাদের সমস্ত সাহসের পাঠ। একটি জাতিকে ভিসুভিয়াসের মতো তিনি জ্বালিয়েছিলেন জুলুম-অত্যাচার আর বৈষম্যের বিরুদ্ধে। সেটি দেখতে দেখতে স্রোতের বিপরীতে সাঁতার কাটতে শেখা।
দক্ষিণ আফ্রিকার বিশ্বখ্যাত বর্ণবাদবিরোধী নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা বলেছিলেন, ‘আমি গান্ধীর ভক্ত। কিন্তু নেহরু আমার আইডল।’ নেহরুর পর উপমহাদেশে আমাদের দেখা উদারপন্থী গণতান্ত্রিক রাজনীতিবিদের নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সব ধরনের আদর্শহীনতা, লোভ-লালসার পথ এড়িয়ে ত্যাগের মহিমায় জীবন-যৌবন উৎসর্গ করা সংগ্রামের ভেতর দিয়ে তার জনগণকে আস্থায় এনেছিলেন, এক সুতায় বেঁধেছিলেন। ভলতেয়ারের ওই হৃদয়ছোঁয়া উক্তি ‘আমি তোমার মতের সঙ্গে একমত নাও হতে পারি। কিন্তু তোমার মত প্রকাশের স্বাধীনতার জন্য জীবন দিতে পারি।’ একটি গণতান্ত্রিক সমাজের এটিই তার চেতনার মর্মবাণী। দেশে যা ঘটছে তা দৃশ্যমান কোনো শক্তি নয়, অদৃশ্য শক্তি ঘটাচ্ছে। ইতিহাসের পরতে পরতে বিয়োগান্তক সব ঘটনার নেপথ্য কারিগররা দৃশ্যমান শক্তি ছিল না, অদৃশ্য শক্তিই ছিল। দৃশ্যমান শক্তির চেয়ে অদৃশ্য শক্তি ভয়ঙ্কর। এই অদৃশ্য শক্তি রুখতে হলে সব গণতান্ত্রিক শক্তিকেই একযোগে রুখে দাঁড়াতে হবে। না হয় নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশ থেকে অর্থনৈতিক অগ্রগতির পথে মধ্যম আয়ের দেশে যাওয়ার স্বপ্ন আঁতুড়ঘরেই মারা যাবে।