শিক্ষকের স্থান প্রতিষ্ঠানে, রাজপথে নয় ইসমত পারভীন রুনু
সভ্যতার ঊষালগ্ন থেকেই শিক্ষা ও সভ্যতা হাত ধরাধরি করে চলে আসছে। উন্নত বিশ্বে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সম্মানের পাশাপাশি বেতন বৈষম্য একেবারেই নেই শিক্ষক সমাজে। বরং শিক্ষকদের অবদানের কথা চিন্তা করে সম্মানজনক বেতন বরাদ্দ রাষ্ট্র তাঁদের মূল্যায়ন করে থাকে। অথচ এ ধারা অনুসরণে আমরা ব্যর্থ। আসলে বেতন কাঠামো আর সামাজিক মর্যাদা অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত।
শিক্ষকের মর্যাদা কতখানি তার অনেক উদাহরণ আছে ইতিহাসে। এই আধুনিক যুগে শিক্ষকদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করা, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সম্মান বাড়ানো খুবই জরুরি। শিক্ষকতা পেশার প্রতি সবাই যথেষ্ট শ্রদ্ধাশীল। চাওয়া-পাওয়া, বেতন-কাঠামো, পদমর্যাদার বৈষম্য, পদোন্নতি এইসব বিষয়ের সমাধানকল্পে শেষ পর্যন্ত শিক্ষকদের রাজপথে আন্দোলন করতে হলো? প্রতিবাদের কর্মসূচি হিসেবে ছাত্র ধর্মঘট, মানববন্ধন, বিক্ষোভ মিছিল, অনশন এ শব্দগুলো আমাদের চিরচেনা। কিন্তু শিক্ষক ধর্মঘট, কর্মবিরতি পালন, মানববন্ধন, প্রতীকী অনশন এ শব্দগুলোর সাথে পরিচিতি বেশিদিনের নয়। আন্দোলন হবে দেশের ও মানুষের জীবন মানের উন্নয়ন নিয়ে। শিক্ষক আন্দোলনের প্রশ্নই ওঠে না। সম্মানিত শিক্ষকদের এ কর্মসূচি শিক্ষার্থীর অভিভাবক হিসেবে আমাদের কষ্ট দেয়। শ্রদ্ধেয় শিক্ষকদের প্রতিষ্ঠানেই মানায়, অন্য কোথাও বেমানান লাগে।
অপ্রত্যাশিত হলেও সত্য, শিক্ষকতা পেশায় থেকে কেউ কেউ কোচিং বাণিজ্য, প্রশ্নপত্র ফাঁস, বিভিন্ন রকম অশুভ তৎপরতার সাথে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছেন। যা আদৌ কাম্য নয়। আত্মমর্যাদা সম্পন্ন শিক্ষকের সংখ্যা দিন দিনই কমে আসছে। যার ফলশ্রুতিতে শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। তাছাড়া নিবেদিত প্রাণ শিক্ষকের আজ বড্ড অভাব।
বেতন কাঠামো নিঃসন্দেহে একটি বড় বাঁধা। কিন্তু শিক্ষা ইদানিং জ্ঞানার্জনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। কিছুক্ষেত্রে রীতিমত তা ব্যবসায় রূপ নিয়েছে, যা অনভিপ্রেত। যদিও আমরা জানি, সব পেশাজীবীর হাতেখড়ি হয় শিক্ষকের হাতেই। এক্ষেত্রে ঐক্য প্রয়োজন সবক্ষেত্রে। পারষ্পরিক সমঝোতা ও আপোসের কোন বিকল্প নেই। শিক্ষকদের মর্যাদা সমুন্নত রাখতে এই সমস্যার সমাধান জরুরি। শিক্ষা ব্যবস্থা স্থবির হয়ে পড়ছে। বর্তমান কাঠামোতেই বেতন বৈষম্য দূর হোক সে প্রত্যাশা শিক্ষকবৃন্দের।
প্রাথমিক স্তর থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। বিভিন্ন আন্দোলন, লাগাতার কর্মবিরতির ফলে শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন দীর্ঘায়িত হচ্ছে, তাতে অভিভাবক হিসেবে আমরা শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ জীবন নিয়ে শঙ্কিত, ব্যথিত। একটা অনিশ্চয়তার মধ্যে শিক্ষার্থীদের দিন কাটছে। অথচ ডক্টর আনিসুজ্জামান স্যার বলেছেন, ‘গুরু-শিষ্যের সম্পর্ক খুবই মধুর’। পরষ্পরের প্রতি শ্রদ্ধা, ভালবাসা, স্নেহাদর এই সম্পর্কের মূল ভিত্তি। শিক্ষকের আচার-আচরণ, চিন্তা-ভাবনা, আদর্শ, সততা সবকিছুই শিক্ষার্থীর কাছে অনুকরণীয় ও অনুসরণীয়। শিক্ষার্থীর সাফল্যে যেমন শিক্ষক আনন্দিত হন, তেমনি বিপথগামিতায় দুঃখ পান। একজন শিক্ষকের সামাজিক ও পারিবারিক দায়বদ্ধতা রয়েছে। আমরা কখনোই তা উপলব্ধি করি না। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে যাঁরা জ্ঞান বিতরণ করে চলেছেন, শিক্ষার্থীর জ্ঞান সাধনায় নিজেকে নিয়োজিত রাখছেন শত প্রতিকূলতার মধ্যেও। তাঁদের মর্যাদা সমুন্নত রাখতেই হবে যে কোন মূল্যে।
মেধাবিকাশ ও উন্নয়নে শিক্ষার্থীর চরিত্র গঠনে, নৈতিক ও মানসিক গুণাবলি বিকাশেও মূখ্য ভূমিকা শিক্ষকেরই। জ্ঞানতাপস, ব্যক্তিত্ববান, মেধাবী, শ্রেণিকক্ষে আন্তরিক পাঠদানকারী, প্রাণবন্ত, নিবেদিতপ্রাণ মানুষটিই মানুষ গড়ার কারিগর, শ্রদ্ধা আর আদর্শের আসনে যিনি অধিষ্ঠিত, তিনিই শিক্ষক। একথা আমরা গর্বের সাথে বলতেই পারি- ‘তাঁদের চির উন্নত শির, সম্মান তাঁর শিরোভূষণ’।
লেখিকাঃ সংস্কৃতিকর্মী ও সংগঠক, সিলেট।