বিশ্ব ম্যালেরিয়া দিবস ২০১৫ “ভবিষ্যতের বিনিয়োগ, কমাবে ম্যালেরিয়া”

malariaআজ ২৫ এপ্রিল, বিশ্ব ম্যালেরিয়া দিবস। এ বছরের প্রতিপাদ্য “ভবিষ্যতের বিনিয়োগ, কমাবে ম্যালেরিয়া” (Invest in the future, defeat malaria)। বিশ্বের প্রায় অর্ধেক মানুষ ম্যালেরিয়ার ঝুঁকিতে আছে। ২০১৪ সালে ৯৭টি দেশ ও অঞ্চলে ম্যালেরিয়া প্রাদুর্ভাব ছিল। বাংলাদেশের ১৩টি জেলার ৭১টি উপজেলায় ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাব সর্বাধিক। প্রতি বছর ম্যালেরিয়া রোগজনিত অসুস্থতা ও মৃত্যুর প্রায় শতকরা ৯৮ ভাগ সংগঠিত হয়ে থাকে সীমান্তসংলগ্ন এই ১৩টি জেলায়। জেলাগুলো হচ্ছে- রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান, কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, ময়মনসিংহ, শেরপুর, নেত্রকোনা ও কুড়িগ্রাম। প্রাদুর্ভাবের মাত্রা অনুযায়ী জেলাগুলোকে আবার ৩টি স্তরে ভাগ করা হয়েছে। যেমন- পার্বত্য চট্টগ্রামের ৩টি জেলা উচ্চ ম্যালেরিয়া প্রবণ; কক্সবাজার মধ্য ম্যালেরিয়া প্রবণ এবং বাকী ৯টি জেলা কম ম্যালেরিয়া প্রবণ।

সিলেট বিভাগের ম্যালেরিয়া পরিস্থিতিঃ
সিলেট বিভাগের ৪টি জেলাতেই ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাব আছে। এর মধ্যে মৌলভীবাজার জেলার সব ক’টি উপজেলা, সিলেট জেলার ৪টি উপজেলা (কোম্পানীগঞ্জ, গোয়াইঘাট, কানাইঘাট, জৈন্তাপুর), হবিগঞ্জ জেলার ২টি উপজেলা (মাধবপুর, চুনারুঘাট) এবং সুনামগঞ্জ জেলার ৭টি উপজেলা (সদর, সদর দক্ষিণ, তাহিরপুর, ছাতক, দোয়ারাবাজার, ধর্মপাশা, বিশ্বম্ভরপুর) ম্যালেরিয়া প্রবণ। তবে সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের তথ্য অনুযায়ী ২০১৪ সালে অন্তত: আরো ৫টি উপজেলা থেকে ম্যালেরিয়া আক্রান্ত রোগীরা এ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এ উপজেলা গুলো হলো- জগন্নাথপুর, জামালগঞ্জ, হবিগঞ্জ সদর, নবীগঞ্জ ও সিলেট সদর।
আশার কথা, ২০১৩ সালে সিলেট বিভাগে মোট ম্যালেরিয়া আক্রান্তের সংখ্যা ১০৮০ হলেও ২০১৪ সালে তা কমে দাড়িয়ে হয়েছে ৪৫৯। ২০১৫ সালের প্রথম ৩ মাস মাসভিত্তিক আক্রান্তের সংখ্যা ছিল যথাক্রমে জানুয়ারী ২২, ফেব্রুয়ারী ১৫ ও মার্চ ১৪, যা ক্রমবর্ধমান নিম্নমুখী ধারাকে নির্দেশ করে। এ সাফল্য বাংলাদেশ সরকারের জাতীয় ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রন কর্মসূচী এবং এর সহযোগী হিসেবে কর্মরত এনজিও সমূহের। সিলেট বিভাগে ব্র্যাক এর নেতৃত্বে যেসব এনজিও কাজ করে এরা হলো- সীমান্তিক (কানাইঘাট), হীড বাংলাদেশ (জৈন্তাপুর), ভার্ড (গোয়াইনঘাট, কোম্পানীগঞ্জ, সুনামগঞ্জ সদর, দোয়ারাবাজার, বড়লেখা), বন্ধন (ছাতক), বিডিএসসি (তাহিরপুর, রাজনগর), এফআইভিডিবি (বিশ্বম্ভরপুর), সাজিদা ফাউন্ডেশন (ধর্মপাশা), এস এস এস (মৌলভীবাজার সদর, কুলাউড়া, চুনারুঘাট, মাধবপুর) এবং ব্র্যাক স্বয়ং কাজ করে শ্রীমঙ্গল ও কমলগঞ্জ উপজেলায়। সারা দেশে ব্র্যাকসহ ২১টি এনজিও’র সমন্বয়ে গঠিত কনসোর্টিয়াম ২০০৭ সাল থেকে এ কাজ করে যাচ্ছে।

অর্থায়নঃ
বাংলাদেশ ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমকে শক্তিশালী ও সম্প্রসারিত করার জন্য গ্লোবাল ফান্ড টু ফাইট এইডস, টিউবারকিউলোসিস এন্ড ম্যালেরিয়া (JDTAF) থেকে আর্থিক সহায়তা লাভ করেছে। এছাড়া এইচপিএনএসডিপি’র আওতায় যুক্তরাজ্য সরকারের ডিএফআইডি’র নেতৃত্বে যুক্তরাজ্যসহ মোট ৪টি দেশের দাতাসংস্থার সমন্বয়ে গঠিত কনসোর্টিয়াম-জয়েন্ট ডোনার টেকনিক্যাল এসিস্টেন্স ফান্ড (GFATM) এ কাজকে আরো বেগবান করার জন্য ৩জন সার্ভিলেন্স মেডিকেল অফিসার পদায়নের ব্যবস্থা করেছে। তবে ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রন কর্মসূচীর সার্বিক সাফল্যের জন্য আরো ব্যাপক অর্থায়ন প্রয়োজন। সেজন্মই ২০১৩ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত একই প্রতিবাদ্য বিষয় নিয়ে বাংলাদেশসহ বিশ্বের ম্যালেরিয়া আক্রান্ত দেশ ও অঞ্চলে দিনটি পালিত হয়ে আসছে। কারণ দেখা গেছে যদিও বিগত বছরগুলোতে ম্যালেরিয়া রোগ প্রতিরোধ, নির্ণয় ও চিকিৎসায় একটা গুরুত্বপূর্ণ গতি এসেছে, কিন্তু বার্ষিক ৩.৬ বিলিয়ন ইউএস ডলারের অর্থাভাব কার্যক্রমের গতিকে নিম্নমুখী করার ঝুঁকি তৈরি করেছে। যদি না বিশ্ব অর্থায়নের এ শূন্যতা পূরন করার উপায় খুঁজে না পায় এবং ম্যালেরিয়া উপদ্রুত দেশগুলো ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য পর্যাপ্ত অর্থ ও কারিগরী সহায়তা না পায়, তবে ম্যালেরিয়ার পুনরার্বিভাব আরো অনেক মূল্যবান জীবন কেড়ে নেবে।

বাংলাদেশে ম্যালেরিয়া রোগ নির্নয় ও এর চিকিৎসাঃ
বিনামূল্যে দ্রুত রোগ নির্ণয় পদ্ধতি বা RDT, যার মাধ্যমে মাত্র ১৫ মিনিট বা তারও কম সময়ে ম্যালেরিয়া রোগ নির্ণয় করা যায়। এছাড়া রক্তকাচঁ পরীক্ষার মাধ্যমেও ম্যালেরিয়া রোগ সনাক্ত করা যায় এবং এটিও বিনামূল্যে।
পূর্বে উল্লেখিত এনজিও সমূহের ল্যাবরেটরী, কমিউনিটি কিনিক, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, এলাকার সরকারী/বেসরকারী স্বাস্থ্যকর্মী, জেলা সদর হাসপাতাল এবং মেডিকেল কলেজ হাসপতালে এ উভয় প্রকারের পরীক্ষার ব্যবস্থা আছে।
পরীক্ষায় ম্যালেরিয়া ধরা পড়লে প্রাথমিক পর্যায়ে মাত্র ৩দিন পূর্ন মাত্রায় ঔষধ সেবন করলে ম্যালেরিয়া সম্পূর্ন ভাল হয়। ওয়ান স্টপ সার্ভিস হিসেবে যেখানে বিনামূর্লে রক্ত পরীক্ষা, সেখানেই বিনামূল্যে ঔষধও প্রদান করা হয় এবং রোগ ভাল হলো কি-না কিংবা রোগী ঠিকমত ঔষধ খাচ্ছে কি-না, তা এনজিও কর্মীরা রোগীর বাড়ী গিয়ে ফলো-আপ করেন।

মালেরিয়া প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রন করব কিভাবেঃ
ম্যারেরিয়া জীবানুর বাহক নিয়ন্ত্রণ কমিউনিটি পর্যায়ে রোগটি প্রতিরোধের প্রধান উপায়। ব্যক্তি পর্যায়ে মশার কামড় থেকে নিজেকে সুরক্ষা করা। এজন্য বিতরণকৃত দীর্ঘস্থায়ী কীটনাশকযুক্ত মশারী প্রতিদিন সন্ধ্যা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে টানানো। এখানে উল্লেখ্য যে, সিলেট বিভাগে জানুয়ারী-ফেব্রুয়ারী ২০১৫ ইং সনে তিন লক্ষ পঁচিশ হাজার পাঁচশতটি মশারী বিতরণ করা হয়েছে।
রাতের বেলা বিশেষ করে ঘরের বাইরে গেলে হাত-পা ঢাকা থাকে, এমন কাপড় পরিধান করা। সম্ভব হলে শরীরের অনাবৃত অংশ মশা বিতাড়ক ক্রিম বা লোশন এবং ঘরের দরজা জানালায় নেট বা জাল ব্যবহার করা। মশা তাড়াবার ধোয়া যেমন-মশার কয়েল ইত্যাদি ব্যবহার করা। মশা ডিম পাড়ে ও বংশ বিস্তার ঘটায়, এমন অপ্রয়োজনীয় ডোবা, গর্ত, নর্দমা ভরাট করে ফেলা। স্থায়ী আবদ্ধ জলাশয়ে শূককীটখেকো মাছ যেমন-তেলাপিয়া, গাপ্পি, নাইলোটিকা ইত্যাদি কার্প জাতীয় মাছ চাষ করা।
সকল প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৩য় থেকে ৫ম শ্রেণী পর্যন্ত ছাত্র-ছাত্রীদেরকে তাদের পরিবার ও আশ-পাশের বাড়ীতে পৌঁছে দেয়ার জন্য ৩টি বার্তা শেখানো-
১। জ্বর হলে ম্যালেরিয়া হতে পারে।
২। ম্যালেরিয়া সনাক্ত করার জন্য বিনামূল্যে রক্ত পরীক্ষার ব্যবস্থা আছে।
৩। পরীক্ষায় ম্যালেরিয়া ধরা পড়লে বিনামূল্যে ঔষধ পাওয়া যায়।

ডা. ওমর ফারুক
সার্ভিলেন্স মেডিকেল অফিসার-ম্যালেরিয়া
সিলেট বিভাগ, সিএস অফিস, সিলেট।
Email: [email protected]