সনাতন ধর্মের দূর্গাপুজার ইতিহাস : বিপ্লব রায়
সনাতন ধর্মের দূর্গাপুজার ইতিহাস আধ্যাত্মিক অর্থের দিকে লক্ষ্য করা হলে দেখা যায়,একটি মানবদেহের তিনটি ধারা ইড়া, পিঙ্গলা এবং সুষুম্না। এই সুষুম্নাতে অবস্থিত ছয়টি চক্র।এ গুলি হচ্ছে মূলাধার, সাবিষ্ঠান, মণিপুর, অনাহত, আজ্ঞা এবং সহগ্রার। আমাদের মণিপুর চক্র বা দশম দলে দুর্গা পূজা হয়। মূলাধারে চতুর্থদল পদ্মে মহামায়া অবস্থিত। ভক্ত যখন প্রণব বীজের সাহায্যে মহামায়ার মায়া বন্ধন ছিন্ন করত সাবিষ্ঠানচক্র পার হয়ে মণিপুর চক্র বা দশম দলে সাধনায় ব্রতী হয় তখনই শুরু হয় যোগমাযা বা দুর্গাদেবরি সাধনা।এই সাধনায় সিদ্ধ হলে মানুষ মায়াপাশ ছিন্ন করতে পারে এবং ত্রিতাপের জ্বালা থেকে নিস্কৃতি পায়। শ্রীমদ্ভগত গীতায় শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে লক্ষ্য করে বলেন, গুণময়ী মহামায়া দুরজয়া, মামেব যেপ্রপদ্যন্তে মায়ামেতাং তরন্তিতে। অর্থাৎ দৈবিমায়া দিয়ে জগতকে আচ্ছন্ন করে রেখেছি একমাত্র আমার কৃপা ছাড়া। এই দৈবী মায়া অতিক্রান্ত করা সম্ভব নয়।সুতরাং এ পূজা আমাদের বন্ধনমুক্তির পূজা। এ পূজা সকল সংকীর্ণতা, কুসংস্কার ও ভেদ বুদ্ধির অবসান ঘটায়। মায়ের এক নাম ব্রহ্মময়ী।এ ই ব্রহ্ম শব্দটির বুৎপত্তিগত ধাতু হল বৃন্হ অর্থাৎ বিস্তৃতি।অতএব বিস্তৃতির মধ্যে যার অস্তিত্ব তিনিই ব্রহ্মময়ী।তাই এই ব্রহ্মময়ী দেবীর আরাধনায় আমরা বৃহতের সন্ধান পাই। অসুর নাশিনী মা যে অসুরগুলির বিনাশ করেন সেগুলি আমাদের মধ্যে নিত্য বিরাজ করছে। সেগুলি হল কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ, মাৎসর্য।এই ষড়রিপুর বহির্মুখী গতিকে ফিরিয়ে এনে অন্তর্মুখী মায়ের চরণে নিবেদন করাইপ্রকৃত দুর্গাপূজা। তাই আসুন হে বিশ্ববাসী-হৃদয়ের দেবীদহ থেকে শতাষ্টো নীলপদ্ম চয়ন করে মায়ের শ্রীচরণে নিবেদন করি। বিশ্বভ্রাতৃত্বের বন্ধনে নিজেকে বেঁধে অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে সকলে গেয়ে উঠি-দুর্গা এই নামটি শুনলেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে একটা দেবীমূর্তি।তাঁর দশ হাতে দশ রকম অস্ত্র, এক পা সিংহের পিঠে, এক পা অসুরের কাঁধে। তাঁকে ঘিরে থাকেন গণেশ, লক্ষ্মী, সরস্বতী আর কার্তিক ঠাকুর। যাঁরা সেকালে কেতায় ঠাকুর বানান, তাঁদের ঠাকুরের পিছনে চালচিত্রে আরও নানারকম ঠাকুর দেবতার ছবিও আঁকা থাকে।আর যাঁরা আধুনিক, তাঁরাপ্রতিমার মাথার উপর একখানা ক্যালেন্ডারের শিবঠাকুর ঝুলিয়ে রাখেন। মোটামুটি এই মূর্তি বছর বছর দেখে আমরা অভ্যস্ত। তবে মাঝে মাঝে পুজো উদ্যোক্তারা একটু স্বাদবদলের জন্য বানান পঞ্চদুর্গা, নবদুর্গা, একাদশ দুর্গা, একান্ন দুর্গা ইত্যাদি। শাস্ত্রে কতরকম মাতৃমূর্তির কথা আছে। তার থেকেই সামর্থ্য অনুযায়ী কয়েকটা বেছে নিয়ে পঞ্চদুর্গা, নবদুর্গা ইত্যাদি বানানো হয়। আমাদের ছেলেবেলায় দেখেছি, থিমপুজো শুরু হওয়ার আগে এই সব প্যান্ডেল নিয়ে ঠাকুর-দর্শনার্থীদের মধ্যে একটা বিশেষ আগ্রহ থাকত। এখনও আছে। মায়েরসনাতন মূর্তির আবেদন কখনও ম্লান হয় না ঠিকই, কিন্তু মানুষ এই সুযোগে অন্যান্য রূপগুলি দেখে চোখ জুড়িয়েনিতেও ছাড়েন না।শাস্ত্রে দুর্গার নয়টি নির্দিষ্ট মূর্তিকে বদুর্গা’ বলে। এঁরা হলেন ব্রহ্মাণী, কৌমারী, বৈষ্ণবী, কৌমারী, নারসিংহী, বারাহী, ইন্দ্রাণী, চামু-া, কাত্যায়নী ও চ-িকা। দুর্গাপূজার সময় দেবীদুর্গার আবরণদেবতা হিসেবে এঁদের পূজা করা হয়।আবার নবপত্রিকা (কলাবউ)-এর নয়টি গাছও নয় দেবীরপ্রতীক।এঁরা হলেন ব্রহ্মাণী (কলা), কালিকা (কচু), দুর্গা (হলুদ), জয়ন্তী (জায়ফল), শিবা (বেল), রক্তদন্তিকা (ডালিম), শোকরহিতা (অশোক), চামু-া (মান) ও লক্ষ্মী (ধান)। এঁরা পূজিত হন ওঁ নবপত্রিকা বাসিন্যৈ নবদুর্গায়ৈনমঃমন্ত্রে।তবে এঁরা ছাঙাও তন্ত্রে, পুরাণে আরও কয়েকজন দুর্গা-নামধারিণী দেবীর সন্ধান পাই।আবার দেবী দুর্গার অন্যান্য কয়েকটি রূপেরও দেখা পাওয়া যায়। আমরা সাধারণত দুর্গার যে মূর্তিটি শারদীয়া উৎসবে পূজা করি, সেই মূর্তিটির শাস্ত্রসম্মত নাম মহিষাসুরমর্দিনী-দুর্গা।স্মার্তমতে যাঁরা পঞ্চদেবতার পূজা করেন, তাঁরা জয়দুর্গার নাম ও ধ্যানমন্ত্রের সঙ্গে পরিচিত।এছাঙা আছেন মহিষমর্দিনী-দুর্গা, কাত্যায়নী-দুর্গা, নীলকণ্ঠী-দুর্গা, ক্ষেমঙ্করী-দুর্গা, হরসিদ্ধি-দুর্গা, রুদ্রাংশ-দুর্গা, বনদুর্গা, অগ্নিদুর্গা, বিন্ধ্যবাসিনী-দুর্গা, রিপুমারি-দুর্গা, অপরাজিতা-দুর্গাপ্রমুখ দেবীগণ।এঁরা সবাই আগমন-শাস্ত্রপ্রসিদ্ধ দেবী। এছাড়া তন্ত্রশাস্ত্রে দুর্গা-নাম্নী দেবীর যে ধ্যানমন্ত্র পাওয়া যায়, সেটিও আমাদের দেখা দশভুজা-মূর্তির মতো নয়।মহিষাসুরমর্দিনী-দুর্গাকে নিয়েআমাদের নতুন করে কিছুর বলার নেই।দুর্গাপূজায়প্রচলিত জটাজুটসমাযুক্তা ইত্যাদি ধ্যানমন্ত্রের আধারে নির্মিত এই দেবীমূর্তি আমাদের সকলেরই পরম-পরিচিত। তবে বিষ্ণুধর্মোত্তর পুরাণ-এ মহিষাসুরমর্দিনীর একটু আলাদা রকমের বর্ণনা আমরা পাই।চ-িকা নামে উল্লিখিত এই দুর্গার দশের জায়গায় কুডড়টি হাত। শ্রীশ্রীচ-ী-তে অষ্টাদশভূজা মহালক্ষ্মীর কথা আছে, এঁর হাত তাঁর থেকেও দুটি বেশি। ডান দিকের দশ হাতে থাকে শূল, খঙগ, শঙ্খ, চক্র, বাণ, শক্তি, বজ্র, অভয়, ডমরু, ছাতা; আর বাঁদিকের দশ হাতে থাকে নাগপাশ, খেটক, পরশু, অঙ্কুশ, ধনুক, ঘণ্টা, পতাকা, গদা, আয়না ও মুগুর। বাকি সবই আমাদের চেনা মূর্তিটির মতো।দেবী কাত্যায়নী-দুর্গার মূর্তিটিও আমাদের দশভূজা-দুর্গার অনুরূপ।তবে আমাদের পরিচিত মহিষাসুরমর্দিনী ও তন্ত্রকথিত মহিষমর্দিনীর রূপে সামান্য ফারাক আছে।দেবী মহিষমর্দিনী অষ্টভুজা।এঁর ধ্যানে সিংহের উল্লেখ পাওয়া যায় না।দেবীকে মহিষের মাথার উপর বসে থাকতে দেখা যায়।হাতে থাকে শঙ্খ, চক্র, খঙগ, খেটক, ধনুক, বাণ, শূল ও তর্জনীমুদ্রা।এর পূজার বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল শঙ্খপাত্রে অর্ঘ্যস্থাপনের উপর নিষেধাজ্ঞা; মৃৎপাত্রে এই কাজটি করতে হয়।কুলাচারে পূজিতা দেবী জয়দুর্গার মূর্তিটি কিছুটা আমাদের পরিচিত জগদ্ধাত্রী মূর্তির মতো। শুধু দেবীর চার হাতে থাকে শঙ্খ, চক্র, খড়গ ও ত্রিশূল এবং দেবীর গায়ের রং কালীর মতো কালো।কপালে থাকে অর্ধচন্দ্র।সিংহের পদতলে হাতি অনুপস্থিত। কেউ কেউ মনে করেন, জয়দুর্গা কালী ও দুর্গার সম্মিলিত মূর্তি।নীলকণ্ঠী, ক্ষেমঙ্করী ও হরসিদ্ধিÍতিনজনই চতুর্ভূজা।সুখ ও সম্পদদাত্রী নীলকণ্ঠীর হাতে থাকে ত্রিশূল, খেটক, পানপাত্র ও বরদামুদ্রা।সুস্বাস্থ্যদাত্রী ক্ষেমঙ্করীর হাতে থাকে বরদামুদ্রা, ত্রিশূল, পদ্ম ও পানপাত্র।সিদ্ধিদাত্রী হরসিদ্ধির হাতে থাকে ডমরু, কম-লু, খঙগ ও পানপাত্র।দেবী রুদ্রাংশ-দুর্গাও চতুর্ভূজা।তবে তিনি দ্বিনয়না, কৃষ্ণবর্ণা ও লাল অলংকারে শোভিতা।তাঁর হাতে থাকে শূল, খড়গ, শঙ্খ ও চক্র। দেবীর বাহন সিংহ ও দেবীর দুই পাশে থাকে চন্দ্র ও সূয।অনেকটাই জয়দুর্গার মতো এই দেবীর রূপ।বনদুর্গার আট হাত।অস্ত্রশস্ত্র মহিষমর্দিনীর অনুরূপ।বিশেষ বৈশিষ্ট্য দেবীর গায়ের রঙে তিনি ঘাসের মতো সবুজ।অগ্নিদুর্গাও অষ্টভুজা।তাঁর আট হাতে থাকে খঙগ, চক্র, খেটক, বাণ, পাশ, অঙ্কুশ, বরদা মুদ্রা ও তর্জনী মুদ্রা।দেবী সিংহবাহিনী, ভীষণা এবং কপালে অর্ধচন্দ্রধারিণী।দুই পাশে ঢাল-তলোয়ার ধরে থাকেন দেবীর দুই সহচরী।বিন্ধ্যবাসিনী-দুর্গা পদ্মাসনা, ত্রিনয়না ও চতুর্ভূজা।তাঁর চার হাতে থাকে শঙ্খ, চক্র, বর ও অভয় মুদ্রা।তাঁরও কপালে অর্ধচন্দ্র।সালংকারা এই দেবীকে ঘিরে স্তব করেন ইন্দ্রাদি দেবতারা।দেবীর বাহন সিংহ পাশে দাঁডড়য়েথাকে।রিপুমারি-দুর্গা আবার দ্বিভূজা।তাঁর দুই হাতে থাকে ত্রিশূল ও তর্জনী মুদ্রা।অপরাজিতা-দুর্গার পূজা বিজয়াদশমীর দিন বিসর্জনান্তে কুলাচার অনুসারে হয়েথাকে।এই দেবী সিংহবাহিনী ও ত্রিনয়না।তাঁর চার হাতে থাকে পিণাক, বাণ, খড়গ ও খেটক।তাঁর মাথায় জটাজুট ও অর্ধচন্দ্র; কোমরে বাসুকি নাগের বেল্ট।তন্ত্রে দুর্গার যে দুটি রূপ বর্ণিত সেদুটি দেবী জগদ্ধাত্রীর রূপ।তার একটিতে অবশ্য সিংহের পায়ের তলায় হাতি থাকে না।অপর রূপটির মন্ত্র অনুসারে জগদ্ধাত্রী পূজা হয়। এছাড়াও কত বিচিত্র দেবী যে দুর্গা নামে বাংলার গ্রামে গ্রামে পূজা পান, তারও ইয়ত্তা নেই।চ-ীতে দেখি, শুম্ভাসুর দেবীর বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে বলছে, অপরের শক্তিতে বলীয়ান হয়েদেবী অসুরদের পরাজিত করেছেন; আর তক্ষুনি দুর্গা দেখিয়েদিচ্ছেন, তিনি ছাঙা জগতে দ্বিতীয় কোনো দেবী নেই; আর সব দেবী-বিভূতি মিশে যাচ্ছে তাঁরই শরীরে।সেই রকম দুর্গার এই সব বিচিত্র রূপও সাধকভক্তের হৃদয়েসেই এক ও অদ্বিতীয় আদ্যাশক্তি মহামায়াররূপান্তরমাত্র।চন্ডী(প্রথম পর্ব )মায়ের পূজো আসছে।চলুন একটু চন্ডীর কথা শুনি।আসুনগদ্য আকারে চন্ডী পাঠ করি।ধারাবাহিক ভাবে চলবেচ-ীর পাঠ।হু আগে যখন দ্বিতীয় মনু ছিলেন তখন চৈত্রের বংশ জাতরাজা সুরথ পৃথিবীর এক মাত্র অধীশ্বর ছিলেন।তিনিতারপ্রজাদের পুত্রসম স্নেহ ভালোবাসা দিয়ে রাজ্যশাসন করতেন। একদা যবন রাজারা তার রাজ্য আক্রমণ করেন।যুদ্ধে রাজা সুরথ এর পরাজয় হয়।তার রাজ্য ,সিংহাসন , ধন, সম্পদ সব শত্রুর হাতে চলে যায়।তিনি সবহারিয়েনিঃস্ব হয়েপঙেন।মনের দুঃখে তিনি বনেচলে যান।সেখানে তিনি বিষন্ন মনে ঘুরতে থাকেন।বনে গিয়েপ্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য দেখে রাজাখানিকটা এগিয়েগেলেন ।সেখানে তিনি এক মুনিরআশ্রম দেখতে পেলেন।আশ্রমে ঢুকে জানতে পারলেনএটি মেধস্ মুনির আশ্রম। রাজা সেখানে চিন্তা করতেলাগলেন “ অতীতে আমার পূর্বপুরুষ গন যে রাজ্যকে সুন্দরভাবে পালন করিয়াছেন , তাহা এখন দুষ্ট অমাত্য দেরদখলে ।তারা এখন সকলপ্রজাদের রক্ষা করিতেছেনকিনা ? জানি না সেই মহাবলবান মদগ্রাবীপ্রধানহাতিটি শত্রুদের অধিকৃত হয়েঠিকঠাক খাবার পাচ্ছেকিনা ? যে সকল রাজ কর্মচারী আগে পারিতোষিক,বেতন , খাদ্যদ্রব্য পেয়েআমার অনুগত থাকত , আজ তারাঅন্যের দাসত্ব করছে।আমি এত কষ্ট করে , দুঃখ করে যেবিশাল ধনরাশি জমা করেছিলাম তা ঐ অমিতব্যয়ী গনঅপচয় করে শেষ করবে । অপর দিকে সমাধি নামক এক বৈশ্য সেই বনে বিষন্ন মনেচলে আসেন।সমাধি বৈশ্য এক বিত্তশালী ঘরের ছিলেন। তিনি ছিলেন ধনী। কিন্তু তার স্ত্রী ও পুত্রেরা সমস্তসম্পত্তি হাতিয়েতাকে পরিত্যাগ করেন। ঘটনাচক্রেসমাধি বৈশ্য বনে ভ্রমণ করতে করতে মেধস মুনির আশ্রমেপৌছালেন। সমাধি বৈশ্য কে সেখানে দেখে রাজা সুরথ তার পরিচয় জানতে চাইলে সমাধি বৈশ্য তার পরিচয় ও দুঃখের কারণ জানালেন। সমাধি বৈশ্য জানালেন “ আমার অসাধু স্ত্রী ও পুত্রেরা ধনের লোভে আমাকে পরিত্যাগকরেছে।আমি এখন ধনহীন দরিদ্র। আমার আত্মীয় কুটুম্ব ,বন্ধু বান্ধব রা আমাকে পরিত্যাগ করায় আমি মনে অনেকদুঃখ নিয়েবনে চলে এসেছি। কিন্তু এখানে এসেওআমি আমার স্ত্রী , পুত্র ও বন্ধু দের ভুলতে পারছি না।তারা কেমন আছে , তারা ভালো না খারাপ পথে চলছেতাও আমি জানি না।রাজা সুরথ বললেন“ যে আত্মীয় ও স্ত্রী পুত্রেরা ধনলোভে আপনাকে পরিত্যাগ করল তাদের জন্য আপনার মনএত স্নেহাসক্ত হচ্ছে কেন ?”সমাধি বৈশ্য বললেন“ আপনি আমার সম্পর্কে ঠিকবলেছেন।কিন্তু আমি আমার মনকে নিষ্ঠুর করতে পারছিনা।বরং তাদেরপ্রতি আমার মন আরো আসক্ত হচ্ছে।তাদের জন্য আমার দুশ্চিন্তা হচ্ছে। আমি আমার মনকে নিষ্ঠুর করতে পারছি না। রাজা সুরথ ও সমাধি বৈশ্য এরপর মেধস্ মুনিকেপ্রনামজানিয়েবললেন“ হে ভগবন , আপনার কাছে একটিপ্রশ্ন করি।আপনি কৃপা করে তার উত্তর দিন।আমার মনআমার নিজের বশীভূত নয়। সেজন্য আমার হারানো রাজ্যা দিতে এখনও আমার মমতা আছে। আমি এও জানিযে এই হারানো মমতা দুঃখের কারন।কিন্তু এমন জানাসত্ত্বেও আমার হারানো রাজ্য ও রাজ্যের অঙ্গ গুলিরজন্য আমার যে আসক্তি বা মমতা থেকে গেছে এর কারণকি ? এই সমাধি বৈশ্য কেও তার স্ত্রী ও পুত্রেরা তাঁর ধনথেকে বঞ্চিত করেছে।তাঁর অমাত্য কর্মচারীরা তাকেবর্জন করেছে, আত্মীয় স্বজন রাও তাকে ছেঙে চলেগেছে। কিন্তু তবুও ইনি সেই তাদেরপ্রতি একান্তভাবেই আসক্ত।এই ভাবেই ইনি ও আমি উভয়েই খুব দুঃখিত হয়েছি। কারণ স্ত্রী- পুত্র – রাজ্যাদি বিষয়েদোষদেখেও তাদের প্রতি আমাদের মন মমতায় আকৃষ্ট হয়েআছে।হে মহামতি, আমারও এরকম জ্ঞান থাকাসত্ত্বেও আমাদের এই মোহ কি জন্য? এইরকম মূঢ় তাবিবেকহীন লোকেদেরই হয়ে থাকে। মেধস ঋষি বললেন“ হে মহাভাগ, সকলপ্রাণীরই রূপ ,রস ,প্রভৃতি সম্পর্কিত ইন্দ্রিয় গ্রাহ্য বিষয়ে জ্ঞান আছে এবং সে সব বিষয় সমূহ কিভাবে তাদের জ্ঞানগোচর হয় তা আপনাদের বলছইপেঁচা বা তার মতপ্রানী দিনের বেলায় দেখতে পায় না। তারা অন্ধ হয়েথাকে। আবার কাক বা তার মতোপ্রানী রাতের বেলায় দেখতে পায় না। আবার অনেক প্রানী দিন রাত সর্বদা অন্ধ থাকে। আর বিড়ালের মতোপ্রানী দিন রাত সব সময় দেখতে পায়। একথা সত্য যেমানুষের বিষয় জ্ঞান আছে।কিন্তু তাদেরই শুধু বিষয়জ্ঞান আছে একথা ঠিক না। কারণ পশু পাখী হরিণ ,মাছ সকলপ্রাণীরই বিষয় জ্ঞান আছে , মানুষেরওতেমনি বিষয় জ্ঞান আছে। আবার মানুষের যে রকম বিষয়ে জ্ঞান আছে পশু পাখীদেরও সেরকমই আছে।আহার, নিদ্রাপ্রভৃতি বিষয়ের জ্ঞান পশু- পাখী এবং মানুষ উভয়েই সমান। দেখুন পাখীরা যে খাবার সংগ্রহ করে তাই তাদেরশাবকের মুখে তুলে দেয়।এর ফলে তারা খেলেও তাদের ক্ষুধার নিবৃত্তি হয় না। একথা আমরা যেমন জানি বুঝিতেমনি পাখীরাও বুঝে। অথচ সব জেনে বুঝেও তারাশস্যকণা তাদের শাবক দের মুখে তুলে দিতে কত আগ্রহ। হে নরশ্রেষ্ঠ , এই মানুষ দের ক্ষেত্রে আবার দেখছেন না, তারা ভাবে তাদের সন্তান ভবিষ্যতে তাদের প্রত্যুপকার করবে; সেই লোভে তারা তাদের সন্তান দেরপ্রতি কতই না অনুরক্ত হয়? তবুও সংসারের স্থিতিকারিনী মহামায়ারপ্রভাবে জীব গণ মোহ রুপ গর্তেএবং মমতা রুপ আবর্তে নিক্ষিপ্ত হয়েথাকে। এইমহামায়াই জগতের অধিপতি বিষ্ণুর যোগনিদ্রাস্বরুপিনী। তার দ্বারাই এই সারা জগত মোহিত হয়েআছে। সুতরাং এ বিষয়েআশ্চর্য হওয়া উচিত নয়। এমনকিসেই দেবী ভগবতী মহামায়ারপ্রবলপ্রতাপ থেকেজ্ঞানবান বা বিবেক সম্পন্ন মানুষেরও রেহাই নেই।সেই মহামায়া তাদের চিত্তকে জোর করে আকর্ষণ করেমোহের দ্বারা আবৃত করে রাখেন।অতএব যারা সাধারনমানুষ তারা যে তার মোহপাশে আবদ্ধ থাকবে তাতে আরআশ্চর্য কি ?সেই মহামায়া এই সমস্ত চরাচর জগত কে সৃষ্টি করেছেন । তিনিপ্রসন্না হলে তাঁরই কৃপায় মানুষ মুক্তিলাভ করে থাকে।সেই মহামায়াই সংসার থেকে মুক্তির একমাত্র উপায়। তিনিই পরমা ব্রহ্মবিদ্যারূপিণী ও সনাতনী।তিনি সংসার বন্ধনের কারন স্বরুপিনী অবিদ্যা এবংতিনি ব্রহ্মা , বিষ্ণুপ্রভৃতি সকল ঈশ্বরের ঈশ্বরী,অধিশ্বরী। এই কথা শুনে রাজা সুরথ ও সমাধি বৈশ্য জিজ্ঞেসকরলেন“ হে ভগবান, আপনি যাঁকে মহামায়া বলছেন –সেই দেবী কে? তিনি কি রুপে উৎপন্না হন?সেই মহামায়ার স্বভাব কি রকম? তাঁর স্বরূপ কি রকম?এবং যে জন্য তেনার আবির্ভাব হয় তা আমি আপনারথেকে শুনতে ইচ্ছা করি। মুনি বলিলেন সেই মহামায়া নিত্যা।এর অর্থ তারজত্যুনেই। মৃত্যু নেই। আবার এই জগতপ্রপঞ্চ তাঁরই বিরাট মূর্তি।তিনি সর্বত্রই বিরাজ মানা। তিনি নিত্য। তাও তাকে বহুবার আবির্ভূত হতে হয়েছে ও হতে হয়। আমি আপনাদের কাছে সেই কথা বলছি ।