অনৈতিক সম্পর্কে আপত্তি : বড়লেখায় মধ্যযুগীয় কায়দায় গৃহকর্মী যুবতি নির্যাতন

BARLEKHA-NAZMA PIC
বিশ্বজিৎ রায়, কমলগঞ্জ প্রতিনিধি: মৌলভীবাজারের বড়লেখায় মধ্যযুগীয় কায়দায় নাজমা বেগম (১৬) নামক এক গৃহকর্মীকে নির্যাতন করে গুরুতর আহত অবস্থায় বিনা চিকিৎসায় ৩ মাস তালাবন্ধী করে রাখা হয়েছে। গ্রামবাসীর সহায়তায় গৃহকর্মীর মা-বাবা তাকে তালাবন্দি একটি ঘর থেকে তাকে উদ্ধার করে সিলেট ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করে। অমানবিক, নির্মম, বর্বরোচিত এ ঘটনাটি ঘটেছে উপজেলার দক্ষিণ শাহবাজপুর ইউপির পাঁচাপাড়া গ্রামে।
ঘটনার খবর পেয়ে ৬ অক্টোবর মঙ্গলবার দুপুরে পুলিশ তাৎক্ষণিক গৃহকর্তী রাবেয়া বেগমকে আটক করেছে। এ ঘটনায় মেয়েটির বাবা মনসুর আলী বাদী হয়ে গৃহকর্তী রাবেয়া বেগম ও তার মেয়ে লুৎফা বেগমসহ ৩জনকে আসামী করে মামলা দায়ের করেছেন।
অভিযোগ সূত্রে জানা গেছে, উপজেলার দক্ষিণ শাহবাজপুর ইউনিয়নের বিছরাবন্দ গ্রামের হতদরিদ্র মনসুর আলী অভাবের তাড়নায় মেয়ে নাজমা বেগমকে ঝিয়ের কাজে দেন পাঁচপাড়া গ্রামের আজির উদ্দিনের বাড়িতে। প্রায় এক বছর পূর্বে মেয়েটিকে ঝিয়ের কাজের জন্য আজির উদ্দিনের স্ত্রী রাবেয়া বেগম নিজ জিম্মায় নাজমাকে তার বাড়িতে নিয়ে যান। এর প্রায় ৩ মাস পর নাজমার পরিবারের অনুমতি ছাড়াই রাবেয়া বেগম তার বিবাহিত মেয়ে লুৎফার শ্বশুর বাড়ি কুমিল্লার লাকসামে পাঠান ঝিয়ের কাজের জন্য।
Barlekha Nazmaগত প্রায় ৩ মাস পূর্বে থেকে গৃহকর্তী নাজমার পরিবারের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। এসময় নাজমার বাবা-মা মেয়ের খোঁজ করলে তারা টালবাহানা করে বলে তোমার মেয়ে বাসা থেকে বের হয়ে গেছে। এ ভাবে চলতে চলতে ২৫ সেপ্টেম্বর ঈদের দিন বড়লেখার Nazma Moulvibazarপাঁচপাড়া গ্রামের আজির উদ্দিনের বাড়িতে উপস্থিত হন নাজমার বাবা-মা।
তারা নাজমার সন্ধানের জন্য চাপ প্রয়োগ করলে গৃহকর্তী নাজমার কথা অস্বীকার করেন। কিন্তু “ধর্মের কল বাতাসে নড়ে”। এসময় মানসিক ভারসাম্যহীন গৃহকর্তা আজির উদ্দিন মনসুর আলীকে বলেন “ওই বেটা তর পুড়ি তো আমার ঘরো বন্ধি ৩ মাস ধরিয়া। তর পুড়িরে লইয়া যা” এ কথা শুনে মনসুর আলী এলাকার লোকজনের সহযোগীতায় শরীরের বিভিন্ন স্থানে পচন ধরে যাওয়া অবস্থায় মেয়েকে উদ্ধার করেন।
এসময় মেয়েটির শরীরের বিভিন্ন স্থানে ক্ষত দেখা গেছে। গুরুতর আহত অবস্থায় মেয়েটিকে সিলেট ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। মেয়েটি বর্তমানে হাসপাতালের ৪র্থ তলার ৬নং ওয়ার্ডের ৭নং বেডে জীবন মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে। গুরুতর অসুস্থ্য নাজমা কান্না জড়িত কন্ঠে বর্বর এ ঘটনার বর্ণনা দেন। তিনি জানান ঘটনার শুরু হয় রমজান মাস থেকে। আমাকে আমার বাড়ি থেকে রাবেয়া বেগমের বাড়িতে কাজের কথা বলে নেওয়া হয় প্রায় এক বছর আগে। কিছু দিন পর রাবেয়া বেগম আমাকে কাজ করার কথা বলে তার মেয়ে লুৎফা বেগমের শশুর বাড়ি কুমিল্লার লাকসামে নিয়ে যান । রমজান মাসের একদিন লুৎফা অপরিচিত চার জন যুবককে নিয়ে আসেন বাসায়। এ সময় তিনি এদের সাথে আমাকে অনৈতিক কাজ করার প্রস্তাব দেন, কিন্তু আমি এতে রাজি না হয়ে বাসা থেকে দৌড়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি। এসময় যুবকদের সহযোগীতায় লুৎফা আমাকে ধরে এনে শারিরিক নির্যাতন করেন, আমাকে নির্যাতন করার সময় তার মা রাবেয়া বেগম উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু তিনি কোন প্রকার বাধা দেননি। আমি অনেক কান্নাকাটি করেছি, আমাকে আমার বাবা-মার কাছে দিয়ে আসার জন্য, কিন্তু পরদিন সকালে রাবেয়া আমাকে ঘুমে রেখে বড়লেখায় চলে আসেন। এরপর গৃহবন্দি করে আমার উপর চলে অনেক নির্যাতন । নির্যাতনে গুরুতর আহত হলেও তারা আমাকে চিকিৎসা করায়নি। গত ২মাস পূর্বে কুমিল্লার লাকসামের বাসার পার্শ¦বর্তী লোকজন ঘটনা বুঝতে পারায় আমাকে গোপনে বড়লেখায় নিয়ে আসা হয়। বড়লেখায় নিয়ে আসার পরও আমাকে গৃহবন্দি করে নির্যাতন করা হয়।
অমানবিক নির্যাতনের শিকার নাজমার বরাত দিয়ে তার পিতা জানান, আমি দরিদ্র মানুষ। আমার মেয়েটিকে রাবেয়া বেগম ঝিয়ের কাজের কথা বলে প্রায় এক বছর পূর্বে তার বাড়িতে নিয়ে যান। কিন্তু কিছুদিন পর তিনি আমাদের না বলে মেয়েটিকে তার বিবাহিত মেয়ে লুৎফা বেগমের শ্বশুর বাড়িতে নিয়ে যান। আমার মেয়েকে বাসায় আটকে রেখে রুটি বানানোর বেলুন দিয়ে সেখানে পেটানো হতো। মেয়েটির একটি পায়ের পাতা ক্ষতবিক্ষত রয়েছে। ডাঃ বলেছেন একটি পা কেটে ফেলা হতে পারে। এছাড়া আমার মেয়েটির শরীরে অসংখ্য ক্ষত চিহ্ন রয়েছে নির্যাতনের। গত ৩ মাস থেকে আমার মেয়ের সাথে তারা কোন যোগাযোগ করতে দেয়নি।
আমরা যত বার ফোন দিয়েছি তারা বলেছেন, আমার মেয়েকে নাকি পাওয়া যাচ্ছে না। আমি ও আমার স্ত্রী ঈদের দিন তাদের বাড়িতে গেলে তারা আমার মেয়ের কথা অস্বীকার করে। কিন্তু আল্লাহর অশেষ মেহেরবানীতে বাড়ির মালিক আজির উদ্দিনের দেখানো মতে মেয়েকে এলাকাবাসীর সহায়তায় উদ্ধার করি। আমি এ ঘটনার ন্যায় বিচার কামনা করছি প্রশাসনের কাছে। বড়লেখা থানার অফিসার ইনচার্জ মোঃ মনিরুজ্জামান ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে জানান, অভিযোগ প্রাপ্তি সাপেক্ষে পুলিশ ঘটনার সাথে জড়িত একজনকে তাৎক্ষণিক গ্রেফতার করে নিয়ে আসে। মামলার অন্য আসামীদের গ্রেফতারে পুলিশের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। এছাড়া মামলার সুষ্ঠ তদন্তে পুলিশ কাজ করছে।