দেশের একমাত্র নৈশ উচ্চ বিদ্যালয়ের অস্তিত্ব হুমকিতে

Bhulanondo Night High Schoolসুরমা টাইমস ডেস্কঃ দেশের একমাত্র নৈশ উচ্চ বিদ্যালয় ভোলানন্দ। বর্তমানে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও পরিচিতি লাভ করেছে বিদ্যালয়টি। যেখানে সূর্য ডোবার পর শুরু হয় লেখাপড়া। সেখানে লেখাপড়া করেন শ্রমজীবী, গরীব ও ঝরে পড়া শিক্ষার্থীরা। আঁধারের এই ক্যাম্পাস থেকে আলোকিত হয়েছেন অনেকেই। তাই শ্রমজীবী ও ঝরে পড়াদের লেখাপড়া করার সুবিধার্থে এই বিদ্যালয়ে চারতলা বিশিষ্ট একটি নতুন ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। ইতোমধ্যে নতুন ভবনের উদ্বোধনও করেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত।
কিন্তু ওই স্কুলটির উপর নজর পড়েছে সিলেট সিটি করপোরেশনের। এটি এখন বাণিজ্যিকভাবে ভাড়া দেয়ার পাঁয়তারা শুরু করেছে সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ।
সিলেট সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা গেছে, ভোলানন্দ নৈশ উচ্চ বিদ্যালয়ের চারতলা বিশিষ্ট একটি ভবন নির্মাণের জন্য একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছিলেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। অর্থমন্ত্রীর বিশেষ বরাদ্দে ২০১২ সাল থেকে এই প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছিল। ১ কোটি ৯৪ লাখ ৪৩ হাজার ২শ ৮৫ টাকা ব্যায়ে বিদ্যালয়ে নতুন ভবন নির্মাণ করা হয়েছে।
বর্তমানে ৮ জন শিক্ষক বিদ্যালয়ের ২শ’ ৫০ জন শিক্ষার্থীকে পাঠদান করছেন। চলতি বছর অনুষ্ঠিত এসএসসি পরীক্ষায় ১৮ জন শিক্ষার্থী অংশ নিয়ে বিভিন্ন গ্রেডে ১৭ জন শিক্ষার্থী উত্তীর্ণ হয়। ভবনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অর্থমন্ত্রীর নিকট বিদ্যালয়ের উন্নয়নে ৭টি সুপারিশ করেন। এর একটি হলো উচ্চ মাধ্যমিক শাখা খোলা। অর্থমন্ত্রী এ বিষয়ে সহযোগিতারও আশ্বাস দেন। কিন্তু এমন আশ্বাস শোনার পরও সিটি করপোরেশন নির্বাহী কর্মকর্তা ও একজন কাউন্সিলরের নজর পড়ে নতুন ভবনটি উপর। অবশেষে তারা ওই ভবনটি ভাড়া দেয়ার উদ্যোগ নিয়েছেন বলে জানিয়েছে একাধিক সূত্র।
সূত্র মতে, নগরীর মিরবক্সটুলাস্থ ইউনিভার্সাল কলেজ ও অনন্য স্কুল অ্যান্ড কলেজ নামের দুটি প্রতিষ্ঠান নৈশ বিদ্যালয়টির নতুন ভবন ভাড়া নেয়ার জন্য সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষের কাছে পৃথকভাবে আবেদনও করেছে।
ইউনিভার্সাল কলেজের আবেদনে ওই কলেজে অধ্যক্ষ মুহাম্মদ কুদরতে এলাহীর স্বাক্ষর রয়েছে। এছাড়াও আবেদনটি সিটি করপোরেশনের মেয়র বরাবরে জমা দেয়া হয়েছে। আবেদনে কাউন্সিলর আব্দুল মুহিত জাবেদ ও শাহানারা বেগমের সুপারিশও রয়েছে। আবেদনপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে, আবেদনে নির্ধারিত মূল্যে ভাড়া প্রদান করে ভোলানন্দ নৈশ উচ্চ বিদ্যালয়ের ভবন দিবা ভাগে ইউনিভার্সাল কলেজ সিলেট এর একাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনা করার জন্যে অনুরোধ করা হয়।
অপর আবেদন করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার বরাবরে জমা দেয়া হয়েছে। অনন্য স্কুল অ্যান্ড কলেজ সিলেট’র (আইন, যোগাযোগ ও সামাজিক সম্পর্ক উন্নয়ন বিষয়ক) সমন্বয়কারী মো. আবু নোমান স্বাক্ষরিত আবেদনপত্রে বলা হয়েছে, ব্যতিক্রমী উদ্যোগ নিয়ে প্রতিষ্ঠা হতে যাচ্ছে অনন্য স্কুল অ্যান্ড কলেজ। এ স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রাথমিক পর্যায়ের দিবা ভাগের শিক্ষা কার্যক্রমের একটি ভেন্যু হিসেবে সিলেট সিটি কর্পোরেশন এর তত্ত্বাবধানাধীন চৌহাট্টাস্থ ভোলানন্দ নৈশ বিদ্যালয়ের অবকাঠামো বিধি মোতাবেক ব্যবহারে নিতে তাদের প্রতিষ্ঠান আগ্রহী।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গত মে মাসে সিটি করপোরেশনের শিক্ষা সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটির এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় ভোলানন্দ নৈশ উচ্চ বিদ্যালয়ে উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণি চালু করার ব্যাপারে সর্ব সম্মতভাবে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। স্থায়ী কমিটি উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণি চালুর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেও সিটি করপোরেশন দাপ্তরিকভাবে এর চূড়ান্ত অনুমোদন না দিয়ে ভাড়া দিতে প্রাণপণ চেষ্টা চালাচ্ছে। এ নিয়ে কাউন্সিলরদের মধ্যেও নান আলোচনা-সমালোচনা চলছে। অনেকের মতে নিজস্ব এই ভবনে উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণি চালু না করে ভাড়া দেয়া হবে ‘আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত।’
মঙ্গলবার সকাল ১১টায় দিকে বিষয়টি নিয়ে কথা হয় সিসিকের নির্বার্হী কর্মকর্তা এনামুল হাবীবের সঙ্গে। তখন তিনি এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘নগরীর মিরবক্সটুলাস্থ ইউনিভার্সাল কলেজ ও অনন্য স্কুল অ্যান্ড কলেজ নামের দুটি প্রতিষ্ঠান বিদ্যালয়টি ভাড়া নেয়ার জন্য আবেদন করেছে। তবে ভাড়া দেয়ার ব্যাপারটি এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ভাড়া দিলে যদি করপোরেশনের লাভ হয়- তাহলে ভাড়াতো দেয়া যেতে পারে। কিন্তু এ বিষয়ে একক সিদ্ধান্তের সুযোগ নেই। শিক্ষা কমিটির মতামতের পর ভূমি দাতাদের সঙ্গে আলোচনা করেই পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়া হবে।’
এদিকে, সিসিকের শিক্ষা সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটির সভাপতি রেজাউল হাসান লোদী কয়েস লোদী এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘গতকাল দুপুরে সিলেট সিটি করপোরেশন সভা কক্ষে আমাদের একটি সভা হয়েছে। ওই সভায় সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে, ভোলানন্দ নৈশ উচ্চ বিদ্যালয়ে কলেজ শাখা খোলা হবে।’
এই প্রতিষ্ঠানটি কোনভাবেই কাউকে ভাড়া দেয়া যাবে না জানিয়ে তিনি বলেন, ‘ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার সুযোগ করে দিতে ভোলানন্দ নৈশ উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এটাতো তাদের জন্যই থাকবে।’
যে ভাবে গড়ে উঠে প্রতিষ্ঠানটি: সিলেট নগরীর চৌহাট্টা এলাকায় ১৯৬৩ সালে ‘সিলেট নৈশ উচ্চ বিদ্যালয়’ নামে একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পরই ব্যবসায়ী, দোকান কর্মচারী, হকার, গাড়ি চালকসহ বিভিন্ন স্তরের শ্রমজীবীরা ভর্তি হন। শিক্ষা দিতে কিছু শিক্ষকও এগিয়ে আসেন।
পরে ১৯৬৪ সালে বিদ্যালয়টি একটি পূর্ণাঙ্গ উচ্চ বিদ্যালয় হিসেবে সরকারি অনুমোদন লাভ করে। এ সময় তৎকালীন জেলা প্রশাসক হাফেজ আহমদ ভোলানন্দ রাসকুঞ্জ সেবামন্ডবের সদস্যবৃন্দের কাছ থেকে ভোলানন্দ নামকরণের ও শুধুমাত্র স্কুলের কাজে ব্যবহারের শর্তে ২৯ শতক ভূমি সংগ্রহ করেন।
এরপর সিলেট নৈশ উচ্চ বিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তন করে ভোলানন্দ নৈশ উচ্চ বিদ্যালয় করা হয়। ১৯৭০ সালে ২৫ হাজার টাকা ও স্কুলের নিজস্ব তহবিলের টাকা দিয়ে স্কুল ভবন নির্মাণকাজ শুরু হয়। কিন্তু স্বাধীনতা লাভের পর স্কুলটি চরম আর্থিক সংকটে পড়ে। এছাড়াও যুদ্ধচালাকালে স্কুলের সকল রেকর্ড পত্রও নষ্ট হয়ে যায়।
এরপর পুনরায় যাত্র শুরু হলে ১৯৭৬ সালে বিদ্যুতিক আগুনে বিদ্যালয়ের রেকর্ড পত্র পুড়ে ফের সংকটে পড়ে। পরে নগরীর বন্দরবাজারস্থ দুর্গাকুমার পাঠশালায় সাময়িক পাঠদান শুর করা হয়। এরপর চাঁদা সংগ্রহ করে ভোলানন্দ নৈশ উচ্চ বিদ্যালয়ে একটি ভবন নির্মাণ করা হয়।
১৯৮২ সালে স্কুলটির শিক্ষকদের পৌরসভার স্টাফ হিসেবে অন্তর্ভূক্ত করে নিয়ম অনুযায়ী বেতন-ভাতা প্রদান করা হয়। এছাড়াও স্কুলে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের বেতন মওকুফ করে সম্পূর্ণ অবৈতনিক স্কুল হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
২০০২ সালে সিটি করপোরেশন হওয়ার পর স্কুলটি সিটি করপোরেশনের অধীনে চলে যায়। এর পর থেকে শিক্ষকদের বেতন-ভাতা কমানো হয়। বর্তমানে শিক্ষাকদের বেতন-ভাতা বাবত যা সম্মানী দেয়া হয় তা অতি সামান্য বলে এই প্রতিবেদককে জানিয়েছেন স্কুলের প্রধান শিক্ষক মো. আসাদ মিয়া।
তিনি জানান, ২০০২ সাল থেকে স্কুলে শিক্ষক সমস্যা ও ঘনঘন লোডশেডিংয়ের কারণে শ্রেণি কার্যক্রম ব্যাহত হয়। এ কারণেই শিক্ষার মান আশঙ্কাজনক ভাবে কমে যায়। পরে তৎকালীন সিসিক মেয়র বদর উদ্দিন আহমদ কামরানের সহযোগিতা ও উৎসাহে নতুন শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে শিক্ষার মানোন্নয়নের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। এর পর থেকে বিদ্যালয়টি ফের সফলতার দিকে এগিয়ে আসে।
তিনি আরো জানান, গত এসএসসি পরীক্ষায় স্কুল থেকে মোট ১৮ জন শিক্ষার্থী পরিক্ষায় অংশ নিয়ে ১৭ জনই উর্ত্তীন হয়েছেন।
প্রধান শিক্ষক গর্ব করে জানান, বাংলাদেশে এ ধরনের প্রতিষ্ঠান শুধুমাত্র একটি। বিদ্যালয়টি বর্তমানে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও পরিচিতি লাভ করেছে। ইতোমধ্যে বেশ কিছু আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান বিদ্যালয়ের প্রতি দৃষ্টিপাত করেছে। ব্রিটিশ হাইকমিশানর ও ব্রিটিশ কাউন্সিল বিদ্যালয়টিতে অনুদান দিচ্ছে বলে জানিয়েছেন তিনি।
সিটি করপোরেশনের শিক্ষা, সংস্কৃতি, পাঠাগার ও সমাজকল্যাণ কর্মকর্তা নেহার রঞ্জন পুরকায়স্থ এই প্রতিবেদককে বলেন, এবারের এসএসসি পরীক্ষায় সিলেট নগরীর ভোলানন্দ নৈশ বিদ্যালয় থেকে অংশ নেওয়া ১৮ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে ১৭ জন উত্তীর্ণ হওয়ায় ওই বিদ্যালয়ে উচ্চ মাধ্যমিক ক্লাশ চালুর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
এছাড়াও এই স্কুল থেকে লেখাপড়া করে কেউ কেউ শিক্ষক আবার কেউ সরকারি উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা হিসেবে কর্মকরত রয়েছে বলেও জানিয়েছেন নেহার।
ভোলানন্দ নৈশ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী আল আমীন এই প্রতিবেদককে জানান, তিনি ২০০৭ সালে ওই স্কুল থেকে এসএসসি পাশ করেছেন। এর পর তিনি সিলেট পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পান। সেখানে ডিপ্লোমা শেষ করে ওই প্রতিষ্ঠানেই তিনি লেকচারার হিসেবে যোগদান করেছেন।