রাজপথের আন্দোলনে নতুন নজির
সুরমা টাইমস ডেস্কঃ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা রাজপথের আন্দোলনে নজির সৃষ্টি করলো। গাড়ি ভাঙচুর ও ককটেলের বিস্ফোরণ ছাড়া রাজপথে যে আন্দোলন সফল হতে পারে বাংলাদেশের মানুষ তা প্রায় ভুলতে বসেছিল।
আমাদের দেশে আন্দোলন মানেই গাড়ি ভাঙচুর, রক্তাক্ত কিছু চিত্র, ককটেল বিস্ফোরণ, গুলি টিয়ার গ্যাসের সেল নিক্ষেপ আর ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া।
প্রায় এক সপ্তাহের টানা ছাত্র আন্দোলনের পর বাংলাদেশের গতানুগতিক আন্দোলনের সেই গদবাঁধা চিত্রই দৃশ্যত পাল্টে গেল।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ বলেছেন, ‘ছাত্রদের আন্দোলনের প্রক্রিয়া এক কথায় অসাধারণ। তাদের দেখানো পথটা আমাদের চেনা থাকল। আন্দোলন করতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলে মেয়েদের মতো আঘাত দেওয়ার, আগুন দেওয়ার দরকার নাই।’
রাজপথে দখল করে গড়ে তোলা শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের পর সোমবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাদের দাবি মেনে নেন। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের টিউশন ফির ওপর ভ্যাট আরোপ কতটা যৌক্তিক তা নিয়ে বিতর্ক থাকতেই পারে। কিন্তু তাদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের প্রতি সবার যে সমর্থন ছিল তা বলা যায় এক কথায়। আন্দোলনকারীদের পক্ষে তাই কথা বলতে দেখা গেছে ক্ষমতাসীন দলের অনেক নেতাকেই।
এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ সোমবার এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘সহিংসতা ছাড়া যে রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করা যায়, সম্ভবত সেটা আমরা ভুলেই গেছি। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা তাদের এ আন্দোলনে প্রমাণ করেছে সহিংসতা ছাড়াও আন্দোলন হয়। সেটাতে দাবিও আদায় হয়।’
তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক কর্মসূচিতে সরকারকে চাপে ফেলার জন্য সহিংসতা করা হয়। কিন্তু আমি মনে করি এ আন্দোলনে কোন রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা ছিল না। ছাত্র-ছাত্রীরা তাদের নিজের প্রয়োজনের তাগিদেই স্বতঃস্ফূর্তভাবে এ আন্দোলন করেছে। এটি আমাদের জন্য একটি ইতিবাচক দিক।
রাজপথে আন্দোলনকারীরা কারো উস্কানির মুখেও পথচ্যুত হয়নি। তাদের ওপর যে সন্ত্রাসী হামলা হয়নি তা নয়। রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে বিচ্ছিন্নভাবে আন্দোলনকারীদের ওপর হামলার কিছু দৃষ্টান্ত থাকলেও উস্কানির মুখে তারা সহিংসতার পথে হাটেননি।
রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ছাত্র-ছাত্রীরা আন্দোলন করলেও কোনো গাড়িতে ঢিল ছুড়তে দেখা যায়নি।
দীর্ঘ যানজটে আটকে থাকা সাধারণ পথচারিদের ছাত্র-ছাত্রীদের সহানুভূতিও সাধারণ মানুষের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়েছে। যানজটে আটকে থাকা রোগীবাহী অ্যাম্বুলেন্সগুলো ছেড়ে দেয়ার বিষয়টি মানুষের সহানুভূতি কেড়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক গোবিন্দ চক্রবর্তী এই প্রতিবেদককে বলেন, এই আন্দোলনে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের সম্পর্কে আমাদের বদ্ধমূল ধারণা পাল্টে গেছে। মানুষ আগে মনে করতো তারা সংগঠিত না। আন্দোলন করে তারা কোন দাবি আদায় করতে পারবে না।
তিনি আরও বলেন, এ আন্দোলনে আরেকটি ইতিবাচক দিক হলো এর মাধ্যমে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের অহিংস আন্দোলনের মাধ্যমে অধিকার আদায়ের বোধ তৈরি হয়েছে। যা আমাদের দেশের জন্য ইতিবাচক একটি দিক।
গোবিন্দ চক্রবর্তী বলেন, এ আন্দোলন অহিংস হওয়ার জন্য আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। কারণ তিনি প্রথম থেকে মনে করেছেন এ বিষয়টা সমাধান করবে অর্থমন্ত্রণালয়। তার দায়িত্ব ছিল সকলের নিরাপত্তা দেয়া তিনি সেটাই করেছেন।
ঢাবির এই অধ্যাপক বলেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনের সঙ্গে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনকে মিলালে হবে না। কারণ প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় আন্দোলন স্বল্প পরিসরে ভ্যাট প্রত্যাহারের। সরকারবিরোধী কিংবা সরকার পতনের কোন আন্দোলন নয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা সরকারবিরোধী আন্দোলন করে। সেক্ষেত্রে প্রশাসনও সে আন্দোলনে ছাড় দেয় না। কঠোর হস্তে দমন করে।
এ বিষয়ে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসাইন বলেন, এ আন্দোলনের শুরু থেকেই আমাদের সম্পৃক্তা ছিল। প্রত্যেকটা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসমাবেশে আমাদের প্রতিনিধিরা ছিল। তারা সবসময় তাদের নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করেছেন। অন্যদিকে আমাদের সভাপতি ও আমি তাদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রেখেছিলাম। এ কারণে এ আন্দোলন ছিল অহিংস।
সংগঠনটির সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগ এ প্রসঙ্গে বলেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের দাবির বিষয়ে আমরা শুরু থেকে তাদের সঙ্গে ছিলাম। বিষয়টি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে একাধিকবার দেখাও করেছি।
শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে স্বাগত জানিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘শিক্ষাকে পণ্য হিসাব করে ভ্যাট ধার্য করা হয়েছিল। আন্দোলনের মাধ্যমে প্রতিবাদ করে দাবি আদায় করায় আমি শিক্ষার্থীদের অভিনন্দন জানাই। আমি মনে করি আন্দোলন এভাবেই হওয়া উচিত। সেক্ষেত্রে সরকার ও বিরোধীদলের সহনশীলতা এবং মানসিকতার পরিবর্তন দরকার। তাহলেই এটা সম্ভব।’
এ ব্যাপারে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা শামসুজ্জামান দুদু বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলন থেকে আমাদের অবশ্যই শেখার আছে। তবে সরকার শিক্ষার্থীদের আন্দোলন দমাতে চায়নি বলে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন শান্তিপূর্ণ রেখেছে। কারণ সরকারের আচরণের ওপর ভিত্তি করে আন্দোলনের গতি প্রকৃতির পরিবর্তন হয়।’
সরকারকে স্বাগত জানিয়ে তিনি বলেন, ‘একই মানসিকতা নিয়ে সরকার যদি একটি সুষ্ঠু, অবাধ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন দেয় তাহলে তা দেশ, জাতি ও আওয়ামী লীগের জন্যও কল্যাণকর হবে।’