ড. কামালের ১১ দফা ঘোষণা

Dr. Kamalসুরমা টাইমস ডেস্ক: অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য ১১ দফা সংবলিত ‘জাতীয় ঐক্যের সনদ’ ঘোষণা করেছেন গণফোরাম সভাপতি ও সংবিধানপ্রণেতা ড. কামাল হোসেন। ১১ দফা বাস্তবায়নে তিনি এবার ঝুঁকিও নেবেন বলে সংবাদ সম্মেলন থেকে ঘোষণা দেন।
জাতীয় প্রেস ক্লাবের কনফারেন্স লাউঞ্জে রোববার বিকেলে গণফোরাম আয়োজিত সংবাদ সম্মেলন থেকে এ ঘোষণা দেন তিনি।
ড. কামাল বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে ১১ দফার জাতীয় ঐক্যের এই সনদ। এটি বাস্তবায়নে জাতীয় ঐক্যের বিকল্প নেই। এই ঐক্যের প্রক্রিয়া জোরদার করতে হবে। বাঁধা আসলে তা সম্মিলিতভাবে মোকাবেলা করতে হবে।’
আপনি তো ঐক্যের ঘোষণা দিয়ে বিদেশে চলে যান, এবারও সেরকম হবে কি না— এমন প্রশ্নের উত্তরে ড. কামাল বলেন, ‘ঝুঁকিতো আমি সারাজীবন নিয়েছি। এবার ১১ দফা জোরদার করতেও আমি ঝুঁকি নিব।’
কোন পদ্ধতিতে নতুন নির্বাচন চান— এমন প্রশ্নের উত্তরে কামাল হোসেন বলেন, ‘জনগণকে কাছে যাব। তারা যেভাবে বলবে, সেভাবেই নির্বাচন হবে।’
সনদ কিভাবে বাস্তবায়ন করবেন— এমন প্রশ্নের উত্তরে বলেন, ‘১১ দফা নিয়ে আমরা জনগণের কাছে যাব। গণসংযোগ, গণজাগরণ ও জাতীয় ঐক্য গড়ব। জনগণ যে পদ্ধতিতে বলবে সেই পদ্ধতিতে নির্বাচন হবে।’
কামাল হোসেন বলেন, ‘সবাইকে আহ্বান জানাই, দেশের রোগ চিহ্নিত করেছি। মা যদি অসুস্থ হয়, যোগ্য সন্তান তা গোপন করবে না। যেসব বিষয় নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন সেগুলো রোগ।’
কামাল হোসেন সাংবাদিকদের প্রশ্ন রেখে বলেন, ‘মানুষ পিটিয়ে মারা রোগ কি না? নিজেই উত্তরে বলেন, অবশ্যই রোগ। এরপর তিনি বলেন, ঐক্যবদ্ধভাবে আমরা আমাদের মাকে রোগমুক্ত দেখতে চাই। রোগকে অস্বীকার করলে হবে না। এ জন্য কার্যকরভাবে আমাদের কাজ করতে হবে।’
তিনি সংবাদপত্রের বর্তমান অবস্থা তুলে ধরে বলেন, ‘দেশে এখন মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নেই। সংবাদপত্রের মালিকরা এ জন্য আজ বিবৃতিও দিয়েছে।’
আপনি মত প্রকাশের জন্য কখনো বাঁধাগ্রস্ত হয়েছেন কি না— জানতে চাইলে ড. কামাল বলেন, ‘মাস দু-এক আগে আমরা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু অনুমতি পাইনি। এ জন্য তিনবার হাইকোর্টে রিট পিটিশন করতে হয়েছে। এরপরও আমাদের সভা-সমাবেশের অনুমতি দেওয়া হয়নি।’
গ্যাস ও বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে কামাল হোসেন বলেন, ‘ধরে নিচ্ছি আপনি নির্বাচিত। তাই বলে আপনি যা খুশি করতে পারেন না। হঠাৎ করে মনে হলো দাম বাড়াবেন, আর বাড়ালেন। এটা হতে পারে না।’
তিনি সরকারের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন রেখে বলেন, ‘তোমরা দাবি কর, তোমরা আমাদের প্রতিনিধি। তোমরা কিভাবে আমাদের প্রতিনিধি হলে? তোমরা না কী আদিষ্ট হয়ে নীতিনির্ধারণ কর, আইন পাস কর। কার আদেশ তোমরা পালন করছ?’
ড. কামাল বলেন, ‘দেশের মালিক আমরা। মালিক হয়েও আমরা অসহায়, নিষ্ক্রিয়। মালিক হয়ে এখন আমাদের চিন্তা করতে হবে, আমরা কি আমাদের বাবা-মার সম্পত্তি হারাব? না কি মালিকানা রক্ষার জন্য যা কিছু করা দরকার, তাই করব।’
তিনি সংবাদ সম্মেলনের শেষে বলেন, ‘আমাদের মূল কথা হলো- ঐক্যমত গড়ে তুলতে চাই। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে যে ঐক্য হয়েছিল সেই ঐক্যের কথাই তুলে ধরতে চাই। মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন কি ছিল? স্বপ্ন ও বাস্তবতার মধ্যে পার্থক্য কতটুকু? যারা স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন, তারা সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করতে পেরেছিলেন, অসম্ভবকে সম্ভব করেছিলেন। আমরা হতাশ হতে পারি না। যে পরিস্থিতি এসেছে আমরা তা মোকাবেলা করেছি। এবারও করব।’
সংবাদ সম্মেলন উপস্থিত ছিলেন ডাকসুর সাবেক ভিপি সুলতান মোহাম্মদ মনসুর, গণফোরামের নির্বাহী সভাপতি সুব্রত চৌধুরী, ঢাকা বারের সাবেক সভাপতি এ্যাডভোকেট আলতাব হোসেন, সুপ্রীম কোর্ট বার এসোসিয়েশনের সাবেক সহ-সভাপতি জগলুল হায়দার, ফরোয়ার্ড পার্টির সভাপতি আ ব ম মোস্তফা আমিন, গণফোরামের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক আ ম শফিউল্লাহ, সাংগঠনিক সম্পাদক মোশতাক আহমেদ, কেন্দ্রীয় নেতা রফিকুল ইসলাম পথিক প্রমুখ।
ড. কামাল হোসেনের জাতীয় ঐক্যের সনদে যা আছে-
১. সমগ্র জাতি আজ একটি অর্থপূর্ণ পরিবর্তনের জন্য উন্মুখ। যে পরিবর্তনের মাধ্যমে জনগণের জানমালের নিরাপত্তা, সমাজের শান্তি ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করবে। জাতীয় ঐক্য ও জনগণের ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের স্বাধীনতা নিশ্চিত করেছে যে জনগণ, তারাই ক্ষমতার মালিক। জনগণ সে ক্ষমতা প্রয়োগ করবে নিজেদের নির্বাচিত প্রতিনিধির মাধ্যমে।
২. কেবল মাত্র কালো টাকা, সন্ত্রাস ও সশস্ত্র ক্যাডারমুক্ত অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমেই জনগন সৎ, যোগ্য ও কার্যকর জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত করতে পারে।
৩. অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনই হচ্ছে গণতন্ত্রের প্রথম পদক্ষেপ। কার্যকর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজন গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান সমূহকে যথাযথভাবে পরিচালনা করা এবং গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি সচেতনভাবে লালন করা।
৪. বহু দলীয় গণতন্ত্রে রাজনৈতিক দলগুলোকে অবশ্যই দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে জাতীয় ও জনস্বার্থে কাজ করতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোকে অবশ্যই জাতীয় লক্ষ্য সমূহ অর্জনের জন্য পারস্পরিক শ্রদ্ধা, সম্মান ও সহিষ্ণুতা প্রদর্শন করতে হবে।
৫. রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মের অপব্যবহারের মাধ্যমে চরমপন্থা, অসহিষ্ণুতা, সন্ত্রাসবাদ ও বৈষম্যমূলক আচরণের কোনো স্থান আমাদের সমাজে অবশ্যই থাকবে না।
৬. সংবিধান অনুযায়ী আইনের প্রতি অনুগত থেকে জনপ্রশাসন ও পুলিশ বাহিনীকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হয়ে নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করতে হবে। যথেচ্ছা গ্রেফতার, বিনা বিচারে আটক, আটক অবস্থায় নির্যাতন ও অমানবিক আচারণ বাংলাদেশ সংবিধান অনুমোদন করে না।
৭. সংবিধান কর্তৃক স্বীকৃত এবং আন্তর্জাতিক সনদ অনুযায়ী সুরক্ষিত মানবাধিকারের প্রতি অবশ্যই সকলকে সম্মান প্রদর্শন করতে হবে এবং এর যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।
৮. শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে দলীয় রাজনীতির নেতিবাচক প্রভাব ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড অবশ্যই মুক্ত রাখতে হবে এবং শিক্ষার পরিবেশ, একাডেমিক মর্যাদা ও স্বকীয়তা বজায় রাখতে হবে। শিক্ষার মান উন্নয়নে অনুষদগুলোর শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী নিয়োগ ও পদন্নতি এবং ছাত্র ভর্তি ও ছাত্রের মান নির্ধারণে দলীয় বিবেচনার পরিবর্তে মেধা ও যোগ্যতাকে বিবেচনা করতে হবে।
৯. রাষ্ট্রের সকল পর্যায়ে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে এবং নির্বাহী বিভাগের যেকোনো প্রভাব থেকে মুক্ত ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।
১০. সকলের জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। রাষ্ট্রীয়ভাবে সমাজ ও পরিবার সমূহের মধ্যকার বৈষম্যসমূহ দূর করার লক্ষ্যে সকল জনগণের জন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান ও জীবিকা নির্বাহের সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। এতে সমাজ থেকে শুধু দারিদ্র্যতাই দূর হবে না; বরং নতুন ইতিহাস সৃষ্টি হবে।
১১. জাতীয় অর্থনীতির উন্নয়নের স্বার্থে কৃষক-শ্রমিকসহ সমাজের সকল মানুষের জীবন মানের উন্নয়ন ঘটাতে হবে। অর্থনৈতিক উন্নয়নে এমন নীতি কৌশল গ্রহণ করতে হবে, যেন জাতীয় সম্পদ ও মানব সম্পদকে সমন্বিত করে জাতীয় অর্থনীতিতে সর্বোচ্চ সাফল্য অর্জন করা যায়। দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গঠনে দেশী ও বিদেশী বিনিয়োগকারীদের উৎসাহিত করার লক্ষ্যে এমন নীতি কৌশল গ্রহণ করা আবশ্যক।