সন্ধ্যা হলেই পাল্টে যায় শাবির শহীদ মিনারের চিত্র
মেহেদী কবীরঃ একটি-দুটি নয়, গুনে গুনে ৯৯টি সিঁড়ি পাড়ি দিয়ে চূড়ায় উঠতেই আপনার ক্লান্ত চোখ ছানাবড়া হয়ে যাবে। এতো উঁচুতে গাছও পাখিদের ভীড়ে আবার এতো সুন্দর শহীদ মিনার আসলো কোথা থেকে। দৃশ্যটি সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনারের।
শাবির সকল শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের জন্য গর্ব এ শহীদ মিনার। পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আগত দর্শনার্থীদের আকর্ষনের কেন্দ্রবিন্দু এ শহীদ মিনারটি। সবুজ টিলা আর সারি সারি আকাশমনি, শিশুসহ নানা বৃক্ষের সমারোহে মাথা উঁচু করে দাড়িয়ে আছে দেশের সবোর্চ্চ স্থানে অবস্থিত আকর্ষনীয় এ শহীদ মিনারটি। তাই এ শহীদ মিনারকে ঘিরে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীসহ দর্শনার্থীদের চলে নিয়মিত আড্ডা, গান, কবিতা আবার কখনও কখনও এটি সাংস্কৃতিক চর্চার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠে।
২০০১ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর প্রায় ৩৩ লাখ টাকা ব্যয়ে শহীদ মিনারটি নির্মাণ করা হয়। ভাষা শহীদদের সম্মানের কথা বিবেচনা করে বিশ্ববিদ্যালয়ের উঁচু একটি টিলায় ওই বছর ১২ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন স্পীকার হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী এর ভিত্তি প্রস্থর স্থাপন করেন। শহীদ মিনারটি ৫৮ ফুট উচ্চতাবিশিষ্ট একটি টিলায় ৬হাজার ৮শ ৮৬ বর্গফুট জায়গা নিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে। মাটি থেকে শহীদ মিনারটির মোট উচ্চতা সাড়ে ৭৮ ফুট। এর ৯৯টি স্টেপ রয়েছে যা ৩টা ফ্লাইটে বিভক্ত। আবার মূল স্তম্বটি আরো ৭টি সিড়ির উপরে অবস্থিত।
বিষয়টা এ পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকলেই ভালো হতো। কিন্তু তা নয়। শহীদ মিনারটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকসহ দর্শনার্থীদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হলেও এর মান মর্যাদা রক্ষার ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নেই কোন উদ্যোগ। নির্দিষ্ট কোন দিবস ছাড়া শহীদ মিনারটির দিকে নজর দেয়না বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। সংস্কারের অভাবে শহীদ মিনারটির একপাশ ফেটে গিয়েছে। গাছ-গাছালি বেষ্টিত হওয়ায় পাতা,ঢাল পড়ে পচে পচে নষ্ট হচ্ছে মিনারের স্বাভাবিক সৌন্দর্য। টিলা বেষ্টিত শহীদ মিনারটি মূল ক্যাম্পাস থেকে ভিতরে হওয়ায় কুকুর-বিড়াল আর সাপ-শেয়ালের আস্তানা পরিনত হয়েছে। এ শহীদ মিনারকে ঘিরেই সম্প্রতি সংঘটিত হচ্ছে নানা অসামাজিক কর্মকান্ড। আধাঁর ঘনিয়ে আসার সাথে সাথেই নেশাখোরদের আড্ডাস্থলে পরিণত হয় এ শহীদ মিনারটি। মাঝে সাঝে আপত্তিকর অবস্থায় পাওয়া যায় মানুষজনকে। দেশের অন্যতম নয়নাভিরাম এ স্থানটি এখন হয়ে গেছে কপোত-কপোতীদের মনোরঞ্জনের স্থান। অথচ মিনারে উঠার পথে ‘সূর্যাস্তের পর শহীদ মিনার এলাকায় অবস্থান নিষেধ’ কথাটি লাগিয়ে দিয়েই নিজেদের দায়িত্ব শেষ করে দিয়েছে বিশ^বিদ্যালয় প্রশাসন। নেই কোন গার্ড। যার ফলে ছিনতাই ও অনৈতিক কাজগুলো হচ্ছে হরহামেশাই। দেশের অন্যতম বৃহৎ এ বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন সীমানা প্রাচীর না থাকায় ছিনতাইকারীরা সহজেই ছিনতাই করে পালিয়ে যায়। অনেকেই দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে পরিবার নিয়ে এখানে ঘুরতে এসে পড়ছে অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতিতে। এ সুযোগটাই কাজে লাগাচ্ছে সিলেট শহরের স্কুল-কলেজ পড়–য়া শিক্ষার্থীরা। সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, স্কুল-কলেজ ফাঁকি দিয়ে অনেক শিক্ষার্থী এখানে অনৈতিক কাজে সময় ব্যয় করছে।
শুধু শহীদ মিনার নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মিলনায়তন এবং নবনির্মিত আইসিটি ভবনের পেছনটাও হয়ে দাড়িয়েছে প্রেমিক-প্রেমিকাদের অনৈতিক কর্মকান্ডের নির্ভরযোগ্য স্পট। তবে এ নিয়ে প্রশাসনের কোন মাথাব্যথা নাই বললেই চলে। মাঝে মাঝে নামমাত্র দুই একটি অভিযান ছাড়া চিরস্থায়ী কোন পদক্ষেপ নেয়া হয়নি।
এ কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে এমনটিই মনে করছে শিক্ষার্থীরা। অনেকেই ক্ষোভ ঝাড়ছেন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের উপর। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কর্তৃক বহিরাগতদের ক্যাম্পাসে অবাধে প্রবেশের ব্যাপারে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া উচিত বলে মনে করেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১২-১৩ ব্যাচের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষার্থী বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা এসেছি এখান থেকে শিক্ষা নিতে। কিন্তু আমাদের অবস্থা এখন হয়ে গেছে ক্লাসরুম এবং হলের বাইরে কোথাও যেতে পারি না। বিশ্ববিদ্যালয়ের মত একটি মুক্ত অঙ্গণে এরকম কর্মকান্ড সত্যিই দুঃখজনক। এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনীয় স্থানগুলোতে আপত্তিকর চলাফেরায় হতাশ বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্শ্ববর্তী আবাসিক এলাকার বাসিন্দারা। তাদের দাবি এমন অশ্লীল কর্মকান্ড অত্র এলাকার তরুণ-তরুনীদের ওপর বিরুপ প্রভাব ফেলছে।
শাবি প্রক্টর অধ্যাপক ড. কামরুজ্জামান চৌধুরী জানান, পরিস্থিতি ঠিক রাখতে দিনের বেলা এমনকি সন্ধ্যার পর আমরা প্রায়ই টহল দিই। শহীদ মিনারের নিরাপত্তার জন্য অচিরেই লাইটিং ও সার্বক্ষণিক নিরাপত্তা রক্ষীর ব্যাবস্থা করা হবে। আমরা এ ব্যপারে কথা বলেছি। আর এখানে লাইট দিলে সন্ধ্যার পর অবস্থানের বিষয়টা আরো জোরদার হবে। আশা করি খুব তাড়াতাড়ি আমরা সমাধানে চলে আসবো।’ বহিরাগত কর্তৃক ছুটির দিনগুলোতে ইভটিজিং এর বিষয়ে তিনি বলেন, এটা অনেক মারাত্মক একটা ইস্যু। আমরা এ ধরনের কোন অভিযোগ পেলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা এবং পুলিশের হাতে তুলে দিব।
তবে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার মহৎ দায়িত্ব পালন করা এই শিক্ষকের এই আশ্বাস খুব শীঘ্রই কার্যকর হবে এমনটিই প্রত্যাশা শাবি সহ শুভাকাঙ্খী সকলেরই।