হাজার কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন থেকে দেশ বঞ্চিত হচ্ছে

শাইখুল হাদিস আল্লামা আব্দুল কুদ্দুছঃ ময়লা অপসারণ, রাস্তা ঝাড়– দেয়া, সারফেস ড্রেন পরিষ্কার, ডিসিসি’র স্টর্ম স্যুয়ারেজ পরিষ্কার, বিউটিফিকেশন ও বিজ্ঞাপন সেল, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ড স্থাপনের কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করা ডিসিসি’র বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের অন্যতম প্রধান কাজ। অথচ অব্যবস্থাপনার কবলে ধুঁকছে ঢাকা সিটির বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম। দুর্গন্ধ আর ময়লা-আবর্জনায় কদর্যময় হয়ে পড়েছে নগরীর বেশির ভাগ এলাকা। জনবল সঙ্কট ও আন্তঃবিভাগ সমন¦য়হীনতার কারণে নগর বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম শক্তিশালী হচ্ছে না বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন এলাকার ৯০টি ওয়ার্ডে প্রায় ৮ হাজার পরিছন্নতাকর্মী কাজ করছে। দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন এলাকার নতুন দুটি ওয়ার্ডে এখনো কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে না। জনবল-স¦ল্পতায় সঠিকভাবে মনিটর হচ্ছে না ওয়ার্ড পর্যায়ের পরিদর্শকদের কাজ। ফলে পরিছন্নতাকর্মীরা ফাঁকি দিচ্ছে কর্মঘণ্টা। জানা গেছে, একজন পরিছন্নতাকর্মীর দৈনিক ৮ ঘণ্টা কাজ করার কথা থাকলেও এদের বেশির ভাগই তিন-চার ঘণ্টার বেশি কাজ করে না। ডিসিসি’র ৪০০ বর্জ্য অপসারণ ট্রাক রয়েছে। এসব গাড়ি চালানোর জন্য আছে ৩০০ চালক (ড্রাইভার)। মনিটরিংয়ের অভাব ও সমন¦য়হীনতার কারণে চালকরাও সঠিকভাবে কাজ করছে না। এদের ট্রিপ ফাঁকির প্রমাণ পেয়েছে ডিসিসি প্রশাসন। তবে এ চক্রটি অত্যন্ত শক্তিশালী হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছে না ডিসিসি।
জনবল কাঠামোয় পরিছন্নতা কর্মীদের পরিচালনার জন্য ২২টি প্রথম শ্রেণীর পদসহ ৪৪১টি পদ রয়েছে। প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ছাড়া এর ২১টি পদই খালি। অন্য ১৩০টি পদ শূন্য। ফলে বিশাল এ জনবল ঘাটতি নিয়ে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার নানা আয়োজন থাকলেও ফলাফল শূন্য। বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের হিসাবমতে, প্রতিদিন ৪ হাজার ২০০ টন বর্জ্য উৎপন্ন হচ্ছে। এর ৮০ ভাগ তারা অপসারণ করতে পারছে। বাকি ময়লা-আর্বজনা দিয়ে নদী-খাল-বিল ও ডোবা-নালা ভরাট হচ্ছে।
মূলত, দক্ষ বর্জ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে পর্যাপ্ত বরাদ্দ রাখা হলেও ঢাকা সিটি কর্পোরেশন (ডিসিসি) চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে। কাজেই ডিসিসি’র প্রতিদিনের ব্যর্থতাকে প্রচার না করে শুধুমাত্র কুরবানীর সময় অক্ষমতাকে বড় করে দেখানো কুরবানীবিরোধী মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ।
পবিত্র ঈদুল আযহা উনার দিনে পশু কুরবানী করার কারণে বিপুল পরিমাণ বর্জ্য সৃষ্টি হওয়া নতুন কিছু নয়। পশুর হাট বসা থেকে পশু কুরবানী করা পর্যন্ত রাজধানীতে বর্জ্য জমতে থাকে। এর সাথে ঘর-গৃহস্থালীর আবর্জনা যুক্ত হয়ে স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় অনেক বেশি বর্জ্য সৃষ্টি হয়। বিষয়টি সিটি কর্পোরেশনের সংশ্লিষ্ট বিভাগের অজানা থাকার কথা নয়। এ অবস্থায় নগরীকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য সিটি কর্পোরেশনের বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করা অপরিহার্য। সিটি কর্পোরেশনের কর্মকর্তারা মুখে বর্জ্য অপসারণে বিশেষ ব্যবস্থার কথা বললেও বাস্তবে তার প্রয়োগ অনেকটাই দায়সারা গোছের। প্রতিবারই পবিত্র ঈদুল আযহা উনার সময়ে তা পরিলক্ষিত হয়েছে।
এখানে উল্লেখ্য যে, পবিত্র ঈদুল আযহা উপলক্ষে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় পশুর হাট ইজারার মাধ্যমে সিটি কর্পোরেশনের সবচেয়ে বড় আয় হয়। কিন্তু সিটি কর্পোরেশন আয় করলেও তার সুফল নগরবাসী পায়নি। পবিত্র কুরবানী করার পর দ্রুততম সময়ে পশু বর্জ্য অপসারণে নগরবাসীর কাম্য হলেও উত্তর ও দক্ষিণ উভয় সিটি কর্পোরেশন তা যথাযথভাবে করে না। এক্ষেত্রে সমন্বিত ও কার্যকর পরিকল্পনার অভাব থাকে। পবিত্র ঈদ উনার আগে বন্ধ থাকা ড্রেন পরিষ্কারের উদ্যোগ নেয়া অপরিহার্য। এতে পবিত্র কুরবানী উনার পশুর রক্ত ড্রেনের মাধ্যমে দ্রুত নিষ্কাশিত হতে পারে। পবিত্র ঈদ উনার আগের দিন পশুর হাটও অনেকটা খালি হয়ে যায়। সে সময় হাটগুলো পরিষ্কারের উদ্যোগ নেয়া হলে বর্জ্য অপসারণের কাজ অনেকটাই এগিয়ে যায়। দেখা যায়, পবিত্র কুরবানী উনার পর দীর্ঘ সময় পার হয়ে গেলেও বর্জ্য অপসারণ শুরু হয় না। যখন পরিবেশ ভারী হয়ে উঠে, তখন অপসারণ শুরু হয়। তবে উল্লেখ থাকে যে, কুরবানীর পশুর বর্জ্য অন্যান্য বর্জ্যরে মতো নয়। বরং অনেক বেশি মূল্যবান। সুবহানাল্লাহ!
এক্ষেত্রে সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে যদি শুধুমাত্র যথাযথ প্রচারণা চালানো হয়, তাহলে একদিকে যেমন সংশ্লিষ্ট নাগরিকদের স্বতঃস্ফূর্ত তৎপরতায় সহজেই বর্জ্য অপসারিত হবে, তেমনি এর মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা বৈদেশিক মুদ্রাও অর্জিত হবে।
মূলত, পবিত্র কুরবানী উনার পশুর উচ্ছিষ্টের গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনতার অভাবে দেশ শত শত কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। সাধারণের অনেকেই জানে না গরু ও খাসীর উচ্ছিষ্ট কী এবং এসব উচ্ছিষ্ট কী কী কাজে লাগে।
উল্লেখ্য, পবিত্র কুরবানী উনার পশুর চামড়া, হাঁড়, শিং, নাড়িভুঁড়ি, রক্ত, চর্বি, পিত্ত বা চামড়ার উচ্ছিষ্ট অংশ- এসব উচ্ছিষ্টের শতভাগ রফতানীযোগ্য। সাধারণ মানুষ রফতানীযোগ্য এসব উচ্ছিষ্ট সম্পর্কে সচেতন না থাকার কারণে শত শত কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন থেকে দেশ বঞ্চিত হচ্ছে। বাংলাদেশ হারাচ্ছে রফতানী বাজার।
জানা যায়, পবিত্র কুরবানীর পশুর হাড় দিয়ে তৈরি হয় জীবনরক্ষাকারী ওষুধ ক্যাপসুলের কভার, নাড়ি দিয়ে অপারেশনের সুতা, রক্ত দিয়ে পাখির খাদ্য, চর্বি দিয়ে সাবান, পায়ের খুর দিয়ে বিভিন্ন প্রকার ক্লিপ ইত্যাদি। অর্থাৎ গরু-খাসীর সব অংশই মানুষের কোনো না কোনো কাজে ব্যবহৃত হয়। সুবহানাল্লাহ!
পশু জবাইয়ের পর একটি মাঝারি আকারের গরু থেকে ১৫ থেকে ২০ কেজি হাড় ফেলে দেয়া হয়। আর এই হাড় সংগ্রহ করে প্রতিদিন ব্যবসা হয় অন্তত ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকা। নাড়িভুঁড়ি বিক্রি হয় আরো অন্ততঃ ১২ লাখ টাকার। ব্যবসায়ীরা জানান, হাড়গোড় দিয়ে ওষুধ, বোতাম আর ঘর সাজানোর নানা উপকরণ তৈরি হয়। এছাড়া নানা দেশেই খাদ্য হিসেবে ব্যবহার হয় নাড়িভুঁড়ি।
জানা গেছে, প্রতি বছর পবিত্র কুরবানীর ঈদে পবিত্র কুরবানী হয় এক কোটিরও বেশি গরু ছাগল মহিষ ভেড়া। এর মধ্যে গরু কুরবানী হয় প্রায় ৭০ লাখ। এসবের উচ্ছিষ্ট বিক্রি করে হাজার কোটি টাকারও বেশি আয় করা সম্ভব।
রফতানীযোগ্য পশুর বর্জ্য রক্ষার জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে বারবার আবেদন করা হয়েছে। কিন্তু তারপরেও সরকারের পক্ষ থেকে কোনো সাড়া দেয়া হয়নি। অথচ মন্ত্রণালয়ের কিছু অসৎ কর্মকর্তা এ বিষয়ে সভা সেমিনারের নামে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, জীবন বাঁচাতে ও জীবন সাজাতে পশুর বর্জ্য সহায়ক। তাই পশুর বর্জ্য ও তার কার্যকারিতা সম্পর্কে সবাইকে জানতে হবে। এ বিষয়ে মিডিয়া ও সরকার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করতে পারে।
উল্লেখ্য, সিটি কর্পোরেশনের কেবল মুখের কথায় সাফল্য দাবি করলে হবে না, অবিলম্বে রাজধানীকে বর্জ্যমুক্ত করে এবং পবিত্র কুরবানীর পশুর বর্জ্যের যথাযথ ব্যবহার তথা হাজার কোটি টাকার বর্জ্য রফতানী করে নগরবাসীর জন্য স্বস্তির পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। একথা ভুলে গেলে চলবে না, নগরবাসীর ট্যাক্সের অর্থে সিটি কর্পোরেশন চলে। সুতরাং নাগরিকরা প্রাপ্য সেবা থেকে বঞ্চিত হবে, তা হতে পারে না। এসব দায়িত্ব ও সচেতনতা তখনই অর্জিত হবে, যখন যথাযথ সম্মানিত ইসলামী মূল্যবোধ জাগরূক থাকবে।