আলী হত্যাকান্ড : ‘ট্যাপের পানি বেরোনোর মতো রক্ত ঝরছিলো’
সুরমা টাইমস ডেস্কঃ ‘বুধবার সকাল সাড়ে ১১টা। রসায়ন বিভাগের ল্যাবরেটরিতে কাজ করছিলাম আমি। বারান্দায় কিছু ছেলে ঝামেলা করছে বলে শুনি। বেরিয়ে দেখি আবদুল আলী নামে ওই ছাত্রকে ৪-৫ জন ছাত্র উপর্যুপরি ছুরিকাঘাত করছে।’
এভাবেই প্রকাশ্য দিবালোকে ছাত্রলীগকর্মী আবদুল আলী হত্যাকাণ্ডের রোমহর্ষক বর্ণনা দিচ্ছিলেন প্রত্যক্ষদর্শী সিলেট মদন মোহন কলেজের প্রভাষক তাহের আলী পীর।
তিনি বলছিলেন, ‘আমি চিৎকার দিয়ে বলি ওকে মেরো না তোমরা। আবদুল আলীকে রক্ষায় এগিয়ে গেলে ছাত্ররা আমাকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দেয়। তখন আমিও উল্টো তাদের ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেই এবং রক্তাক্ত অবস্থায় আহত ছাত্রটিকে উদ্ধার করে কক্ষে ঢোকাই।‘
‘হামলাকারী ছেলেগুলো তখন দৌড়ে পালায়। আমি তাদের ধরার জন্য চিৎকার করলেও কেউ এগিয়ে আসেনি। এসময় আরও এক শিক্ষক আমার সঙ্গে চিৎকার দিয়ে ওদের ধরার জন্য বলছিলেন। কিন্তু কেউ এগিয়ে আসেনি।’
ছুরিকাঘাতের পর আবদুল আলীর অবস্থার বর্ণনা দিয়ে তাহের আলী পীর বলেন, ‘আবদুল আলী নিজে এক হাত দিয়ে ছুরিকাঘাতের স্থান ধরে রেখেছিল। আমিও ছেলেটির ক্ষতস্থানে ধরে আছি। এরপরও ছেলেটির ক্ষতস্থান দিয়ে ট্যাপের পানি বেরোনোর মতো রক্ত ঝরছিলো। তৎক্ষণাৎ আরও কয়েকজন ছাত্র সামনে এলে তাদের বলি, ওরে মেডিকেল নিয়ে যাও, ওর অবস্থা খারাপ। ছাত্ররা এগিয়ে এসে কলেজের প্রধান ফটকে নিয়ে যাওয়ার আগেই ক্যাম্পাস আঙিনায় মাটিতে উপুড় হয়ে লুটে পড়ে জ্ঞান হারায় আবদুল আলী। সেখানেও তার শরীর থেকে অনবরত রক্ত ঝরছিলো।‘
তাহের আলী পীর জানান, হামলার পর সিভিল ড্রেসে (সাদা পোশাকে) গোয়েন্দা পুলিশের এক লোককে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তাকেও সহযোগিতার জন্য বলেন তিনি। উল্টো ওই লোক- মেডিকেলে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়ে বলে- সেখানে তাদের মানুষ (পুলিশ) রয়েছে। নিয়ে গেলে হেল্প করবে।
প্রভাষক বলছিলেন, ‘তখন একটি সিএনজিচালিত অটোরিকশায় ছেলেটিকে তুলে দেই। ততক্ষণে কলেজজুড়ে হৈচৈ শুরু হয়ে গেছে। রক্তাক্ত দেখে অনেক ছাত্র-ছাত্রীরা তখন দৌড়ে ক্যাম্পাস ত্যাগ করতে শুরু করে। তাৎক্ষণিক দৌড়ে কলেজ অধ্যক্ষের কক্ষে গিয়ে আমি বলি-স্যার ছেলেটির রক্তক্ষরণ বেশি হয়েছে। ওর জন্য কিছু করেন। কারণ ছুরিটা বেশি ঢুকে গেছে।’
চোখের সামনে একজন ছাত্রকে এভাবে মেরে ফেলার দৃশ্যে দেখে ভীষণ বিমর্ষ এই শিক্ষক। তিনি বলেন, ‘এ ধরণের মর্মান্তিক ঘটনা আমি কখনো দেখিনি। হামলাকারী ছাত্ররা আবদুল আলীর বুকের বাম পাশেসহ চারটি ছুরিকাঘাত করে। ছুরি বেশি বিদ্ধ হওয়ায় রক্তক্ষরণ বেশি হয়েছে।’
ছেলেটিকে বাঁচাতে না পারার কষ্টে আর্তনাদ করে প্রভাষক তাহের আলী বলেন, ‘চোখের সামনে একটা জ্যান্ত ছেলেকে মেরে ফেললো ওরা। কী এমন স্বার্থ।’
তবে হামলাকারী ওই যুবকদের চিনতে পারেননি উল্লেখ করে তিনি বলেন, কলেজে অনেক ছাত্র। তাই ওদের চিনতে পারিনি।
এ ব্যাপারে কলেজ অধ্যক্ষ আবুল ফতেহ ফাত্তাহ বলেন, ‘ঘটনার সময় ক্লাস চলছিলো। তাই ছাত্র-শিক্ষকরা ক্লাসে ছিলেন। এ কারণে ঘটনাটি তাৎক্ষণিক কেউ দেখেনি। আর ঘটনাটি ঘটেছে (নিচ তলায়) রসায়ন বিভাগের বিভাগীয় প্রধানের কক্ষের সামনে। ওই সময় বিভাগীয় প্রধান আবদুল হামিদও ক্লাসে ছিলেন। তাই তার কক্ষটিও বন্ধ ছিল।’
বুধবার (১২ আগস্ট) দুপুরে সিলেট মদনমোহন কলেজ ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগ কর্মীদের ছুরিকাঘাতে নিহত হন ছাত্রলীগেরই কর্মী আবদুল আলী (১৯)। তিনি মদনমোহন কলেজের এইচএসসি (উচ্চ মাধ্যমিক) দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন।
নগরীর কোতয়ালী মডেল থানার লামাবাজার পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ উপ-পরিদর্শক (এসআই) মাসুদ রানা বলেন, কলেজে প্রণোজিৎ দাসসহ আরও ৪-৫ জন ছাত্রলীগ কর্মীর মধ্যে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়। এতে ছুরিকাঘাতে আবদুল আলীর মৃত্যু হয়েছে।