বাংলাদেশে প্রায় সব অপহরণই প্রেমঘটিত ?
সুরমা টাইমস ডেস্কঃ অপহরণের ঘটনার শতকরা ‘৮৪ ভাগই প্রেমঘটিত’ – পুলিশের এহেন বক্তব্যের যথার্থতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন মানবাধিকার সংগঠনের কর্মী এবং সংশ্লিষ্টরা। তাদের কথায়, এর মাধ্যমে পুলিশ তার দায় ও ব্যর্থতা এড়ানোর চেষ্টা করছে।
সম্প্রতি ‘কন্ট্রোল রিস্ক’ নামে একটি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন তাদের প্রতিবেদনে জানায়, ‘অপহরণের শীর্ষ ১০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম। আর এ তথ্য বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ হওয়ার পর, তার প্রতিবাদ জানিয়েছে পুলিশ বিভাগ।
পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী পুলিশ মহা পরিদর্শক (এআইজি) মো. নজরুল ইসলাম প্রতিবাদ লিপিতে বলেন, ‘পৃথিবীর নবম সর্বোচ্চ জনবহুল দেশ বাংলাদেশে প্রেমঘটিত কারণে পালিয়ে গেলেও সেক্ষেত্রে অপহরণের মামলা হয়। এখানে প্রেমিক কর্তৃক প্রেমিকাকে অপহরণের মামলা মোট অপহরণ মামলার ৮৪ শতাংশ।’
পুলিশ সদর দপ্তর আরো জানায়, ‘পর্যালোচনায় দেখা গেছে যে ‘কন্ট্রোল রিস্ক’-এর প্রতিবেদনটি অন্যান্য সংস্থার রিপোর্টের সাথে সাংঘর্ষিক। তাই রিপোর্টটির গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ।
পুলিশের দাবি, লন্ডনভিত্তিক আন্তর্জাতিক সতর্ককারী সংস্থা ‘হেল্প বিল্ড পিস’-এর রিপোর্টে অপহরণের অপরাধ সংঘটনে ঝুঁকিপূর্ণ শীর্ষ দশে বাংলাদেশের নাম নেই। এছাড়া চলতি বছরের ৬ মার্চ অস্ট্রেলীয় সরকার ‘কিডন্যাপিং থ্রেট ওয়ার্ল্ডওয়াইড’ শীর্ষক যে প্রতিবেদন পেশ করে, সেখানে অপহরণ সংক্রান্ত ‘সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ’ দেশগুলোর মধ্যেও বাংলাদেশের নাম নেই।
লন্ডনভিত্তিক আরেকটি সংস্থা ‘রেড ২৪’ ২০১৫ সালে শীর্ষ অপহরণ-প্রবণ যে ১০টি দেশের তালিকা প্রকাশ করেছে, সেখানেও নেই বাংলাদেশের নাম। এছাড়া ‘নেশন মাস্টার’ প্রণীত রিপোর্টটিতে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৩৩।
পুলিশ সদর দপ্তর জানায়, ‘এই সংস্থাগুলোর রিপোর্টে আফগানিস্তান, কলাম্বিয়া, ইরাক, সোমালিয়া, উত্তর আফ্রিকার সাহেল-সাহারা, ভারত, পাকিস্তান, ভেনিজুয়েলা, ফিলিপাইন্স এবং ইয়েমেনকে অপহরণ-প্রবণ শীর্ষ দশটি দেশ হিসেবে দেখানো হয়েছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের দাবি, ‘একেক দেশে অপহরণের সংজ্ঞা এবং পরিসংখ্যান একেক রকম। অস্ট্রেলিয়ার পরিসংখ্যানে মুক্তিপণ বা চাঁদা আদায়, আদর্শগত ও রাজনৈতিক কারণে অপহরণ এবং জলদস্যুদের দ্বারা অপহরণকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
প্রেমিক-প্রেমিকা পালিয়ে গেলে কেন অপহরণের অভিযোগ গ্রহণ করা হয়?
ডয়চে ভেলের এ প্রশ্নের জবাবে পুলিশের এআইজি নজরুল ইসলাম বলেন, ‘বিধি-বিধানের কারণেই বাংলাদেশ পুলিশ প্রেমিকদের বিরুদ্ধে অপহরণের মামলা নিয়ে থাকে এবং সেটা পরিসংখ্যানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তাই ‘কন্ট্রোল রিস্ক’ কোন ধরণের পরিসংখ্যান নিয়ে প্রতিবেদন করেছে সেটা অস্পষ্ট।’
নজরুল ইসলাম বলেন, ‘বাংলাদেশে প্রকৃত অপহরণের সংখ্যা কম। প্রেমঘটিত অপহরণ বাদ দিলে তা মাত্র ১৬ ভাগ।’
অবশ্য সেই সংখ্যা, মানে মোট অপহরণের সংখ্যা বাংলাদেশ কত – তা তিনি তাৎক্ষণিকভাবে জানাতে পারেননি।
পুলিশের উক্তির প্রতিক্রিয়া
অপহরণ নিয়ে পুলিশ সদর দপ্তরের এ বক্তব্য প্রসঙ্গে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) প্রধান সুলতানা কামাল ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘পুলিশের ভাষ্য যদি সত্য হয়, তাহলে বাংলাদেশের প্রায় সব অপহরণই মনে হচ্ছে প্রেমঘটিত। আর তাই যদি হতো তাহলে আমরা আশ্বস্ত হতে পারতাম। অপহরণকারীরা প্রেমিক হলে তা তো এত খারাপ হতে পারে না। কিন্তু আসলে কি তাই?’
তিনি বলেন, ‘‘পুলিশ সদর দপ্তরের এখন উচিত হবে তাদের বক্তব্যের সমর্থনে সঠিক তথ্য-উপাত্ত প্রকাশ করা। তাহলে আমরা তা অনুসন্ধান করে দেখতে পারব। তাছাড়া শতকরা হিসাব দিলেও বছরে মোট অপহরণের ঘটনা কতটি – তা প্রকাশ করেনি পুলিশ সদর দপ্তর। সেটা প্রকাশ করলে ভয়াবহতা বোঝা যেত।’
সুলতানা কামাল জানান, ‘আসক’ অনেক দিন ধরেই বাংলাদেশে অপহরণের ঘটনা নিয়ে কাজ করছে। তাতে দেখা যাচ্ছে যে, অপহরণের ঘটনায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও জড়িত। এমনকি তারা অপহরণ করে মুক্তিপণও আদায় করে বলে অভিযোগ আছে। তাই সুলতানা কামাল মনে করেন, ‘পুলিশ এ ধরণের বক্তব্য দিয়ে দায় এবং ব্যর্থতা এড়ানোর চেষ্টা করছে।’
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে যারা অপহরণের শিকার হন, তাদের একটি বড় অংশ রাজনৈতি নেতা এবং কর্মী। আসক-এর হিসাব অনুযায়ী চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে বাংলাদেশে অপহৃত বা গুম হয়েছেন মোট ৩৯ জন। এছাড়া পাঁচ বছরে অপহরণের সংখ্যা ৩০২, যার মধ্যে ২০১০ সালে ৪৬, ২০১১ সালে ৫৯, ২০১২ সালে ৫৬, ২০১৩ সালে ৬৮ এবং ২০১৪ সালে অপহরণের সংখ্যা ৭৩ জন। এর মধ্যে ৪৩ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে, ফিরে এসেছে ২৪ জন। আর বাকিরা এখনও নিখোঁজ। সূত্র: ডয়চে ভেলে