রাজন হত্যা : পুলিশ ‘ব্যর্থ’, জনতাই ধরছে খুনিদের

Kamrul Killerসুরমা টাইমস ডেস্কঃ পুলিশ খুনিদের ধরতে ‘ব্যর্থ’ হচ্ছে। টাকা নিয়ে আসামীকে পালিয়ে যেতে সহায়তা করার অভিযোগ ওঠছে পুলিশের বিরুদ্ধে। অভিযোগ মামলা নিতে গড়িমসির। এমন সময়ে জনগণই এগিয়ে এসেছে। জনগণ জেগে উঠেছে। খুনিদের ধরে পুলিশের হাতে তুলে দিচ্ছে জনতা।
শিশু সামিউর রহমান রাজন হত্যা মামলার এজাহারভূক্ত আসামীদের মধ্যে এ পর্যন্ত তিন জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এই তিনজনকেই আটক করে পুলিশে দিয়েছে সাধারণ মানুষ। এদের মধ্যে দু’জনকে আটক করা হয় সিলেটে, আর একজনকে সৌদীতে।
এজাহারভূক্ত আসামীদের বাইরে গ্রেফতার করা হয়েছে আরও ছয়জনকে। এ ৬ জনের মধ্যে দু’জনকে জনতা আটক করে পুলিশের হাতে তুলে দেয়। সর্বশেষ বুধবার (১৫ জুলাই) রাতে রাজনকে নির্যাতনের ভিডিওচিত্র ধারণকারী নুর আহমদকে আটক করে পুলিশের হাতে তুলে দেয় জনতা।
একটা শিশুকে বর্বরোচিত নির্যাতনের মাধ্যমে খুন করে বিকৃত উল্লাসে মেতে ওঠে সেটা ভিডিও করে ঘাতকরা। সে ভিডিও দেখে নাড়া দেয় সব মানুষের বিবেক; ক্ষোভে ফুঁসে উঠে মানুষ।
এমন নৃশংসতা যখন শুভবোধসম্পন্ন সকল মানুষকে নাড়া দিয়েছে তখন পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে- টাকা নিয়ে খুনিদের বিদেশ পালিয়ে যেতে সাহায্য করার। অভিযােগ ওঠে, নিহত রাজনের পিতা আজিজুর রহমান থানায় মামলা করতে গেলে তার সাথে দুর্ব্যবহার করে পুলিশ। আজিজুর রহমানকে ধাক্কা দিয়ে থানা থেকে বের করে দেওয়া হয়। ঘটনার পরদিনই খুনিদের ধরতে থানাও ঘেরাও করে এলাকাবাসী, তাতেও টনক নড়েনি পুলিশের।
এমন নৃশংস, পৈশাচিক ঘটনার পর পুলিশের এই আচরণে আরো ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে মানুষ। অসহায়, মর্মাহত, সংক্ষুব্ধ মানুষ কেবল মানববন্ধন, সমাবেশের মাধ্যমে খুনিদের হত্যার বিচার দাবিতে থেমে না থেকে, কেবল পুলিশের মুখাপেক্ষি হয়ে না থেকে, নিজেরাই খুনিদের সনাক্ত করতে উদ্যোগী হয়। খুনিদের সনাক্ত করে তাদের আটকও করতে এগিয়ে আসে সাধারণ মানুষ।
এর মধ্যে ঘাতক দুলালকে জনতার সহযোগীতায় পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছেন খোদ তার মা। পুলিশের হাতে ছেলেকে তুলে দেওয়ার সময় মা রাজিবুন বলেন, ‘আমার ছেলে দোষি হলে, তার ফাঁসি দিন। আমার কোনো দুঃখ নেই। ওই মায়ের (সামিউলের মা) বুক খালি হইছে, ছোট একটা ছেলে মরছে, এতে আমার দুঃখ লাগছে। আমার বাচ্চাও আমি কুরবানি দিলাম।’
আবার খুনিদের আটক করলেও নিজেরা আইন হাতে তুলে না নিয়ে পুলিশের হাতেই তুলে দিচ্ছে বিক্ষুব্ধ মানুষ।
খুনিদের প্রতি এই সামাজিক ঘৃণা, নিজেরা উদ্যাোগী হয়ে খুনিদের আটক করা ও আইন নিজের হাতে তুলে না নিয়ে পুলিশের হাতে আসামীদের হস্তান্তর করার এই প্রবণতাকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন বিশিষ্টজনেরা। সাধারণ মানুষ অপরাধ ও অপরাধীদের প্রতি সবসময় এমন মনোভাব পোষণ করলে অপরাধ প্রবণতা অনেক কমে আসবে বলে মনে করেন তারা।
এব্যাপারে মানবাধিকার তথ্য পর্যবেক্ষণ সোসাইটির কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিত ও সিলেট বিভাগীয় সভাপতি হাবিবুর রহমান তাফাদার বলেন, যেখানে পুলিশ প্রশাসনের রন্দ্রে রন্দ্রে দূর্ণীতি সেখানে জনগন সোচ্চার না হওয়ার বিকল্প নেই। আশার কথা জনগন আসামীদের ধরে আইন নিজেই হাতে তুলে নেয়নি, পুলিশের হাতে তুলে দিচ্ছে।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সিলেটের সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী বলেন,এটি খুবই ভালো লক্ষণ। ঢাকায় বর্ষবরণেও দায়ীদের পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছিলো জনতা। রাজনের ক্ষেত্রেও আমরা এমনটি দেখতে পাচ্ছি। যারা অপরাধীদের ধরে পুলিশের হাতে দিচ্ছেন তারা প্রশংসার দাবিদার।
তিনি বলেন, এই প্রবণতা যত বাড়ব ততই মঙ্গল। এই উদাহরণ মানুষের মনে সাহস সঞ্চার করতে সাহায্য করবে। যে কোনো জায়গায় অন্যায় প্রতিবাদে এগিয়ে আসতে সাহস জুগাবে।
রাজন হত্যার ঘটনায় পুলিশের ব্যর্থতার কথা উল্লেখ করে ফারুক মাহমুদ বলেন, পুলিশ ব্যর্থ হচ্ছে বলেই জনগনকে খুনিদের ধরে ধরে দিতে হচ্ছে। যে কাজটি পুলিশের করার কথা ছিলো, তা জনগন করছে।
তিনি এ ঘটনার জন্য পুলিশকে দায়ী করে বলেন, যাদের গাফিলতি ও অপকর্মে এমন ঘটনা ঘটেছে ও খুনিরা পালিয়ে গেছে সেইসব পুলিশ কর্মকর্তাদেরও গ্রেফতার করা প্রয়োজন।
কেবল খুনিদের আটক করে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি মানুষ। খুনিদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিতের দাবিতে প্রতিদিনই সিলেটের বিভিন্ন স্থানে মিছিল-সমাবেশ করছে বিভিন্ন সংগঠন-প্রতিষ্ঠান-এলাকাবাসী। স্কুলের শিশুরাও রাস্তায় নেমেছে প্রতিবাদে।
নগরীর কুমারগাওয়ে শিশু সামিউরকে খুন করা হয় ৭ জুলাই। ৮ জুলাই লাশ গুমের সময় পুলিশ আটক করে মুহিত হোসেনকে। ১৩ জুলাই সৌদি আরবের জেদ্দায় সেখানকার প্রবাসী বাংলাদেশিরা ঘাতক কামরুলকে আটক করে পুলিশের হাতে তুলে দেয়। ১৪ জুলাই রাতে টুকেরবাজারের পীরবাজার এলাকাবাসী ঘাতক দারোয়ান ময়নাকে আটক করে পুলিশের হাতে তুলে দেয়। ১৫ জুলাই দুপুরে কুমারগাও থেকে দুলালকে আটক করে পুলিশের কাছে সোপর্দ করে জনতা। সর্বশেষ ১৫ জুলাই রাতে রাজনকে নির্যাতনের সময় ভিডিওচিত্র ধারণকারী নুরকে আটক করে পুলিশের হাতে তুলে দেয় জনতা।
এই মামলায় গ্রেফতার হওয়া অন্য আসামীরা হলো মুহিত আলমের স্ত্রী লিপি বেগম, শ্যালক আবুলস এবং এ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ফিরোজ আলী ও আসমত উল্লাহ। পুলিশ এদের গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়েছে।
জনগণের এই জাগরণকে সাধুবাদ জানিয়ে বুধবার দুপুরে রাজনের বাড়িতে যান নারী ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকী। তিনি বলেন, বিকৃত রুচির মানুষ সব জায়গায়ই আছে। এদের বিরুদ্ধে জনগণকে সচেতন হতে হবে। জনগণ সচেতন হলে এ ধরণের অপরাধ কমে আসবে।
তবে আসামী ধরতে পুলিশের ব্যর্থতার কথা অস্বীকার করে সিলেট মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ কমিশনার (গণমাধ্যম) রহমত উল্লাহ বলেন, পুলিশ ব্যর্থ হয়নি। মোবাইল ট্রাকিংয়ের মাধ্যমে পুলিশই আামীদের অবস্থান সনাক্ত করতে সম্ভব হয়েছে। পরে জনতার সহযোগীতায় তাদের গ্রেফতার করে।