নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে বিশ্বব্যাংকের স্বীকৃতি, আনন্দ শঙ্কা দুটোই
সুরমা টাইমস ডেস্কঃ নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে বিশ্বব্যাংকের স্বীকৃতি পেল বাংলাদেশ। স্বাধীনতার পরবর্তী নানা অপ্রাপ্তির মধ্যে এটি একটি বড় সুসংবাদ। এই স্বীকৃতিতে সকল স্তরের মানুষ খুশি। তবে এ নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়েছেন ব্যবসায়ীরা। তারা আশঙ্কা করছেন, নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশ হওয়ায় ব্যবসা বাণিজ্যের ক্ষেত্রে পাওয়া বর্তমান সুবিধাগুলো হারাতে হতে পারে।
রপ্তানিকারকদের আশঙ্কা করছেন, এ স্বীকৃতি অর্জনের ফলে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ও অঞ্চলে পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে কোটাসহ বিশেষ সুবিধা হারাতে পারে বাংলাদেশ, যা এতদিন নিম্ন আয়ের দেশ হিসেবে ভোগ করে আসছিল। একইসাথে বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থার ঋণ পাওয়া কঠিন হতে পারে বলে জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা। যদিও এসব সুবিধা বাতিলের বিষয়ে এখনও পর্যন্ত কোনো ঘোষণা আসেনি।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারারস অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) সহ-সভাপতি শহীদুল্লাহ আজিম গণমাধ্যমকে বলেন, ‘নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশ হওয়াতে আমরা খুশি। কিন্তু এতে আমরা বিভিন্ন সুবিধা থেকে বঞ্চিত হতে পারি। বিশেষ করে দেশের প্রধান রপ্তানি খাত তৈরি পোশাক ইউরোপ-কানাডাসহ বিভিন্ন দেশ ও অঞ্চলে কোটা সুবিধা হারাতে পারে।’
তিনি আরো বলেন, ‘বিশ্ব বাজারে এখন বাংলাদেশি পণ্য আরো বেশি প্রতিযোগিতার মুখে পড়বে। ভারতের মতো বড় অর্থনীতির দেশের সাথে আমাদের প্রতিযোগিতা করতে হবে। তবে এর জন্য দ্রুতই নিজেদের অরো মজবুদ করতে হবে বিশ্ব অর্থনীতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার জন্য।’
তবে বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতির (এফবিসিসিআই) জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন মনে করছেন, ‘নিম্ন মধ্যবিত্তের দেশ হলেও বাংলাদেশ কোটা সুবিধা হারাবে না। নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশ হয়ে পাকিস্তান জিএসপি সুবিধা পেয়ে আসছে। আমরাও পাবো আশা করি।’
তিনি বলেন, ‘শুধু মাথাপিছু আয় নয়, কোটা সুবিধা বিবেচনায় আরও কয়েকটি অর্থনৈতিক সূচক বিবেচনা করা হয়। এগুলোতে আমাদের অবস্থান এখনও সুদৃঢ নয়, তাই কোটা সুবিধা বাতিল হবে না।’ তবে নিম্ন আয়ের দেশ থেকে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ হওয়াকে যুগান্তকারী অর্জন হিসেবে অভিহিত করেছেন তিনি। ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ উন্নত দেশের কাতারে সামিল হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এ অর্জন অভীষ্ট লক্ষ্যের দিকে এক ধাপ এগিয়ে যাওয়া।’
এদিকে বৃহস্পতিবার অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত বলেছেন, ‘যতদিন পর্যন্ত জাতিসংঘ আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা না করবে ততদিন নিম্ন আয়ের দেশ হিসেবে প্রাপ্ত সুবিধা ভোগ করতে পারবে বাংলাদেশ। আর জাতিসংঘের বোর্ড সভায় এটা অনুমোদন পেতে আরো তিন চার বছর সময় লেগে যাবে।’
দেশ এগিয়ে যাওয়ার এরকম একটি স্বীকৃতি এদেশের জন্য এই মুহূর্তে বেশ দরকার ছিল উল্লেখ করে অর্থনীতিবিদ ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ গণমাধ্যমকে বলেন, ‘এমন স্বীকৃতি খুশি হওয়ার মতই। তবে এটা আমাদের জন্য তৈরি হওয়ার একটি সংকেত মনে করতে হবে। কারণ বিশ্ববাণিজ্যে আমরা যদি আরো বেশি আমাদের অবস্থান পাকা না করতে না পারি, ঠিক কোটাসুবিধাগুলো বন্ধ হয়ে গেলে আমরা বেশ বিপদে পড়বো।’ তাই এসব সুবিধা বন্ধ হলেও যাতে বিশ্ববাণিজ্যে আমরা পিছিয়ে না পড়ি সেভাবে প্রস্তুতি নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন এ অর্থনীতিবিদ।
অর্থনীতিবিদরা এও বলছেন, মধ্যম আয়ের দেশের কাতারে যাওয়া মানেই নিম্ন আয়ের তালিকা থেকে বের হয়ে যাওয়া নয়। এর মধ্য দিয়ে শুধু একটি দেশের আয় বাড়ে, কিন্তু অন্যান্য সূচকে পিছিয়ে পড়ার আশঙ্কা থেকে যায়।
আর নিম্ন আয়ের দেশ হিসেবে বাজার সুবিধা পাওয়া ব্যাপারে তারা বলছেন, বিশ্বব্যাপী এখন শুল্ক কমছে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) মাধ্যমে যেমন শুল্ক কমানো হয়, তেমনি দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য চুক্তির মাধ্যমে বিভিন্ন দেশের মধ্যকার শুল্কহার কমে যাচ্ছে। তাই অগ্রাধিকারমূলক বাজারসুবিধা এমনিতেই দিনে দিনে কমে যাচ্ছে। সামনে আরও কমবে।
কম সুদে ঋণ সুবিধা বন্ধ হবে কি না সে প্রশ্নে তারা বলছেন, মধ্যম আয়ের দেশ হলে বাণিজ্যিক সুদের হারে ঋণ নিতে হবে। কিন্তু এখনই অনেক ক্ষেত্রে বাণিজ্যিক হারে ঋণ নেয়া হচ্ছে।
উল্লেখ্য, প্রতিবছর ১ জুলাই বিশ্বব্যাংক আনুষ্ঠানিকভাবে মাথাপিছু মোট জাতীয় আয় অনুসারে দেশগুলোকে চারটি আয় গ্রুপে ভাগ করে। সেই ধারাবাহিকতায় বুধবার এ আন্তর্জাতিক সংস্থা বাংলাদেশকে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে স্বীকৃত দেয়। বিশ্বব্যাংক মধ্যম আয়ের দেশগুলোকে দুটি শ্রেণিতে ভাগ করেছে: নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ ও উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশ।
বিশ্বব্যাংকের মানদণ্ড অনুযায়ী, যাদের মাথাপিছু জাতীয় আয় ১ হাজার ৪৫ ডলার বা তার নিচে, তারা নিম্ন আয়ের দেশ। মূলত ১ হাজার ৪৬ ডলার থেকে শুরু করে যেসব দেশের মাথাপিছু জাতীয় আয় ১২ হাজার ৭৩৬ ডলার, তারা মধ্যম আয়ের দেশের অন্তর্ভুক্ত। এর মধ্যে আবার আয় ১ হাজার ৪৬ ডলার থেকে শুরু করে ৪ হাজার ১২৫ পর্যন্ত হলে তা হবে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ এবং আয় ৪ হাজার ১২৬ ডলার থেকে শুরু করে ১২ হাজার ৭৩৬ ডলার হলে দেশগুলোকে বলা হয় উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশ। এর চেয়ে বেশি মাথাপিছু জাতীয় আয় হলে সেই দেশগুলোকে বলা হয় উচ্চ আয়ের দেশ।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে বাংলাদেশের মাথাপিছু জাতীয় আয় ১ হাজার ৩১৪ ডলার। তবে বিশ্বব্যাংকের পদ্ধতি অনুযায়ী তা এখন ১ হাজার ৪৫ ডলারকে ছাড়িয়ে গেছে। এ কারণেই নতুন তালিকায় নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ হতে পেরেছে বাংলাদেশ।
নতুন তালিকায় চারটি দেশ নিম্ন মধ্যম আয়ের তালিকায় নতুন করে ঢুকতে পেরেছে। এগুলো হলো, বাংলাদেশ, কেনিয়া, মিয়ানমার ও তাজিকিস্তান। সার্কভুক্ত ভারত ও পাকিস্তান নিম্নমধ্যম আয়ের দেশে অন্তর্ভুক্ত। সব মিলিয়ে এখন নিম্ন আয়ের দেশ ৩১টি, নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ ৫১টি, উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশ ৫৩টি এবং উচ্চ আয়ের দেশ ৮০টি।