হাইকোর্টে বিচারাধীন থাকা সত্ত্বেও পচা গম বিতরণ
খাদ্য অধিদফতর সূত্র জানায়, ব্রাজিল থেকে আমদানি করা ২ লাখ টন গমের মধ্যে ইতিমধ্যে প্রায় দেড় লাখ টন গম বিতরণ শেষ হয়েছে। মঙ্গলবার জুনের শেষ দিন হওয়ায় বাকি ৫০ হাজার টন গমও উত্তোলন করবে সারা দেশের বিভিন্ন কর্মসূচি সংশ্লিষ্টরা।
সুরমা টাইমস ডেস্কঃ নানা বিতর্কের মধ্যেই ব্রাজিল থেকে আমদানি করা ‘বিতর্কিত’ গম বিতরণ প্রায় শেষ পর্যায়ে রয়েছে। এই গম বিষাক্ত কি না- তা নিশ্চিত হওয়ার আগেই বিতরণ করায় নতুন করে দেখা দিয়েছে নানা প্রশ্ন। কারণ প্রয়োজনীয় পরীক্ষার ফল না আসা পর্যন্ত গম বিতরণ না করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিল দেশের বিভিন্ন মহল।
ইতিমধ্যেই পুলিশ বিভাগের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, এই গম খেয়ে পুলিশ সদস্যরা শারীরিকভাবে দূর্বল হয়ে পড়েছেন। ব্রাজিল থেকে আমদানি করা নিম্নমানের গম পুলিশকে নিতে বাধ্য করা হচ্ছে বলেও তাদের অভিযোগ।
আমদানি করা এই গম বিভিন্ন গবেষণাগারে তিন ধাপে পরীক্ষা করা হলেও সেগুলো বিষাক্ত কিনা তা নিশ্চিত করা হয়নি। তবে এটি (বিষাক্ত) নিশ্চিত করতে গমের নমুনা পাঠানো হচ্ছে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউট (বিএআরআই) ও বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইন্সটিটিউটে (বিআরআরআই)। এদিকে নিম্নমানের গমের কারণে এক মাস ধরে বন্ধ রয়েছে বরিশাল বিভাগের ছয় জেলায় ওএমএসের কার্যক্রম। এর পরিপ্রেক্ষিতে ওই গমের নমুনা সংগ্রহ করে ভালো মানের গম সরবরাহের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে চিঠি দেয়া হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে খাদ্যমন্ত্রী অ্যাডভোকেট মো. কামরুল ইসলাম মঙ্গলবার বলেন, ‘ব্রাজিলের গমের বিষয়টি এখন আদালতে বিচারাধীন। আগামী রোববার এ বিষয়ে হাইকোর্টে শুনানি হবে। কাজেই বিচারাধীন বিষয় নিয়ে আমি কোনো কথা বলব না। তাছাড়া বিষয়টি খাদ্য অধিদফতরের, খাদ্য মন্ত্রণালয়ের নয়।’
জানা গেছে, চলতি বছর মোট ৬ লাখ টন গম আমদানির জন্য ১২টি দরপত্র আহ্বান করা হয়। এর মধ্যে ৪টি দরপত্রের বিপরীতে দু’টি কোম্পানি (ইমপেক্ট ইন্টারন্যাশনাল ও ওলাম ইন্টারন্যাশনাল) ফেব্রুয়ারি মাসে প্রায় সোয়া ৪০০ কোটি টাকা দামের দুই লাখ টন গম ব্রাজিল থেকে আমদানি করে।
এসব গমের আটা বিজিবি, পুলিশ, আনসার, কোস্টগার্ড, ফায়ার সার্ভিসসহ অন্যান্য সংস্থার সদস্যদের মধ্যে রেশন দেয়া হয়। পাশাপাশি টিআর-কাবিখার কর্মসূচিও চালানো হয়। প্রথমে পুলিশ ও পরে বিভিন্ন সংস্থা থেকে লিখিতভাবে এ আটা গ্রহণে অসম্মতি জানানো হয়। তারা বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীকে অবহিত করলে তিনি খাদ্য সচিবকে ডেকে পোকায় খাওয়া গম দেখিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। এ ঘটনায় কারা জড়িত তা তদন্ত করে বের করারও নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী। এরপরই মূলত নড়েচড়ে বসে খাদ্য মন্ত্রণালয়।
প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের পর নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের মাধ্যমে বিভিন্ন জেলা থেকে গম সংগ্রহ করে খাদ্য অধিদফতরের গবেষণাগারে পরীক্ষা করে খাদ্য মন্ত্রণালয়। পরীক্ষা শেষে ব্রাজিলের গম খাদ্য উপযোগী বলে দাবি করা হয়। পরে বিভিন্ন মহল থেকে নিরপেক্ষ কোনো পরীক্ষাগার থেকে গম পরীক্ষার দাবি উঠলে তা বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদের গবেষণাগারে পাঠানো হয়।
ওই পরীক্ষায় ব্রাজিল থেকে আমদানিকৃত গম অত্যন্ত নিম্নমানের বলে প্রমাণিত হয়। তাতে প্রতি ৭৫ কেজি গম ওজন করে তা আদর্শ মাপ অনুযায়ী পাওয়া যায়নি। খাদ্য অধিদফতরের আমদানির শর্ত অনুযায়ী, ৭৫ কেজির বস্তার ওজন যদি ৭২ কেজির কম থাকে তাহলে তা বন্দর থেকে খালাস করা যাবে না, ফেরত দিতে হবে। অথচ ৭৫ কেজির স্থলে বিভিন্ন পরীক্ষায় তা ৭১ কেজি থেকে সাড়ে ৭১ কেজি পাওয়া গেছে।
পাশাপাশি গমের নষ্ট দানার পরিমাণ সর্বোচ্চ ৪ শতাংশ পর্যন্ত গ্রহণ করার কথা থাকলেও সর্বোচ্চ ১৩ শতাংশও পাওয়া গেছে। এছাড়া শুকনো, কুঁচকানো ও ভাঙা দানার পরিমাণ সর্বনিম্ন থাকার কথা ৫ শতাংশ। কিন্তু বেশির ভাগ জেলার খাদ্যগুদামে তা ৮ থেকে ২১ শতাংশ পর্যন্ত পাওয়া গেছে। কিন্তু এসব পরীক্ষায় গমে কোনো বিষাক্ত পদার্থ আছে কিনা তা নিয়ে কোনো পরীক্ষা করা হয়নি।
গণমাধ্যমে এ নিয়ে প্রশ্ন ওঠায় গমে কোনো বিষাক্ত পদার্থ আছে কিনা তা চিহ্নিত করতে ব্রাজিল থেকে আনা গমের নমুনা গাজীপুরের বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউট ও বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইন্সটিটিউটে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে খাদ্য মন্ত্রণালয়। এ বিষয়ে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তা বলেন, সব প্রশ্নের অবসানে দু-একদিনের মধ্যে ব্রাজিলের গম পরীক্ষা করতে গাজীপুরের ধান ও কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউটে পাঠানো হচ্ছে। সেখানে সব ধরনের পরীক্ষা করা হবে। একই ধরনের ইঙ্গিত দিলেন খাদ্য অধিদফতরের একজন পরিচালকও। যিনি ব্রাজিলের গম কেনাকাটার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তবে তিনি নাম প্রকাশ করে কোনো তথ্য দিতে রাজি হননি।
খাদ্য অধিদফতর সূত্র জানায়, ব্রাজিল থেকে আমদানি করা ২ লাখ টন গমের মধ্যে ইতিমধ্যে প্রায় দেড় লাখ টন গম বিতরণ শেষ হয়েছে। মঙ্গলবার জুনের শেষ দিন হওয়ায় বাকি ৫০ হাজার টন গমও উত্তোলন করবে সারা দেশের বিভিন্ন কর্মসূচি সংশ্লিষ্টরা।
এ বিষয়ে খাদ্য অধিদফতরের পরিচালক (প্রশাসন) মো. বাদরুল হাসান বলেন, ব্রাজিলের গম প্রায় বিতরণ শেষ পর্যায়ে। আজ (মঙ্গলবার) জুন ক্লোজিং হওয়ায় সারা দেশের বিভিন্ন গুদাম থেকে প্রায় সব গম বিতরণ করা হবে। ফলে ব্রাজিলের গম পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্যে বিতরণ শেষ হবে। অল্প কিছু গম থাকতেও পারে।
এর আগে গত রোববার সচিবালয়ে সাংবাদিকদের কাছে খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম দাবি করে বলেছিলেন, ২ লাখ টন গমের মধ্যে ইতিমধ্যে ১ লাখ ৪০ হাজার টন বিতরণ করা হয়েছে। অথচ কোথাও থেকে তো গম পচা এমন প্রশ্ন ওঠেনি। গত চার মাস ধরে ওই গম সারা দেশের বিভিন্ন স্থানে বিতরণ করা হয়েছে।
ব্রাজিল থেকে আনা নিম্নমানের গম রেশন হিসেবে দেয়ায় সাধারণ পুলিশ সদস্যরাও ক্ষোভ জানিয়েছেন। পুলিশ সদর দফতরের এআইজি (সাপ্লাই) রেজাউল করিম এ বিষয়ে বলেন, খাদ্য অধিদফতর থেকে নিম্নমানের গম সরবরাহ প্রসঙ্গে লিখিতভাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়কে জানানো হয়েছে। কিন্তু নিম্নমানের গম সরবরাহ বন্ধ হয়নি। এসব পুরনো ও নিম্নমানের গমই পুলিশকে বাধ্য হয়ে নিতে হয়। আগের চালানের গম শেষ না হলে পরের চালানের গম দেয়া হয় না।
নিম্নমানের গমের বিষয়ে এসপিবিএনের কনস্টেবল মোহাম্মদ ইব্রাহিম বলেন, ‘রেশনে আমরা যে আটা পাই সেটা অনেক ক্ষেত্রেই খাওয়ার উপযোগী থাকে না। তাই বাধ্য হয়ে ওই আটা রাজারবাগ পুলিশ লাইনেই অর্ধেক দামে বিক্রি করে বাজার থেকে খাওয়ার উপযোগী প্যাকেট আটা বেশি দামে কিনতে হয়।’
এছাড়া মঙ্গলবার ডিএমপি কন্ট্রোল রুম ব্যারাকে কথা হয় এএসআই রকিবল, কনস্টেবল জালাল, আরিফ ও হোসেনের সঙ্গে। তারাও রেশনে পাওয়া গম নিম্নমানের বলে জানান। পুলিশ সদর দফতরের কর্মরত নারী কনস্টেবল ফাতেমা জানান, রেশনের পাওয়া আটা প্রায় অর্ধেক দামে রাজারবাগ পুলিশ লাইনেই বিক্রি করে দিতে হয়। অথবা দুর্গন্ধ ও পোকামাকড়যুক্ত আটা খেতে হয়।
বরিশালে ওএমএস কার্যক্রম বন্ধ : নিম্নমানের গমের কারণে এক মাস ধরে বন্ধ রয়েছে বরিশাল বিভাগের ছয় জেলায় ওএমএসের কার্যক্রম। এর পরিপ্রেক্ষিতে ওই গমের নমুনা সংগ্রহ করে ভালো মানের গম সরবরাহের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে চিঠি দেয়া হয়েছে। বিভাগীয় খাদ্য নিয়ন্ত্রকের দফতর সূত্রে জানা গেছে, বিভিন্ন সরকারি সংস্থার রেশন ও ওএমএসের জন্য গত এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে বরিশালসহ বিভাগের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলাতে গম সরবারাহ করা হয়।
অভিযোগ পাওয়া গেছে, ওই গম থেকে উৎপাদিত আটা গন্ধযুক্ত। যে কারণে ওএমএস ডিলাররা ওই গম থেকে উৎপাদিত আটা গ্রহণ করছে না। সিটি কর্পোরেশনের ওএসএম ডিলার সোহেল রানা জানান, বর্তমানে যে আটা বিতরণ করা হচ্ছে তার মান এতটাই নিম্ন যে স্বল্প আয়ের মানুষও সেই আটা ক্রয় করছেন না। যার ফলে দিনে ২০০ কেজি আটাও বিক্রি হয় না। তাই বেশির ভাগ ডিলার ওএমএসের আটা বিক্রি বন্ধ রেখেছে।
খাদ্য বিভাগের তালিকাভুক্ত মিল মালিক মো. জামান হোসেন জানান, খাদ্য বিভাগের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী এক কেজি গম থেকে ৮৫০ গ্রাম আটা দেয়ার কথা। বাকি ১৫০ গ্রাম ভুসি। কিন্তু বর্তমানে যে গম দেয়া হচ্ছে তা দিয়ে ৬৫০ গ্রামের বেশি আটা দেয়া যায় না। তাছাড়া গম থেকে আটা উৎপাদনের জন্য মেশিনে যে চালনি রয়েছে তার চেয়ে গমের আকার ছোট হওয়ায় চালনির ফাঁক গলে গম পড়ে যায়। এতে লাভের চেয়ে ক্ষতির পরিমাণ বেশি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে মেট্রোপলিটন পুলিশের এক সিনিয়র কর্মকর্তা বলেন, রেশনের জন্য বিতরণকৃত ওই গম পুলিশ সদস্যরা নিতে চান না। তাই পুলিশ বিভাগে ভালোমানের গম সরবরাহের জন্য জেলা খাদ্য অধিদফতরকে চিঠি দেয়া হয়েছে। সংবাদ সূত্র: যুগান্তর।