মি‘রাজ ; একটি প্রশিক্ষণ : ড. এ এইচ এম সোলায়মান
আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ (সা.) এর এক ঐতিহাসিক মূর্জেজা হলো মে‘রাজ। এ কোন আকষ্মিক ঘটনা ছিলনা। এছিল নবী জীবনের মূল উদ্দেশ্যের সঙ্গে জড়িত এক পূর্ব পরিকল্পিত ও সময়োচিত ঘটনা।
নবী করিম (সা.) এর নবুওতের দীর্ঘ দশ বছরের চেষ্টার পর যখন ইসলামী মূল্যবোধ ও ইসলামী জীবন বোধের ভিত্তিতে একটা খেলাফতের ভিত্তি স্থাপনের সময় আসন্ন হয়ে আসছিল, তখন মহানবী (সা.) মনে মনে উদগ্রীব ছিলেন যে, খেলাফতির একটা নির্ভুল নকশা পাওয়ার জন্য। আর মনে মনে চাচ্ছিলেন এমন কিছু নিদর্শন দেখতে যা দেখে পরকালের অবস্থাটা প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে তাঁর উম্মতের সামনে পেশ করতে পারেন। সে মুহুর্তে অর্থাৎ নবুওতের দ্বাদশ বছরে মহানবী (সা.) এর ৫০ বছর বয়সে ৬২১ খ্রী: ২৬শে রজব দিবাগত রাত্রীতে সংঘটিত হয়েছিল মে’রাজ।
আল্লাহ তা‘আলা তাঁর প্রিয় নবীকে আরশে মুয়াল্লায় ডেকে নিয়ে তাঁর কুদরতের এমন নিদর্শন দেখালেন এবং এমন কিছু শিক্ষা দিলেন যাতে উপরোক্ত প্রয়োজন গুলো মিটাতে পারেন।
কিন্তু দুংখজনক হলে ও সত্য আমাদের সমাজে মে‘রাজের মূল শিক্ষা থেকে দূরে সরে মে‘রাজের আসমানি ভ্রমন কাহিনী আলোচ্য বিষয় হিসেবে প্রাধান্য দেয়া হয়। নিম্নে সংক্ষিপ্তভাবে মেরাজের শিক্ষা কুরআন হাদীসের আলোকে আলোকপাত করা হলো।
ইস্রা ও মে‘রাজের ঘটনা কুরআনে অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত ও আংশিকভাবে এসেছে। বিস্তারিত ঘটনা বেশ কিছু সহীহ হাদীসে উল্লিখিত হয়েছে।মক্কা শরীফের মসজিদুল হারাম থেকে ফিলিস্তিনের মসজিদুল আক্বসা পর্যন্ত ভ্রমনকে কুরআনুল কারিমে ইসরা (রাত্রী বেলার ভ্রমন) হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা এরশাদ করেন “মহা পবিত্র সে সত্ত্বা, যিনি রাতের বেলায় তাঁর বান্দাকে ভ্রমন করিয়েছেন” (ইসরা-১) আর মসজিদুল আক্বসা থেকে উর্ধগমনের অংশটুকু মি‘রাজ নামে অভিহিত হয়েছে হাদীস শরীফে।
মি‘রাজের আভিধানিক অর্থ উর্ধ্বোগমণ,উর্ধ্বারোহণ,বা উর্ধ্বারোহণের যন্ত্র।আর পারিভাষিক অর্থ মি‘রাজ বলতে বুঝায় আল্লাহ তা‘আলা তাঁর নবী রাসূলগণকে নবুওতের গুরু দায়িত্ব পালনের উপযোগী করে গড়ে তোলার জন্যে যে ট্রেনিং দেয়ার উদ্দেশ্যে তাঁর রহমতের সর্বাধিক সান্নিধ্যে ডেকে নিতেন। ঐ ডাকে হাজির হওয়াকে মি‘রাজ বলা হয়।
শবে মি‘রাজের সংক্ষিপ্ত বর্ণনাঃ- আল্লাহ তা‘আলার প্রিয়তম রাসুল মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ (সা.) এর ৫০ বছর বয়সে, তাঁর নবুয়াতের দশম বছরে রজব মাসের ২৬ শে দিবাগত রাতে এ বিস্ময়কর ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল। তবে এ তারিখ নিয়ে প্রায় ২০ টি মত রয়েছে। কোন কোন আলিমের মতে যিলক্বাদ মাসে, কারো মতে রজব মাসের এক তারিখে বা রজব মাসের প্রথম শুক্রবার এবং কারো মতে রজব মাসের ২৭ তারিখে মি‘রাজ সংঘটিত হয়েছিল । তবে ইমাম যুহরী ও উরওয়া ইবনুয যুবাইর এর মতে রবিউল আওয়াল মাসে মি‘রাজ সংঘটিত হয়েছিল।ইবনু আবী শাইবা সংকলিত এক মুরসাল হাদীসে জাবির (রা.) ও ইবনু আব্বাস (রা.) বলেন রাসূলুল্লাহ (সা.) রবিউল আওয়াল মাসের ১২ তারিখ সোমবার জন্ম গ্রহণ করেন,এদিনেই তিনি নবুওয়াত লাভ করেন। এ দিনেই তিনি মি‘রাজে গমণ করেন, এদিনেই তিনি হিজরত করেন এবং এ দিনেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
মিরাজের রাতে রাসুল (সা.) উম্মেহানির ঘরে শুয়ে ছিলেন, জিবরাইল (আ.) এসে তাঁকে জাগালেন এবং কাবাঘর প্রাঙ্গণে নিয়ে বক্ষ বিদারণ করা হয় । তারপর বোরাক নামক স্বর্গীয় বাহনের মাধ্যমে বায়তুল মুকাদ্দাসে পৌঁছেন।সেখানে কিছু আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করা হয়। রাসুল (সা.) বলেন, ‘আমার সামনে এক পেয়ালা শরাব এবং এক পেয়ালা দুধ রেখে যেটি ইচ্ছা পান করতে বলা হলো, আমি দুধের পেয়ালা পান করলাম। তা দেখে জিবরাইল (আ.) বললেন,এটিই দ্বীন (ধর্ম)। যার উপর আপনি এবং আপনার উম্মত কায়েম থাকবেন। তারপর আকাশের দিকে রওয়ানা হন। রাসুল (সা.) বলেন, ‘অত:পর আমাকে নিয়ে নিকটতম আকাশের দিকে উঠলেন।’ প্রথম আসমানে পৌছতেই আকাশের দ্বার রক্ষীরা দরজা খুলে দিল। অত:পর তিনি আদমের (আা.) সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তারপর পর্যায়ক্রমে দ্বিতীয় আসমানে ঈসা ও ইয়াহইয়া (আা.).তৃতীয় আসমানে ইউসুফ (আা.),চতুর্থ আসমানে ইদরিস (আ.),পঞ্চম আসমানে হারুন (আা.),ষষ্ঠ আসমানে মুসা(আা.), ও সপ্তম আসমানে ইবরাহিমের (আা.) সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন, তখন তিনি বায়তুল মা‘মুরে হেলান দিয়ে বসা ছিলেন। জিবরাইল (আা.) একে একে সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন।
সপ্তম আসমানের শেষ প্রান্তে তিনি দেখলেন চমৎকার একটি নহর।যার চার পাশে মনোরম দৃশ্য,ইয়াকুত,মতি জহরতের অসংখ্য পেয়ালা এবং উপবিষ্ট সবুজ বর্ণের অসংখ্য পাখি। সে নহর দিয়ে দুধের মতো পানি বয়ে যাচ্ছিল। জিবরাইল (আা.) বলেন,আল্লাহপাক আপনাকে কাউসারের যে সুসংবাদ দিয়েছেন,‘আমি আপনাকে কাউসার দান করেছি।’(সূরা কাউসার,আয়াত:১) এটি হচ্ছে সেই কাউসার।নবী (সা.) বলেন ‘আমি এক পেয়ালা করে পানি পান করলাম, আমার মনে হলো তা মধুর চেয়েও মিষ্টি ও সুস্বাদু এবং মেশকের চেয়ে অধিক সুগন্ধযুক্ত।’ তারপর জিবরাইলকে নিয়ে জান্নাত,জাহান্নাম দেখলেন। এভাবে উপরে আরোহণ করে সিদরাতুল মুনতাহা বা সীমান্তে কুল বৃক্ষের কাছে পৌঁছেন। যার ফল আাকারে বড় বড় মটকার মতো, পাতাগুলো হাতির কানের মতো। আবু যার(রা.) থেকে বর্ণিত রাসুল (সা.) বলেন,‘আমি সিদরাতুল মুনতাহায় পৌছে আশ্চর্যজনক নূরের তাজাল্লি ও বিস্ময়কর কুদরত অবলোকন করলাম। তখন আমি উপলব্ধি করতে পারিনি এসব কি ছিল। পরে আমাকে জান্নাতে প্রবেশ করানো হলো।জান্নাতের গম্বুজগুলো মণিমুক্তায় খচিত এবং মেশক আম্বরের।’ (বুখারি মুসলিম)। সেখান থেকে জিবরাইল (আা.) বিদায় নেন এবং রফরফ নামক আরেক কুদরতী বাহনে আরোহণ করে নূরের রাজ্যে প্রবেশ করেন। একে একে ৭০ হাজার নূরের পর্দা অতিক্রম করেন,যার প্রত্যেকটি ছিল খুবই সুন্দর,স্বকীয় বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত এবং ভিন্ন রকমের। এভাবে তিনি আরশে আজীমে পৌঁছেন।
আল্লাহপাকের সঙ্গে তাঁর প্রিয় হাবিব একান্তভাবে সাক্ষাত করেন। তখন অনেক গোপন কথা হয় যা আল্লাহ ও তাঁর হাবিবই ভালো জানেন। আল্লাহ তা‘আলা মানব জীবনে ইহকাল ও পরকালের কল্যাণ সাধনের জন্য যা প্রত্যাদেশ করার প্রয়োজন ছিল তা করলেন। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে,‘অত:পর সে (মুহাম্মদ সা.) তাঁর নিকটবর্তী হলেন, অতি নিকটবর্তী। ফলে তাঁদের মধ্যে দুই ধনুক পরিমাণ অথবা তার চেয়েও অল্প দূরত্ব বাকি রইল,তখন আল্লাহ তা‘আলা তাঁর বান্দার প্রতি যা প্রত্যাদেশ করার প্রয়োজন ছিল তা করলেন।(সূরা নাজম, আয়াত ৮-১০)।
রাব্বুল আলামিনের প্রত্যক্ষ দিদার লাভ করে রাসুল (সা.) বায়তুল মুকাদ্দাসে ফিরে আসেন। যেখানে পূর্ববর্তী সব নবী-রাসুল অপেক্ষা করছিলেন। তিনি ইমাম হয়ে সবার সঙ্গে নামাজ আদায় করলেন। কেউ কেউ বলেন , এ নামাজ আকাশে যাওয়ার আগে হয়েছিল। এসব ঘটনা অতি অল্প সময়ে সংঘটিত হয়েছিল। মক্কায় এসে দেখেন তাঁর ব্যবহৃত ওজুর পানি গড়াচ্ছে এবং দরজার শিকলটাও নড়ছে। মি‘রাজের মাধ্যমে রাসুল (সা.) মানব জাতির জন্য পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ নিয়ে আসেন। সব ঘটনা যখন তিনি সাহাবায়ে কিরামদের সামনে বর্ণনা করলেন তখন সাহাবায়ে কিরামগণ আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘আমরাও যদি মি‘রাজে গমন করতে পারতাম’। এ সময় রাসুল (সা.) ঘোষণা করেন, ‘নামাজ মুমিনদের জন্য মি‘রাজস্বরূপ।’(ইবনে মাজাহ)।
এ মি‘রাজ প্রায় প্রত্যেক নবী রাসূল গণেরই হয়েছে যেমন, আদম (আ.) এর মি‘রাজ হয়েছিল বেহেশতের মধ্যে । মুসা (আ.) এর তুর পাহাড়ে।ইব্রাহীম (আ.) এর মরুভূমির মধ্যে আর আমাদের নবী মুহাম্মদ (সা.) এর একেবারে সাত তবক আসমানের উপরে আরশে মুয়াল্লায়। আমাদের নবী (সা.) যেহেতু বিশ্বনবী ও শেষ নবী ছিলেন তাই তাঁর দায়িত্ব ও ছিল সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য তাঁর ট্রেনিং ও ছিল সর্বাধিক দামী। তাই তা ছিল বিরাট লম্বা কৌর্যের ও দীর্ঘ সময়ের । আর তাঁর স্থান ও ছিল খোদ রাব্বুল আ‘লামীনের আরশে আযীমে।
শিক্ষণ-প্রশিক্ষণে মি‘রাজ:-
মি‘রাজের শিক্ষাকে মূলত দুইভাগে ভাগ করা যায়। এক. ঘটনাবলী থেকে, দুই. আল্লাহ কর্তৃক রাসুল (সা.) কে প্রদত্ত শিক্ষা । এখানে মিরাজের উভয়বিধ শিক্ষা সংক্ষেপে আলেকপাত করা হলো।
ঘটনাবলী থেকে শিক্ষাঃ-
১ নিজের চেষ্টা সম্পন্ন করে আল্লাহর উপরে ভরসা করা :
রাসূল (সা.) মসজিদে আক্বসা পৌছে মসজিদের পাশে রাখা একটা পাথরের সাথে বোরাক বাঁধলেন। এটা আল্লাহর পাঠানো, তিনি ছেড়ে রাখতে পারতেন, কিন্তু তা না করে নিজের কাজ সম্পন্ন করে তারপর আল্লাহর উপরে ভরসা করেছেন।
২ যোগ্য লোককে নেতা বানানো:- রাসুল (সা.) বায়তুল মাকদাসে নিজে নামাজের ইমামতি করলেন। সেখানে আরো অনেক নবী রাসুল ছিলেন । তাঁর মধ্যে শ্রেষ্ঠ তিনি । এজন্য নিজে ইমাম হয়ে নামায আদায় করলেন। এটা উম্মতের জন্য শিক্ষা।
৩ কোথাও প্রবেশের আগে অনুমতি নেয়া:- জিব্রাইল (আ.) রাসুল (সা.) কে নিয়ে যে আসমানেই গিয়েছেন । প্রত্যেক জায়গায় তিনি অনুমতি নিয়েছেন।
৪ কথা শুরুর পূর্বেই সালাম দেয়া :- রাসুল (সা.) যেখানেই গেছেন সেখানে যার সাথে দেখা হয়েছে। পরিচয় জানার পূর্বে সর্বপ্রথম তিনি সালাম বিনিময় করেছেন।
৫ অজানাকে জানার আগ্রহ থাকা:- রাসুল(সা.) মিরাজ কালে যেখানে কোন অজানা বিষয় দেখেছেন তিনি জিবরাইল (আ.) কে সে বিষয় সম্পর্কে জানার জন্য প্রশ্ন করেছেন।যা উম্মতের জন্য একটা বিশেষ শিক্ষা।
৬ কথা ও কাজে মিল রাখা:- রাসুল (সা.) জাহান্নামে যখন দেখলেন কিছু মানুষের জিহ্বা আগুনের কাঁিচ দ্বারা কাটা হচ্ছে, তখন তিনি প্রশ্ন করলেন এদের এ অবস্থা কেন? তখন জবাব দেয়া হলো এরা দুনিয়ায় নিজে যা বলত, কাজে তা করত না। এটা উম্মতের জন্য শিক্ষা।
৭ জিনা ব্যভিচার না করা:- রাসুল (সা.) বলেন আমি দেখলাম কিছু লোকের সামনে ভাল গোশত রয়েছে । তার পাশে রয়েছে দুর্গন্ধযুক্ত নিকৃষ্ট গোশত । তারা ভালটা রেখে খারাপটা খাচ্ছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম এদের এই অবস্থা কেন? জবাবে বলা হল এরা হচ্ছে সেই সব লোক যারা নিজেদের বৈধ স্ত্রীদের বাদ দিয়ে নিষিদ্ধ নারীদের কাছে যেত।
৮ সুদ দাতা ও গ্রহীতা না হওয়া:- রাসুল (সা.) বলেন আমি কিছু লোক দেখলাম যাদের পেট বিশাল ছিল, যা আমি কখনো দেখিনি। আমি জিজ্ঞেস করলাম এদের এ অবস্থা কেন? জবাবে বলা হল এরা হচ্ছে সূদ খোর।
৯ ভাল কাজের পারিশ্রমিক দ্রুত প্রদান করা:- রাসুল (সা.) জান্নাতের মধ্যে দেখলেন কিছু লোক ফল লাগাচ্ছে এবং দ্রুত ফসল পেঁকে যাচ্ছে। রাসুল (সা.) জিজ্ঞেস করলেন এরা কারা? জবাবে বলা হল এরা দুনিয়ায় ভাল কাজ করেছে । আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করেছে তাদের সে মহৎ কাজের প্রতিফল এটা।
৯ সীমা অতিক্রমকারী না হওয়া :- রাসুল (সা.) যখন জিবরাইল (আ.) সহ সিদরাতুল মুনতাহা পৌছালেন তখন জিব্রাইল (আ.) বললেন এখান থেকে আমি একবিন্দু যেতে পারব না কারণ এটা আমার শেষ সীমানা এর থেকে শিক্ষা হচ্ছে আল্লাহর হুকুম মান্য করা।
১০ ঈমানের অগ্নি পরীক্ষায় অবিচল থাকা:- রাসুল (সা.) জান্নাত- জাহান্নাম প্রদর্শন কালে অত্যন্ত মনোমুগ্ধকর সুগন্ধের ঘ্রাণ লাভ করেন। তিনি বলেন জিবরাইল এটি কিসের সুঘ্রান? জিবরাইল বলেন,্ এ হলো ফিরাউনের কন্যার চুল আঁচড়ানো দাসী ও তার সন্তানদের সুগন্ধ।দাসিটি ঈমানদার ছিল। একবার চুল আঁচড়ানোর সময় চিরুনী পড়ে গেলে সে বিসমিল্লাহ বলে তা তুলে নেয়। ফিরাউন-কন্যা বলে, আমার পিতার নাম নিয়েই না কর্ম শুরু করতে হবে। দাসীটি বলে, তোমার,আমার ও তোমার পিতার রব আল্লাহর নামে। ফিরাউন-কন্যা ক্রোধান্বিত হয়ে তার পিতাকে বিষয়টি জানালো। ফিরাউন উক্ত দাসীকে তাওহীদ ত্যাগ করতে চাপ দেয়। কোনো প্রকার ভয়ভীতিতে দাসীটি বিচলিত হয় না। তখন ফিরাউন অগ্নিকুণ্ডু তৈরী করে দাসীকে বলে। তুমি যদি আমার ধর্মে ফিরে না আস তবে তোমার সন্তানগন সহ তোমাকে আগুনে পুড়িয়ে মারা হবে। দাসীটি ঈমানের উপর অবিচল থাকে। তখন একে একে তার সন্তানদেরকে আগুনে নিক্ষেপ করা হয়। সর্বশেষে তার কোলে ছিল দুগ্ধ পোষ্য একটি শিশু। শিশুটির দিকে তাকিয়ে মায়ের মন দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে।তখন শিশুটির মুখে আল্লাহ কথা দেন। সে তার মাকে বলে মা দ্বিধা করো না।তুমি তো সত্যের উপর রয়েছ। আখিরাতের অনন্ত কষ্ট থেকে বাঁচতে দুনিয়ার কয়েক মুহুর্তের কষ্ট কিছুই নয়। দাসীটি তখন শিশুটিকে নিয়ে আগুনবরণ করে নেয়। তাদেরকে আল্লাহ আখেরাতে এ রূপ মর্যাদা দিয়েছেন।
১১ ফরয সালাত আদায়ে অবহেলা না করা:- রাসুল (সা.) দেখেন কিছু লোক শয়ন করা রয়েছে এবং বিশাল পাথর দিয়ে আঘাত করে তাদের মাথা চুর্ণ বিচুর্ণ করা হচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যে আবার মাথাগুলি স্বাভাবিক হয়ে যাচ্ছে এবং পুণরায় তাদেরকে এভাবে আঘাত করা হচ্ছে ।জিবরাইল (আ.) বলেন .এরা হলো আপনার উম্মতের ঐ সব মানুষ ,যারা ফরয সালাত যথাসময়ে আদায়ে অবহেলা করে যাদের মস্তিষ্ক ফরয সালাত আদায়ের চিন্তা না করে অন্য চিন্তায় রত থাকে।
১২ গীবত না করা:- রাসুল (সা.) দেখেন কিছু মানুষের হাতে পিতলের নখ লাগানো এবং তারা এ নখ গুলি দিয়ে প্রচন্ডজোরে তাদের মুখমণ্ডল ও বক্ষদেশ আঁচড়ে রক্তাক্ত করছে। জিবরাইল (আ.) জানান যে, এরা পৃথিবীতে মানুষদের গীবতে লিপ্ত হতো।
১৩ নামায প্রাপ্তি ও সময়ের জ্ঞান:- মি‘রাজের আর একটি বড় শিক্ষা হচ্ছে উম্মতে মুহাম্মদীর জন্য নামায প্রাপ্তি । যা ৫০ ওয়াক্তের পরিবর্তে ৫ ওয়াক্তে নির্ধরিত হয় এবং সেটা হতে হবে ওয়াক্তমত।বর্তমান উম্মতের জন্য মি‘রাজ হবে না।তবে নামাজের মাধ্যমে সেমি মি‘রাজ সংঘটিত হয়। রাসূল (সা.) বলেন নামায হচ্ছে মুমিনদের জন্য মি‘রাজ স্বরূপ।
আল্লাহ কর্তৃক রাসুল (সা.) কে প্রদত্ত শিক্ষা:-
আল্লাহ তা‘আলা তার প্রিয়তম রাসুল (সা.) কে মিরাজ থেকে বিশেষ কিছু শিক্ষা দিয়েছেন যা আল কুরআনের ১৭ নং সূরা ইসরা বা বনী ইসরাইলে বর্ণিত হয়েছে। যেমন,
১ একমাত্র আল্লাহর গোলামী করা।
২ সর্বাবস্থায় পিতা মাতার সাথে ভাল ব্যবহার করা এবং তাদের সকল অধিকার সংরক্ষণ করা।
৩ আত্মীয় স্বজনদের অধিকার আদায় করা।
৪ অভাবগ্রস্থ ও মুসাফিরের হক আদায় করা।
৫ অপচয় ও অপব্যয় না করা।
৬ কৃপনতা না করা।
৭ দারিদ্রতার ভয়ে সন্তান হত্যা না করা।
৮ জিনা ব্যভিচার না করা।
৯ অন্যায়ভাবে মানুষ হত্যা না করা।
১০ এতিমের মাল আত্মসাৎ না করা।
১১ ওজনে কম না দেয়া।
১২ প্রকৃত সত্যকে জানা এবং সে অনুযায়ী আমল করা।
১৩ গর্ব ও অহংকার করে দুনিয়ায় বিচরণ না করা।
১৪ আল্লাহর সাথে কাউকে শরিক না করা ইত্যাদি, যা মি‘রাজের মধ্যে এ ধরণের পাপের শাস্তি রাসুল (সা.) কে প্রদর্শন করানো হয়।
অতএব ইস্রা ও মিরাজ উপলক্ষে এ সূরার অনুধাবণ ও পর্যালোচনা অতীব প্রয়োজন। মহান আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে তাওফিক দান করুন।
লেখক ও গবেষক