ইসলামী বইকে ঢালাওভাবে জিহাদি বই বলা অমূলক
মানুষের অদম্য জ্ঞানস্পৃহা তাকে অন্যান্য জীব থেকে কেবল আলাদা করেনি বরং শ্রেষ্ঠত্বের স্থানে আসীন করেছে । পৃথিবীতে যত জ্ঞানী-গুনীর পরিচয় পাওয়া যায় তাদের সকলের প্রধান বন্ধু ছিল বই । বই মানুষকে অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয় । বইকে যারা আপন করেছে তারা নিজেরাই শুধু উপকৃত হয়নি বরং আলোকিত করেছে গোটা জগতকে । বইয়ের স্পর্শ ব্যতিরেকে জ্ঞানের তপস্যা অসম্ভব । অজানাকে জানার কৌতুহল পূরণ করতে পারে কেবল বই । বেঁচে থাকতে মানুষের যেমন খাদ্য গ্রহন দরকার তেমনি আত্মাকে বাঁচিয়ে রাখতে প্রয়োজন বই । পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে চষে বেড়ালেও এমন একজন মানুষকে বোধ করি খুঁজে পাওয়া যাবে না যিনি ব্যক্তিগতভাবে ন্যূণতম একটি বইয়ের মালিক নন । বিখ্যাত মার্ক টোয়েনের মত হাজারও মানুষের উপমা পাওয়া যায় যাদের ব্যক্তিগত লাইব্রেরীতে এত অধিক সংখ্যক বই ছিল কিংবা আছে যা একজন মানুষ তার সমগ্র আয়ুতে পাঠ শেষ করতে পারবে না । মানুষকে নতুন নতুন জ্ঞান রাজ্যের সন্ধান দিতে যে সকল লেখকরা দিন রাত একাকার করে তাদের সৃজনশীল লেখা ধরবাসীকে উপহার দিয়ে যাচ্ছেন তাদের ঋণ বোধহয় শোধ দেবার নয় । অতীতের বৃহৎ কিংবা ক্ষুদ্র পান্ডুলিপি সাজিয়ে বাঁধাইকৃত বইয়ের সাথে বর্তমানে জ্ঞানের রাজ্যকে বিস্তৃত করতে নিত্য যোগ হচ্ছে হাজার হাজার ই-বুক । দিন যত গড়াবে মানুষের কাছে বই বিষয়ক ধারণাও ততো বদলাবে ঠিক কিন্তু অজানাকে জানার কৌতুহল নিত্য বেড়েই চলবে । কালি, কলম ও কাগজের যায়গাটা নিশ্চয়ই কিবোর্ড, মনিটর এবং ইন্টারনেট দখল করবে কিন্তু জ্ঞান অর্জনেরর বিকল্প কিছুর আগমনের কোন সম্ভাবনা নাই । বিশ্বের যতগুলো জাতি আজ ধনে উন্নত তারা সর্বপ্রথম জ্ঞানে উন্নতি করেছিল । জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে প্রতিষ্ঠা ও স্বতন্ত্র পরিচিতি পেতে জ্ঞান অর্জনের বিকল্প কোন পথ নাই । সভ্য জাতি দাবী করার পূর্বশর্ত জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে জ্ঞানী হওয়া । ভলতেয়ার বলেছিলেন, ‘সে দেশ কখনো সভ্য বলে নিজেদেরকে দাবী করতে পারবে না যতক্ষন না তারা বেশিরভাগ অর্থ চুইংগামের পরিবর্তে বই কেনার কাজে ব্যবহার করবে’ । বই কেনার অর্থই জ্ঞানী হওয়া নয় । কেননা তাই যদি হত তবে দেশের প্রতিটি বই প্রকাশনার মালিক, লাইব্রেরীর বই বিক্রেতা কিংবা গ্রন্থাগারে বইয়ের তাকের পাহারাদার সবচেয়ে বেশি জ্ঞানী হতেন । তবে জ্ঞানী হওয়ার জন্য শুধু বই কেনা নয় বরং পড়তেও হবে । বই হচ্ছে বিশ্বাস যোগ্য আয়নার মত যাতে মানুষের মনের প্রতিবিম্ব ধরা পড়ে । যে কক্ষে বই নেই সে কক্ষকে আত্মাবিহীন দেহের সাথে তুলনা করা চলে । তাইতো বলা হয়, এককালে পৃথিবী বইয়ের উপর কাজ করত এখন বই-ই পৃথিবীর উপর কাজ করে ।
জঙ্গিবাদ কিংবা ধর্মীয় উগ্রতা বর্তমান বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় হুমকি । রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার সুযোগে দিন দিন এরা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার সুযোগ পাচ্ছে । মাঝে মাঝে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যের হাতে তারা পাকড়াও হয় । আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে তখন প্রকাশ করা তাদের কাছ থেকে বিপুল সংখ্যক জিহাদি বই উদ্ধার করা হয়েছে । জিহাদি বইয়ের মূল সংজ্ঞা কি তা জানা না থাকলেও সকল প্রকার ইসলামি ভাবধারায় লিখিত বইকে কিংবা আরবীতে লেখা সাহিত্য-ইতিহাসের বইকেও জিহাদি বই বলে প্রচার চালানো নয় । দেশের তথাকথিত কিছু ইসলাম বিদ্বেষী মিডিয়াসহ প্রায় প্রত্যেকটি প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক্স মিডিয়ায় জিহাদি বই উদ্ধারের সংবাদ চড়াও করে প্রচার-প্রকাশ করা হয় । সর্বশেষ আশুলিয়ার ব্যাংক ডাকাতিতে জড়িত যে ডাকাতদের গ্রেফতার করা হয়েছে তাদের রুম থেকেও অসংখ্য জিহাদি বই উদ্ধার করা হয়েছে বলে টিভি ও পত্রিকায় এসেছে । টিভিতে যখন এ বিষয়ক সংবাদটি দেখছিলাম তখন দেখলাম উদ্ধারকৃত জিহাদি বইয়ের স্তুপের অসংখ্য বই ! তার মধ্যে ‘তাজকেরাতুল আউলিয়া’ নামক বইটিতে চোখ আটকে গেল । আরও যে সকল বই ছিল তার মধ্যে সে অর্থে উগ্রবাদীদ বিষয়ক লেখা কোন বই চোখে বাঁধে নি । তখন থেকে ভাবছিলাম তাজকেরাতুল আউলিয়া কিংবা এ জাতীয় বই জিহাদি বই হল কিভাবে ? প্রশাসনের ভাষ্যমতে এগুলো যদি সত্যিকারার্থেই জিহাদি বই হয় তবে তো এদেশের সকল মুসলমান মুজাহিদ । ঢালাওভাবে ইসলামিক ভাবধারার সকল বইকে জিহাদি বই বলে প্রচার চালানোর প্রয়াস কি অজ্ঞতার কারণে নাকি ইসলামের প্রতি বিদ্বেষাত্মক মনোভাব থেকে সে বিষয়টি পরিস্কার হওয়া দরকার । কেননা সকল ইসলামিক বইকে যদি ঢালাওভাবে জিহাদি বই বলে প্রচার করার প্রবনতা বর্তমান সময়ের মত চলতে থাকে কিংবা বৃদ্ধি পায় তবে তা ভবিষ্যতের জন্য মোটেই শুভ বার্তা বহন করবে না এবং জিহাদি বই সংক্রান্ত এমন সংবাদ বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে চরমভাবে ক্ষুন্ন করতে থাকবে ।
জিহাদি বই বিষয়ক ধারণাটি ইসলাম বিদ্বেষী চক্রান্ত থেকে আমাদের সামনে উপস্থিত হয়েছে এবং আমরা বিনা-বিচারে সেটা ধারণ ও প্রচার করছি । ভারতের পশ্চিমবঙ্গ এবং আশপাশের এলাকার মুসলমানদেরকে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য স্থানীয় পুলিশ সর্বপ্রথম জিহাদি বই উদ্ধার তত্ত্বের সূত্রাপত ঘটায় । মধ্যপ্রাচ্য তথা আরব বিশ্বের ওপর পশ্চিমা আগ্রাসন থেকেও জিহাদি বই উদ্ধারের কিছু ঘটনা প্রকাশ পায় । বাংলাদেশে ইসলামিক বইকে জিহাদি বই বলে প্রচার চালানোর ঘটনা ঠিক কাদের স্বার্থে সেটা এখনো ততোটা স্পষ্ট না হলেও ৯২ ভাগ মুসলিম অধ্যুষিত দেশের প্রশাসন সকল ইসলামী বইকে ঢালাওভাবে জিহাদি বই বলে প্রচার চালাবে; এটা দুঃখ জনক । মনে রাখা উচিত, কোন বইতে আরবী বর্নমালা বা আরবী বাক্য থাকলেই সেটাকে জিহাদি বই বলে প্রচরণা চালানো অসুস্থ মানসিকতার পরিচয় বহন করে । ধর্মকে অপব্যাখ্যা করে কিছু কিছু স্বার্থান্বেষী ব্যক্তি বা মহল অপব্যাখ্যামূলক কিছু বই লিখেছেন যা মানবতার জন্য হুমকিস্বরূপ । তাই বলে সকল ইসলামী বইকে জিহাদি বই বলার প্রবনতা কেন ? জিহাদি বই নিয়ে প্রশাসনের এত মাথা ব্যথা তবু কেন তারা জিহাদি বই সমূহের একটি তালিকা করে তা সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়ে সেগুলো ক্রয় ও পঠন থেকে বিরত থাকার অনুরোধ এবং সে বইগুলো মুদ্রন ও বিক্রি নিষিদ্ধ করার ব্যবস্থা করছে না । ইসলামী ঘারাণার সকল বইসমূহকে ঢালাওভাবে জিহাদি বই বলে অপপ্রচার চালানোয় ক্ষমতাশীনদের প্রতিও মানুষের নৈতিবাচক মনোভাব জন্মে; এটা তাদেরকে বুঝতে হবে । জঙ্গি ও ডাকাতদের কাছ থেকে উদ্ধারকৃত কথিত জিহাদি বইয়ের কিছু কিছু বই ইসলামি ফাউন্ডেশন থেকে প্রকাশিত । ইসলামি ফাউন্ডেশন যেহেতু সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় চলে সুতরাং এ সকল বই যদি জিহাদি বই হয় তবে এ জাতীয় বইয়ের ব্যবসায় সরকারও জড়িত বললে অযৌক্তিত দাবী তোলা হবে ? পৃথিবীর সকল ধর্মেই কিছু না কিছু উগ্রপন্থির সৃষ্টি হয়েছে তাই বলে এজন্য ধর্মকে দায়ী করা চরম মূর্খতার সামিল । উগ্রপন্থিদের দমন করা শাসকদের দায়িত্ব কিন্তু সাধারণ মুসলমানের বিশ্বাস ও মূল্যবোধে আঘাত করা উচিত নয় । কোন খুনীর কাছে সেক্সপিয়রের রচনাসামগ্রী পেলে সেই খুনীকে খুন কর্মে উৎসাহিত করার কারণ হিসেবে সে বইকে যেমন দায়ী করা যায়না তেমনি কোন খুনীর কাছে ইসলামী ভাবধারার কোন বই পেলেও খুনের কারণ হিসেবে সেই বইগুলোকে দায়ী করা অজ্ঞতার নামান্তর । বইয়ের শিক্ষা মানুষকে অবশ্যই প্রভাবিত করে কিন্তু তাজকেরাতুল আউলিয়া কিংবা ইসলামী ফাউন্ডেশন প্রকাশিত কোন বই অপরাধীকে বোমা তৈরিতে, নিক্ষেপ করতে কিংবা ব্যাংক ডাকাতির মত জঘন্য কর্মে উৎসাহিত করবে, শিক্ষা দিবে এ কথা চরম সমালোচক ও জঘন্য শত্রুও বলতে পারে না ।
সুতরাং প্রশাসন এ ব্যাপারে যথেষ্ট আন্তরিকতার পরিচয় দিবে বলে আশা রাখি । ঢালাওভাবে সকল ইসলামি বইকে জিহাদি বই বলার গর্হিত প্রবনতা ত্যাগ করার উদাত্ত আহ্বান জানাই । যে সকল বই শান্তিপূর্ণ ইসলামের অন্তরায় সে বইয়ের তালিকা করে তা স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধ করা হলেই সম্ভবত সমস্যার সমাধান হবে । অযথা সাধারনণ মুসলামের অন্তরে আঘাত ও অযথা বিরূপ ধারণা সৃষ্টি করে বোধহয় কোন পক্ষেরই ক্ষতি ছাড়া উপকার নাই । ইসলামের প্রতি বিদ্বেষ কিংবা অজ্ঞতা পরিহার করে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের জন্য আন্তরিকতা দেখানো সময়ের দাবী । ইসলাম ও মুসলমানের নামে অপবাদ ও দুর্নাম রটিয়ে যদি অন্য কোন বৃহৎ শক্তির মদদ প্রাপ্তির মানসিকতা থাকে তবে তাও পরিহার করা উচিত । বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ট মানুষের হৃদয়ের ভাষা বোঝার মত দক্ষতা তৈরি হওয়া বাঞ্ছনীয় । বই নিয়ে যেন কোন কোন্দলের সৃষ্টি করা না হয় সেজন্য সজাগ ও তৎপর হতে হবে । বই আত্মার খোরাক । সে খোরাক সাধারণ বই থেকে যেমন পূর্ণ হতে পারে তেমনি ইসলাম বিষয়ক কিংবা ধর্ম বিষয়ক বই দ্বারাও পূর্ণতা পেতে পারে । সকল প্রকার কলুষতা দূর করে মনের উন্নতি ঘটাতে বইয়ের বিকল্প নাই । দেশের মানুষকে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে পারে একমাত্র বই । সাধারণ বইয়ের চেয়ে ধর্মীয় বই মানুষকে বহুগুন বেশি নীতি-নৈতিকতা শিক্ষা দেয় । সুতরাং মানুষের মনের ভীতি দূর করে ধর্ম বিষয়ক বই বাধাহীন-অবারিত সুযোগ সৃষ্টি করে দেওয়া রাষ্ট্রের দায়িত্ব । একটি শান্তিপূর্ণ, সোনার সম্মৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে দায়িত্বশীলদের প্রতি এ কর্তব্যটুকু পালনের বিনীত অনুরোধ রাখছি । টলস্টয়ের মত যেন আমরাও বলতে পারি, ‘জীবনে মাত্র তিনটি জিনিসের প্রয়োজন বই, বই এবং বই’ ।
রাজু আহমেদ । কলামিষ্ট ।
মঠবাড়ীয়া, পিরোজপুর
০১৭২৮৪৬৫৪৫৫
[email protected]