ভাগ্যে জুটলেও ভাড়ারে ধরলো না
আব্দুল আজিজ তকি: ভাগ্যে জুটলো কিন্তু ভাড়ারে ধরলো না। বিধাতার কৃপায় ব্রিটেনের বুকে প্রথম বাঙালি মুসলমান কার্য্যনির্বাহী মেয়র হয়ে (২০১০ ইংরেজী) ইতিহাস তৈরী করে লুৎফুর রহমান আমাদের বুকটা আনন্দে আর গর্বে ভরে দিয়েছিলেন। বার বার যে দেশটাকে দুর্নীতিতে দুর্দশাগ্রস্ত বলে আখ্যায়িত করা হয় সেই দেশের বংশজাত ছেলে শির উঁচু করে দাঁড়াতে পারলে কার না বুকটা ভরে। এমন একটা দুর্লভ প্রাপ্তীতে আমরা হাত তালি দিয়ে কান তালি লাগিয়েছি। বিজাতিরাও সেই খুশীতে শরীক হয়েছে। কিন্তু কে জানতো এই খুশী, এই সুখ যে আমাদের বেশী দিন সইছেনা। দেশের মাটিতে যাই হোক না কেন বিদেশের মাটিতেও যে আমরা আবার মাথা হেট করে টাওয়ার হেমলেটের রাস্তাঘাটে ইজ্জৎ হুরমতকে জলাঞ্জলী দেব ভাবতেও কষ্ট লাগে। ব্রিটেনের আদালৎ কলমের একটা খোঁচায় লুৎফুর রহমানের সকল প্রাপ্তীকে এক ধাক্কায় শুন্যের কোটায় পৌছে দিলো। বরবাদ হল লুৎফুর রহমানের জীবনের সকল কামাই। রয়েল কোর্ট অব জাষ্টিস এর অভিজ্ঞ বিচারক রিচার্ড মাওরে (Mr Richard Mawrey) ২৪শে এপ্রিল ২০১৫, লুৎফুর রহমানকে এই বলে চিহ্নিত করলেন ‘a pathological liar who had driven a coach and horses through the law.। বিজাতির কাছে আমাদের মুখটা শুধু ছোটই হলনা, জাতিয় ভাবে বাঙালি মুসলমানেরাও হল তিরস্কৃত।
লুৎফুর রহমান দোষী হলেন। এমন দুঃখে বাঙালিদের চোখের জল আপনিতে ঝরবে সেকথা আপনি আমি জানি। আরো জানি, এই রায়ের ফলে অনেকের চেহারায় আনন্দেরও দোলা লাগবে। তবে মান-সম্মান আর ইজ্জতের প্রশ্নে উভয় পক্ষকে আফসোস করতেই হবে। হলে কি হবে, চোখের জল যেভাবে বুকের বলকে কমিয়ে দিয়ে একটা মানুষকে দূর্বল করে দেয় ঠিক তেমনি আমাদের মান সম্মানটা আজ ধুলিস্যাৎ হয়ে আমাদের পথে নামিয়ে দিল। আর সাবান সোডা দিয়ে ধুয়ে মুছে সাফসুতরো করা যাবে না।
বিশ্বের সব নামকরা পেপার পত্রিকার প্রথম পাতায়, টেভিশনের পর্দায়, রেডিওর সম্প্রচারে বিষয়টি নিয়ে বিস্তর বলাবলি লেখালেখি চলছে। উনিশ শতকের পরে নাকি ব্রিটেনে তিনিই প্রথম ব্যক্তি যিনি ধর্মীয় প্রভাব খাটিয়ে ক্ষমতায় যাওয়ার অনৈতিক অপরাধে দোষী ও ধিকৃত। আদালতের রায় বাঙালির মুখে চুনকালি আর কপালে কলংক তিলক লাগিয়েছে। কিন্তু এত বড় ঘটনাটা কেমনে ঘটলো জানতেই হয়। জর্জ বার্ণার্ড শো (George Bernard Shaw) বলেছিলেন ‘An election is a moral horror, as bad as a battle except for the blood; a mud bath for every soul concerned in it.’। (নির্বাচন একটা নৈতিক আতঙ্ক, একটা রক্তপাতহীন যুদ্ধের ন্যায় কাদার ভিতর সকল বিজোড়িত আত্মার সন্তরণ)। আমার মনে হয় লুৎফুর রহমান নৈতিক সেই আতঙ্কের যায়গাটা সঠিকভাবে বুঝতে পারেননি। যে কারনে একদল অতি উৎসাহি লোক তাঁকে মাথায় তুলে মগডালে বসিয়ে ছিল । এরা নির্বাচনী উৎসাহটাকে উৎসবে পরিনত করে, ১০১জন ইমামদের দস্তখত সংগ্রহ করে লিফলেট ছাফিয়ে, ইসলামিক সাজসয্যার নারী পুরুষদের নিয়ে দল বাধিয়ে যে সকল কান্ডকীর্তি করলো সেটা অনেকের কাছেই ছিল দৃষ্ঠিকঠোর, অবাঞ্চিত ও অশুভ। বলবেন নির্বাচনে সকলের অংশ গ্রহনের অধিকার আছে। আমিও বলি অবশ্যই। তবে ধর্মের ডাকঢোল নিয়ে কোমরে কাপড় পেচিয়ে হৈ হৈ রৈ রৈ করার কী কোন দরকার ছিল?
দ্বিতীয়বারের নির্বাচনে যাওয়ার সময় লুৎফুর রহমানের বুঝা উচিৎ ছিল যে তিনি একটা রক্তপাতহীন যুদ্ধে লীপ্ত। উপর্যুপরি এ যুদ্ধে যে সকল সৈন্য সামন্ত তা’র হাতের কব্জি ধরে মগডালে বসিয়ে রাখছে এরা ব্রিটিশদের সুনজরে নয়। একদল মুসলমান তাবৎ দুনিয়ায় জেহাদিগুষ্ঠি নামে পরিচিত এবং বর্তমান বিশ্বের আতঙ্ক। তাদেরকে ভাল নজরে কেউই দেখছে না। আগেবাগেই লুৎফুর রহমানের রাস্তা মাফা উচিৎ ছিল। কেন বলছি প্রমান দেই। জর্জ গ্যালওয়ে ইরাক যুদ্ধের পর লেবার পার্টি থেকে সরে গিয়ে রেসúেক্ট পার্টির নাম দিয়ে মুসলমানদের সেই নাড়ির যায়গাটাতে ঢুকে ডুগডুগি বাজিয়ে ঠিকই এম পি বনে গেলেন। কিন্তু তিনি জানতেন এমন যায়গার খুটি খুব নড়বড়ে। চালাক লোক, হেলে যাওয়ার আগেই দিলেন চম্পট। সেই একই দাবার চাল খেলে তিনি আরেকটা মুসলিম অধ্যুষিত এলাকা ব্রাডফোর্ডের এমপি বনেছেন। মনে রাখা ভাল ধর্মের দোহাই দিয়ে দশজন ধার্মিক ব্যক্তিকে বুকে ঠানা যায় তবে রাজনীতির মাঠে এ নিয়ে ঠিকে থাকা যায় না। ধর্মের রাজনীতি করতে হলে রক্ত দিতে হয় আর এমনটি অন্ততঃ ইউরোপের মাটিতে এখন চিন্তাই করা যায় না। শত শত বছর আগের ইতিহাসে এমন ঘটনা বিধৃত হয়েছে তবে এমন ঘটনার এমন কোন পুনরাবৃত্তি এখনি যে হবে তার কোন আবাস ইঙ্গিত কোথাও নেই।
লেবার পার্টির মানুষ ছিলেন লুৎফুর রহমান। পার্টি তা’কে ২০১০ সালে নমিনেশন দিয়ে পরে সেটা কেড়ে নেয়ায় দুঃখ পেয়েছিলেন। পার্টি থেকে নিজেকে বিচ্যুত করে মেয়র নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছিলেন। দরবারের সুত্রপাত সেখান থেকে। হয়তো অবিচার হয়েছিল কিন্তু সেই অবিচারের জবাব প্রথম নির্বাচনেইতো হয়ে গেল। তখন নির্বাচনে জেতার ব্যাপারে যতকিছু করা হল সবটুকু কুল্লে হালাল হলেও হারাম অংশটুকু সর্বদা ছিল অদৃশ্যমান। দ্বিতীয়বারের নির্বাচনে কিন্তু এমনটি ধরে রাখা গেল না। ফলে নির্বাচনী দাবার চালটা যে নিজের জীবনের কাল হবে সেটা লুৎফুর আঁচ করতে পারলেন না। এমনটি ধরতে পারলে নির্ঘাৎ এ অঘটন ঘটতো না। সাংবাদিক আন্দ্রে জিলিগান (Andrew Gilligan) ও পেনরামা অনুষ্ঠানের জন (John) বিষয়টা অনেক আগেই চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিলেন। কোনভাবেই বিষয়টার প্রতি বুড়ো আঙ্গুল দেখানো সঠিক হয়নি।
কেন লিভিংশটনের (Ken Livingston) মত তুখোড় নেতা লন্ডনের মেয়র নির্বাচনে লেবার থেকে বের হয়ে নির্বাচনে জিতে ছিলেন কিন্তু দ্বিতীয়বার সেই নেতাই লেবারের টিকিট নিয়ে আবার নির্বাচনে গিয়েছিলেন। কেনের (Ken Livingston) আক্কেল বুদ্ধি কম থাকলে কি তিনি সে কাজটি করতেন! সমর্থন করলেই যে সামর্থের বস্তাটা সমর্থকদের ঘাড়ে তোলে দিতে হয় সেটা বাংলাদেশের রাজনীতিতে দেখা গেলেও ব্রিটেনে এমনটি নেই। লুৎফুর রহমান কেন এ বিষয়টাতে গুলপাকালেন বুঝতে কষ্ট হয়। জনগন যাই বলাবলি করুক, আদালতে প্রমান করা হল নির্বাচনে লুৎফুর রহমান এবং নিজ দলের সমর্থকরা খুবই গর্হিত কাজ করেছেন। গত বছরের মেয়র নির্বাচনে দুর্নীতি ও ভয়ভিতি দেখিয়ে গণতন্ত্রের ভিতর পচন ধরিয়ে দিয়েছেন। যারা নির্বাচনে সাহায্য করেছে তা’দেরকে বিভিন্নভাবে টাকা পয়সা দিয়ে পুরুস্কৃত করা হয়েছে। বর্ণবাদকে ব্যবহার করে প্রচারনা করা হয়েছে।
বিষয়টির পক্ষে বিপক্ষে নানা মত অভিমত চলছে এবং আরো অনেকদিন চলবে। হয়তো লুৎফুর রহমান জুডিসিয়েল রিভ্যিউ এর সুযোগ পাবেন তবে যা হবারতো হয়ে গেল। আমরা সেখান থেকে ফিরে আসতে হলে খুবই সন্তর্পনে এগুতে হবে। কারণ আমাদের বংশধর অনুজরা এই লন্ডনের মাটিতেই বড় হচ্ছে। এখানকার শিক্ষাদীক্ষায় তাল মিলিয়ে এগিয়ে চলছে। ধর্মকর্ম নিয়ে তাঁরা বাঁচুক আমরা খোলা মনে সেই আকাঙ্খা করি তবে বাড়াবাড়ির বেলেল্লাপনা যেন এদেরকে ঘ্রাস না করে। তা’রা ভবিষ্যতের সুন্দর স্বপ্ন দেখবে। কোনভাবেই তা’দের সেই স্বপ্নের মাথায় যেন আমরা কুড়াল না মারি। সঠিক ধর্ম জ্ঞাণ দেই। পর্দার আড়াল থেকে উকিঝুকি মেরে বিরুপ ধর্মীয় ফতোয়া ফরমায়েস দিয়ে যেন তা’দের মন মানসিকতাটাকে অভিষপ্ত না করি। আমাদের এই উত্তরসূরীদের মাঝে দুর্নীতি আর দুরাচার ঢুকিয়ে দিয়ে লুৎফুর রহমানের মত যেন তা’দের জীবনটাকে বরবাদ না করি। না হলে এভাবে ভাগ্যে অনেক কিছু জুটবে কিন্তু ভাড়ারে ধরবে না।