ভারতে বাংলাদেশী নার্গিসকে ধর্ষনের পর কিডনি বিক্রি করে ৪১ দিন পর লাশ ফেরৎ
সুরমা টাইমস ডেস্কঃ ভারতে বেড়াতে গিয়েছিলেন নার্গিস বেগম (৩৪)। সঙ্গে অন্ধ মা ও কন্যা। আজমীর শরীফ যাওয়ার পথে দিল্লিতে চলন্ত ট্রেনে ধর্ষিত হন তিনি। শুধু ধর্ষণ করেই ক্ষান্ত হয়নি ধর্ষকরা তাকে হত্যা করে। গতকাল সকালে নার্গিস লাশ দেশে এসে পৌঁছে। বাদযোহর খুলনা মহানগরীর কেডিএ জামে মসজিদে জানাজা শেষে বসুপাড়া কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে। এর আগে জন্মান্ধ আনোয়ারা বেগমের একমাত্র মেয়ে নার্গিস বেগমের লাশ খুলনার সোনাডাঙ্গা থানার ৩/১, কেডিএ অ্যাপ্রোচ রোডের বাড়িতে এসে পৌঁছালে আত্মীয়-স্বজনের আহাজারীতে এলাকার পরিবেশ ভারী হয়ে ওঠে। নার্গিস বেগমের মৃত্যুতে গোটা এলাকায় শোকের ছায়া নেমে আসে। নিহতের একমাত্র মেয়ে জাগরণী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্রী কাকলী আক্তার কাকন কাউকে দেখলেই শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকাচ্ছে আর চোখ দিয়ে অঝোরে পানি পড়ছে। সে এখন কাকে মা বলে ডাকবে। এদিকে নার্গিসের নিথর লাশ হাত বুলিয়ে নির্বাক হয়ে পড়েছে তার মা। নার্গিসের অন্ধ মা বার বার বলছিলেন, একমাত্র মেয়ের নির্যাতনের বিচার কি পাবো কোন দিন? আমি আমার মায়ের হত্যার বিচার চাই। আর্তনাদ করে অন্ধ মা বলেন, কি দোষ ছিল আমার মেয়ের। তাকে কেন ভারতে গিয়ে লাশ হয়ে ফিরতে হলো। তিনি মানবাধিকার সংগঠনসহ সরকারের কাছে এর বিচার দাবি করেন।
এলাকাবাসী জানায়, গত ৯ই মার্চ যশোর বেনাপোল বন্দর দিয়ে পাসপোর্টযোগে ভারতের খাজা বাবা মঈনুদ্দিন চিশতী (রঃ) রওজা আজমীর শরীফের উদ্দেশ্যে আনোয়ারা বেগম ও তার মেয়ে নার্গিস বেগম ও নার্গিসের একমাত্র মেয়ে কাকন রওনা হয়। কলকাতা হাওড়া থেকে তারা ট্রেনে ওঠে। ১০ই মার্চ রাত সাড়ে তিনটার দিকে কানপুর স্টেশনে নেমে পড়ে তারা তিনজন। ট্রেনে থাকা লাগেজ নিতে গিয়ে নার্গিস আর ফিরতে পারেনি। লাল পতাকাবাহী ট্রেনের বগিতে থাকা গার্ডরা তাকে কাপড় দিয়ে মুখ চেপে বগিতে তুলে ট্রেনটি ছেড়ে দেয়। এ সময় তার মা ও কন্যা চিৎকার দেয় ‘ওকে বাঁচান’ ‘ওকে ছেড়ে দেন’- কেউ তাদের চিৎকারে এগিয়ে আসেনি। কয়েকদিন ধরে সেখানে বসে কাঁদতে থাকে আর মানুষের কাছে তার মেয়ের খোঁজ-খবর নেয়। অনেকে বলে তোমার মেয়ে বাংলাদেশে চলে গেছে। ১৬ই মার্চ নার্গিসের মা ও দশ বছর বয়সের নাতনীকে বাংলাদেশে পাঠায় সংঘবদ্ধ চক্রের সদস্যরা। ছয়দিন পর হঠাৎ করে খুলনার সোনাডাঙ্গা মডেল থানার ওসি মারুফ আহমেদ জানান, আনোয়ারা বেগমের মেয়ে ভারতে মারা গেছে। লাশের সাথে তিনটি পাসপোর্ট পাওয়া গেছে।
নিহত নার্গিসের মামাতো ভাই মিলন হোসেন খান জানান, ডাক্তার দেখানোর জন্য ধার-দেনা করে তার ফুফু আনোয়ারা বেগম, আনোয়ারার মেয়ে নার্গিস বেগম ও তার মেয়ে কাকন তিনটি পাসপোর্ট করেন। পরে ভিসা লাগিয়ে গত ৯ মার্চ তারা ভারতে যান। হাওড়া স্টেশন থেকে ট্রেনে দিল্লির উদ্দেশ্যে রওনা হন। রাত সাড়ে ৩ টার দিকে ৪/৫ জন যুবক তাদের বলেন দিল্লি এসে গেছি, সবাই নামেন। এ সময় সবাই ট্রেন থেকে নেমে যায়। পরে নার্গিস বেগম তার মাকে বলল ট্রেনে ব্যাগ ফেলে এসেছি। ব্যাগটি আনতে যাওয়ার সময় কারা যেন নার্গিসের মুখ চেপে ট্রেনে উঠিয়ে নিয়ে যায়। তার মা আনোয়ারা বেগম বলেন, আমি একজন অন্ধ মানুষ, চোখে দেখি না। কেবল মেয়ের গোঙানোর চিৎকার শুনতে পেয়ে হাঁউমাউ করে কাঁদতে থাকি। ততক্ষণে ট্রেন ছেড়ে চলে যায়। সকাল হলে আমি কোথায় আছি তা স্টেশন এলাকায় জিজ্ঞাসা করলে জানতে পারি কানপুর স্টেশনে আছি। আমাদের তিনটি পাসপোর্টই ছিল নার্গিসের কাছে। বলতে বলতে হতভাগি মা কাঁদতে কাঁদতে বারবার মূর্ছা যাচ্ছিলেন। তিনি বললেন, মৃত্যুর সংবাদ শুনে দীর্ঘদিন ধরে দেশের বড় বড় অফিসে আবেদন করেছি আমার মেয়ের লাশটি ফেরত এনে দেয়ার জন্য। অবশেষে এক মাস ১০দিন পর দু’দেশের অনুমতিতে লাশটি দেশে আনা হলো। এ সময় তিনি আরো বলেন, আমার মেয়েকে ভারতের দুর্বৃত্তরা ধর্ষণের পর মেরে ফেলেছে। আমি এ হত্যার বিচার চাই। ১৯শে মার্চ খুলনার সোনাডাঙ্গা থানায় ক্ষতিপূরণসহ লাশ ফেরতের দাবিতে জিডি করেন আনোয়ারা বেগম। সেদিন খুলনা মেট্রোপলিটন বিশেষ শাখার পুলিশ সুপারের দপ্তর-৪৬/৯৩ স্মারকে জানায়, নতুন দিল্লিতে বাংলাদেশ হাইকমিশন থেকে বাংলাদেশী নারীর লাশের বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে। ৩০শে মার্চ বাংলাদেশ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, আইন মন্ত্রণালয়, হাইকমিশনসহ বিভিন্ন দপ্তরে কপির অনুলিপি পাঠানো হয়। খুলনা বিশেষ পুলিশ সুপার বরাবরও আবেদন করা হয়। আগ্রা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মর্গ থেকে ফোনে নিহতের পরিবারের কাছে লাশ হস্তান্তরের ৫ লাখ টাকা চাওয়া হয় বলে জানান নিহতের মামী রাহেলা বেগম।
নার্গিস বেগম খুলনা মহানগরীর ৩/১ কেডিএ অ্যাপ্রোচ রোডে বিধবা মা আনোয়ারা বেগম ও তার একমাত্র মেয়ে কাকনকে নিয়ে বসবাস করতেন। আর নার্গিস বেগমের রাজমিস্ত্রি স্বামী আবুল কালাম একই এলাকার ইব্রাহিম মিয়া সড়কের খলিল শেখের বাড়ির ভাড়াটিয়া।
অ্যাপ্রোচ রোডের বাসিন্দা নিহতের মামী রাহেলা বেগম জানান, মায়ের চোখ ভাল হওয়ার আশায় নার্গিসের প্রথমে আজমীর শরীফ যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল। পরে ডাক্তারের কাছে যেতে চেয়েছিল। ৯ই মার্চ তারা তিনজন খুলনা থেকে রওনা হন। বেনাপোল দিয়ে কলকাতা পৌঁছে সেদিনই। শিয়ালদা স্টেশন ঘুরে হাওড়া পৌঁছায় রাতে। দিল্লির টিকেট নিতে গেলে স্টেশন থেকে জানানো হয়, পরদিন সকাল ১০টায় ট্রেন। তারা স্টেশনেই রাত কাটান। সকালের ট্রেনে দিল্লি রওনা হন। সন্ধ্যার পর নার্গিস ট্রেনের অন্য যাত্রীদের দিল্লি স্টেশন এলে তাদের জানানোর অনুরোধ করেন। রাত ৩টার দিকে কয়েকজন ঘুমন্ত নার্গিসকে ডেকে বলে আপনাদের স্টেশন এসে গেছে নামেন। নার্গিস তার মা ও মেয়েকে নিচে নামান। তারপর ব্যাগপত্র নেয়ার জন্য আবার ট্রেনে উঠলে কয়েকজন তার মুখ চেপে ধরে ফেলে দেয়। ছোট্ট কাকলী এ দৃশ্য দেখে চিৎকার করে, নানী মাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কারো সাহায্য চাওয়ার আগেই ট্রেন স্টেশন ছেড়ে চলে যায়। তারা সেখানে একদিন কান্নাকাটি করে কাটায়। ভাষা সমস্যায় কিছু বোঝাতেও পারে না কাউকে। ফলে স্টেশন মাস্টারসহ লোকজন তাদের পাগল সাব্যস্ত করে কলকাতা অভিমুখী ট্রেনে তুলে দেয়। শিয়ালদা স্টেশনে পৌঁছে তারা প্রায় অনাহারে ২/৩ দিন কাটান। অন্ধ আনোয়ারা মেয়ের খোঁজ জানতে চান সবার কাছে। একপর্যায়ে লোকজন তাকে ট্রেনে বনগাঁ পাঠায়। সেখান থেকে তারা কিভাবে খুলনা আসেন তা বলতে পারেন না। রাহেলা বেগম জানান, আমরা তাদের প্রায় উন্মাদ অবস্থায় ফিরে পাই। এরপর ১৯শে মার্চ সোনাডাঙ্গা থানার ওসি আমাদের ডেকে ভারতে নার্গিসের লাশ পাওয়ার খবর জানান এবং সেখানেই তার দাফন করা হবে কিনা জানতে চান। আমরা সরকারিভাবে তার লাশ ফেরত আনা এবং ক্ষতিপূরণ পাওয়ার আবেদন করি। সে অনুযায়ী সোমবার সকাল সাড়ে আটটায় বেনাপোলে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ নার্গিসের লাশ হস্তান্তর করে।
নার্গিসের মৃত্যুর খবর বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে দিল্লি হাইকমিশন ফ্যাক্স দিয়ে জানায় ১৬ই মার্চ। তাতে এবং ভারতের উত্তর প্রদেশের ফিরোজাবাদ জেলার পুলিশ সুপারের রিপোর্টে দেখা যায় ১৩ মার্চ আনুমানিক ১৪.৪৫ মিনিটে ভদান রেলস্টেশন থেকে ৩ কিলোমিটার পশ্চিমে ১১৯৬/০৩ রেলওয়ে পোলের কাছে রেল ট্রাকের ওপর থেকে নার্গিসের লাশ উদ্ধার করা হয়। লাশের সাথে পাওয়া যায় নার্গিসের নিজের, তার মা ও মেয়ে কাকন আক্তার কাকলীর পাসপোর্ট। তারপর থেকে লাশ আগ্রা মেডিক্যাল হাসপাতালে রক্ষিত ছিল।
সোমবার লাশ দেখে বোঝা যায় যে, ভারতে পোস্টমর্টেম করা হয়েছে। লাশের ডান হাত মোচড়ানো এবং বাম পা হাঁটুর খানিকটা নিচে থেকে বিচ্ছিন্ন। দুই পায়ের উরুতে ধারালো অস্ত্রের চিহ্ন। আর শরীর থেকে কিডনি বের করে নেয়ার চিহ্ন রয়েছে।
নার্গিসের একমাত্র ১০ বছর বয়সী মেয়ে, কাকন বলছিল, নানী ছাড়া এ দুনিয়ায় আমার আর কেউ নেই। আমি এখন কার কাছে থাকব? কাকলীর এ প্রশ্নের জবাব কে দেবে? নার্গিসের ফুফু রাহেলা পাশে বসে চোখের পানি ফেলেছেন। আমরা দুই দেশের সরকারের কাছে ক্ষতিপূরণ চাই। ভারতীয় ভিসা নিয়ে তারা সেখানে গিয়েছিল। তাই ভারত সরকারের দায়িত্ব ছিল তাদের নিরাপত্তা দেয়া। তিনি খুনি দুর্বৃত্তদের বিচারও দাবি করেন।
নিহতের পরিবারের অভিযোগ, নার্গিসকে ধর্ষণ শেষে হত্যা করে লাশ ফেলে দেয় রেল কর্মচারীরা। আগ্রা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মর্গে রাখা হয় লাশটি। দীর্ঘ ৪০ দিন পর সোমবার সকালে হতভাগ্য নারীর লাশ বাংলাদেশে ফেরত পাঠায় ভারত সরকার। নিহতের ফুফাতো ভাই খুলনার মিলন হোসেন বলেন, ‘তাকে দিল্লিতে ট্রেনের মধ্যেই শারীরিক নির্যাতন করে মেরে ফেলেছে ট্রেন শ্রমিকরা। আমরা এর বিচার চাই।’
ভারতীয় হাইকমিশনের নতুন দিল্লি দপ্তর থেকে লিখিত পত্রে উল্লেখ করা হয়েছে, উত্তর প্রদেশের আগ্রা এসএন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মর্গে ১৩ই মার্চ থেকে লাশটি রাখা হয়। ওইদিন ভদান রেল স্টেশন থেকে তিন কিলোমিটার দূরে ফিরোজাবাদ নামক স্থান থেকে লাশটি পুলিশ উদ্ধার করে মর্গে পাঠায় বলে উল্লেখ আছে।
বেনাপোল বন্দর থানার ওসি অপূর্ব হাসান বলেন, রোববার রাত ১২টার দিকে নিহতের লাশ বেনাপোল চেকপোস্ট দিয়ে বাংলাদেশে হস্তান্তর করে ভারতীয় পুলিশ। ওপারের পেট্রাপোল ইমিগ্রেশন পুলিশ এবং বিএসএফ সদস্যরা বেনাপোল চেকপোস্ট ইমিগ্রেশন পুলিশ ও বিজিবির কাছে লাশ হস্তান্তর করেন। ইমিগ্রেশন উপ-পুলিশ পরিদর্শক আনিস ও হাসানুজ্জামান লাশটি গ্রহণ করে আইনি প্রক্রিয়া শেষে নিহতের পরিবারের কাছে হস্তান্তর করেন।
পোর্ট থানার ওসি অপূর্ব হাসান ও বেনাপোল চেকপোস্ট ইমিগ্রেশন ওসি আসলাম খান জানান, দুই দেশের স্বরাষ্ট্র, হাইকমিশনার ও সংশিষ্ট দপ্তরের চিঠি চালাচালির একপর্যায়ে ৪১ দিন পর বাংলাদেশে এসেছে নার্গিসের লাশটি। সোমবার সকালে তাকে ভারতীয় ইমিগ্রেশন পুলিশ আমাদর কাছে হস্তান্তর করেছেন। আমরা তাদের অভিভাবকের কাছে লাশ হস্তান্তর করেছি।