ফুটপাতেই ৩০ বছর!

30 years on footpathবিশেষ প্রতিবেদকঃ জীর্ণশীর্ণ কাপড়, চুল আউড়ানো, চোখে মুখে এক অস্থিরতার ছাপ, পাশেই কয়েকটি চটের বস্তা। আকাশে কড়া রোদ, প্রচন্ড গরম। তবুও খোলা আকাশের নিচে রোড ডিভাইডারে বসে আছেন পঞ্চাশোর্ধ এক মহিলা। নগরীর দক্ষিণ সুরমার বঙ্গবীর রোডে পুরাতন রেললাইন পার হওয়ার পথে এমন দৃশ্য প্রায় ৩০ বছর ধরেই অবলোকন করছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা। ঝড়, বৃষ্টি কিংবা রোদ, দিনের ২৪টি ঘন্টা এখানেই পার করেন ঐ মধ্যবয়সী নারী। যেন ডিভাইডারেই কেটে গেল তার ৩০ বছর। এটিই তার নিবাস। এখানেই শেষ নিঃশ্বাস নিতে চান তিনি।
কথা বলেন ঐ মধ্যবয়সী নারীর সঙ্গে। কেউ কেউ তাকে পাগল বললেও কথা বলে মনে হল তিনি অনেকটাই স্বাভাবিক। জানালেন তার নাম মিনারা বেগম। বয়স সঠিক করে বলতে না পারলেও স্বাধীনতার কয়েক বছর পর তিনি সিলেটে আসেন। স্বামী পরিত্যক্তা হিসেবে স্বজনরা তার সাথে দুর্ব্যবহার করতো। কচি কচি তিন ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে তিনি বিপাকেই পড়েছিলেন। তারপর মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেললে কিভাবে সিলেটে চলে আসেন তা টের পাননি।
কথা বলেন রংপুরের আঞ্চলিক ভাষায়। ডাকঘর কেরানীহাট বলতে পারলেও থানার নাম মনে নেই তার। জানালেন ছেলেমেয়েরা খোঁজ নেয় না। সবাই পাগল বলে। তবে ছেলেদের জন্য এখনও কষ্ট হয় তার। মেয়ের বিয়ে হয়েছে সেটা শুনেছেন। মেয়ের জামাই ঢাকায় চাকুরী করে। সব ঠিক থাকলেও মিনারার খোঁজ নেয় না কেউই। মাঝে মধ্যে কথা বলার ফাঁকে রেগে যান মিনারা।
আবার শান্ত করে কিছু খাবার দিয়ে কথা বললে মিনারা জানান, আশপাশের দোকানীরা অনেক ভাল। তাকে সবাই ভালোবাসে। খাবার দেয়। কেউ কেউ কাপরচোপড়ও দেয়। এখানে কতদিন যাবত জানতে চাইলে মিনারা বলেন, অনেকদিন ৩০ বছরের বেশি হবে। আমার আশা এখানেই মরব। কথা বলার ফাঁকে হঠাৎ কেঁদে ফেলেন মিনারা। তখন আর কথা বলতে চান না। এসময় তার চোখমুখে এক অস্বস্তির ছাপ দেখা যায়।
পুরাতন রেল লাইনের আশপাশের ব্যবসায়ীরা জানান, মিনারাকে দেখে মানসিক রোগী মনে হলেও আসলে সে সুস্থ স্বাভাবিক। বছরের পর বছর মিনারা রেললাইনের পাশে এই রোড ডিভাইডারেই থাকে। কখনও শুয়ে থাকে। আবার কখনও বসে বসেই সময় কাটায়। মাঝে মধ্যে উঠে গিয়ে রেললাইনের আশপাশে প্রাকৃতিক কাজ শেষ করে আসে। আশপাশের ব্যবসায়ীরা প্রতিদিনই কমবেশী খাবার দেন। কখনও সে বিভিন্ন দোকানে গিয়ে খাবারের জন্য হাত পাতে।
এভাবেই খেয়ে বেঁচে বাস করছে মিনারা। শীতের দিনে পুরনো কাথা আর বস্তা মুড়িয়ে শুয়ে পড়ে। শীত কিংবা গরম মিনারার গায়ে অতিরিক্ত তৈলাক্ত কাপড় থাকেই। বৃষ্টি হলে পলিথিন গায়ে মুড়িয়ে বসে থাকে। এমনকি ঝড় তুফানে সে কোথাও যায় না।
বঙ্গবীর রোডের সিরাজ স্টোর এর স্বত্বাধিকারী আব্দুল আহাদ বলেন, আমার ব্যবসা শুরুর অনেক পূর্ব থেকেই তাকে এভাবেই দেখছি। এখানেই তার বসবাস। রেলস্টেশন এলাকায় মাদকসেবীসহ অনেক খারাপ প্রকৃতির লোক থাকলেও মিনারার সাথে কেউ দুর্ব্যবহার করে না। আমরা মাঝে মধ্যে বাড়ি থেকে আসা খাবারের অবশিষ্ট অংশ তাকে দিয়ে দেই। কখনও কখনও পুরাতন কাপড়চোপড় দেই।
বীনাপানি ফার্মেসীর পরিচালক শ্রীবাস দাস বলেন, জন্মের পর থেকেই এই মহিলাকে এখানে দেখছি। মনে হয় ৩০ বছর কিংবা তারও বেশি সময় ধরে এখানেই তিনি থাকেন। সিএনজি অটো রিকশাচালক জেবুল মিয়া বলেন, আমি সিলেট টু জালালপুর রোডে দশ বছর ধরে গাড়ি চালাই। তারও আগ থেকে ঐ মহিলাকে এখানে দেখে আসছি।