সুন্দরী আফসানার প্রতারণার নেপথ্যে…

afsanaসুরমা টাইমস ডেস্কঃ ‘আমরা দুই বোন। ভাই নেই বলে বাবা-মায়ের মধ্যে প্রায়ই ঝগড়া হতো। বাবা (সোহেল হোসেন) ট্রাক ড্রাইভার। দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছুটে বেড়াতেন। মাঝে মাঝে বাবা বাড়িতে আসতো। এরই মধ্যে বড় বোনের বিয়ে হয়ে যায়। আমিও নবম শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণিতে উঠি।
২০১১ সালের শুরুর দিকে ঝগড়ার এক পর্যায়ে বাবা-মায়ের মধ্যে সম্পর্কের সমাপ্তি ঘটে। মা আমাকে নিয়ে শ্যামলীর রিং রোডে নানার বাসায় ওঠেন। বাবা আমার নামে ব্যাংকে একটি ৮০ হাজার টাকার ডিপোজিট করে দেন। আমি তখন মিরপুর আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজে পড়ি। নানার বাসা থেকে ২০১২ সালে এসএসসি পাস করি। এরপর একই কলেজে ভর্তি হই। ২০১৪ সালে একই কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করি।’
র‌্যাবের হাতে প্রতারণার অভিযোগে আটক হওয়া সুন্দরী তরুণী আফসানা সাংবাদিকদের কাছে এভাবেই নিজের নেপথ্যের কথা বর্ণনা করেন।
afsana2আফসানা বলেন, ‘২০১৩ সালের দিকে বাবাকে ফোন করে জানতে পারি, তিনি আবার বিয়ে করেছেন। ঘর-সংসার করছেন ফরিদপুর জেলার ভাঙ্গা উপজেলার কানাইপুরে আমাদের গ্রামের বাড়িতে। ২০১৪ সালে যখন আমার এইচএসসি পরীক্ষা চলছিল তখন আমার মা (আছিয়া বেগম) আরেকটি বিয়ে করেন। ফলে নানার বাসা থেকে আমাকে রেখে মাকে বের করে দেওয়া হয়। রেজাল্টের পর নানার বাসা থেকে আমাকে বলা হয়, তোমাকে আর আমরা রাখতে পারব না। তুমি অন্য কোথাও গিয়ে থাকো।
এরপর আমি নানার বাসার পাশেই সাত হাজার টাকা মাসিক ভাড়ায় এক রুমের একটি সাবলেট নিয়ে থাকা শুরু করি। কয়েক মাসের মধ্যেই আমার জমানো টাকা শেষ করে ফেলি। টাকা শেষ হওয়ায় আমি চিন্তিত হয়ে পড়ি। কীভাবে সারভাইভ করব বুঝতে পারছিলাম না। এ অবস্থায় তানভির হাসান নির্ঝরের সঙ্গে পরিচয় হয়। এক পর্যায়ে তার সঙ্গে আমার প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তার বুদ্ধিতেই সাবলেট ছেড়ে ১৩ হাজার টাকা মাসিক ভাড়ায় আদাবরে একটি ফ্ল্যাট বাসায় উঠি। বাসার মালিকের কাছে স্বামী-স্ত্রীর পরিচয় দিয়ে বসবাস শুরু করি।
নির্ঝর শুরুর দিকে বাজার করত। কিছু টাকা পয়সা দিত। ফেব্রুয়ারি মাসের ভাড়া দিতে হবে। হাতে টাকা ছিল না। নির্ঝরও টাকা দিতে পারছিল না। তখন আমার ল্যাপটপটি বিক্রির জন্য অনলাইনে অ্যাড পোস্ট করি। একজন ফোন করে সেটি কিনবে বলে। তখন আমাকে তিনি তার অফিসে যেতে বলে। আমি সেটি নিয়ে বনানীতে তার অফিসে যাই। তিনি আমাকে অফিসের ভেতরে না নিয়ে বাইরেই ল্যাপটপের ব্যাগটি নিতে চায়। অনেক চেষ্টা করার পরও আমি ল্যাপটপ হাতছাড়া করিনি। বাসায় ফিরে ঘটনাটি নির্ঝরকে বললে সে আমাকে উল্টো একাজ করতে উদ্বুদ্ধ করে।
বিভিন্ন অনলাইনে অ্যাড পোস্টগুলোর মোবাইল নম্বর সংগ্রহ করে ১০/১২ জনকে ফোন করি। এ থেকে মাত্র চারজন রেসপন্স করেন। তার মধ্যে ফজলু নামে একজন ৭ মার্চ বিকেলে ফোন করে আমার কাছে ল্যাপটপ বিক্রি করতে আগ্রহ প্রকাশ করেন। আমি সেটি নিয়ে পান্থপথে আসতে বলি। ক্রাউন অ্যাসোসিয়েটস নামে ব্যারিস্টার ফিরোজ হাসানের ল চেম্বারে নিয়ে গিয়ে তার ল্যাপটপটি সঙ্গে করে অভিনব কায়দায় বের হয়ে যাই। বিক্রেতারা যখন আসতো তখন বিভিন্ন অফিসে নির্ঝরকে পিয়ন সাজিয়ে প্রতারণা করতাম। এভাবে চারজনের কাছে চারটি দামি ল্যাপটপ কৌশলে নিয়ে যাই।’
এক প্রশ্নের জবাবে আফসানা বলেন, ‘আমি এ কাজ আর করব না। আমার মোবাইল নম্বর ট্র্যাক হওয়ার পর আমি নিজেই র‌্যাবের কাছে এসে ঘটনা খুলে বলতে চেয়েছি। আমি যা বলেছি সব সত্য বলেছি। গ্রাজুয়েশন না করলে কেউ চাকরি দিতে চায় না। কেউ আমার দায়িত্বও নিতে চায় না। উপায় না পেয়ে এই প্রতারণার কাজে পা বাড়িয়েছি।’
বিয়ে না করেও আদাবরের যে বাসায় তারা লিভ টুগেদার করত সেই বাসার মালিক শাহজাহানকে ফোন করা হলে তিনি বলেন, ‘মাসিক ১২ হাজার টাকা বাসা ভাড়া ও অন্যান্য মিলে মোট সাড়ে ১৩ হাজার টাকায় নির্ঝর ও আফসানা ভাড়া নেন। ওঠার সময় স্বামী-স্ত্রী পরিচয় দেন তারা। বাসা তেমন একটা আসবাবপত্রও নেই। তাদের কোনো আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধব আসত না। ছেলে ব্যবসার কথা বলে প্রায়ই বাইরে কাটাত। শনিবার যখন তাদের বাসা থেকে ধরে নিয়ে যায় তখন বুঝলাম আসল কাহিনীটা কী।’
আফসানার নানি আম্বিয়া খাতুনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি। শুধু এটুকু বলেছেন, ‘আদা খাবে যে, ঝাল বুঝবে সে।’ আদালতে আইনি সহায়তা করবেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সেটা দেখা যাবে।’
এ প্রসঙ্গে র‌্যাব-২ এর সিও লেফটেন্যান্ট কর্নেল মাসুদ রানা সাংবাদিকদের বলেন, ‘এ দুজনকে আটক করার ফলে ঢাকা শহরে যারা এ ধরণের প্রতারণার সঙ্গে জড়িত তাদের শনাক্ত করা সহজ হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে চোরাই ল্যাপটপগুলো কোথায় বিক্রি হতো সেই চক্রকেও পাকড়াও করা সম্ভব হবে। এরই মধ্যে সেই চক্রের রানা রায়হান নামে একজনকে আটক করা হয়েছে। তার কাছ থেকে বিপুল সংখ্যক মোবাইল নম্বর সংগ্রহ করা হয়েছে। যাদের কাছ থেকে চোরাই মালামাল তিনি কেনেন।
এ ছাড়া ভূয়া স্বামী নির্ঝর ঢাকা শহরের মোটরসাইকেল চোর চক্রের একজন সক্রিয় সদস্য। এই চক্রের আরো কোনো সদস্য আছে কি না তা জানতে রিমান্ডের দরকার আছে। আটককৃতদের কলাবাগান থানায় হস্তান্তর করা হয়েছে।’

প্রসঙ্গত র‌্যাব-২ এর সূত্র জানায়, এই চক্রটি দীর্ঘদিন ধরে অনলাইনে মোবাইল, ল্যাপটপ ক্রয়ের নাম করে মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করছে। তারা মালামাল বিক্রির বিজ্ঞাপন দেখে ক্রেতা সেজে বিক্রেতার সঙ্গ যোগাযোগ করে। এরপর তাদের সুবিধাজনক স্থানে বিক্রেতাকে মালামাল নিয়ে আসতে বলে। আসলে নির্ধারিত মালটি ঊর্ধতন কর্তৃপক্ষকে দেখানো কথা বলে চলে যায়। আর ফেরে না। এভাবে চক্রটি অনেক বিক্রেতাকেই তাদের ফাঁদে ফেলেছে।
র‌্যাব সূত্র জানায়, শনিবার সকাল ৮ টার সময় তারা খবর পান- প্রতারক চক্রটি রাজধানীর মোহাম্মদপুর, এলিফ্যান্ট রোড ও গ্রিনরোড এলাকায় অবস্থান করছে। এমন সংবাদের ভিত্তিতে র‌্যাব-২ এর সদস্যরা রানা রায়হান, আফসানা ও তানভির হোসেনকে  গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তারকৃতরা জিজ্ঞাসাবাদে জানায়, তারা প্রথমে বিভিন্ন ওয়েবসাইটে ল্যাপটপ, ম্যাকবুক, নোটবুক বিক্রয়ের বিজ্ঞাপন দেখে তা ক্রয়ের জন্য তাদের সাথে যোগাযোগ করে।
পরে ওই মালামাল বিক্রয় আগ্রহী প্রার্থীরা মোবাইলের মাধ্যমে তাদের সাথে যোগাযোগ করলে নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট স্থানের তাদের আসতে বলা হয়।  এ ক্ষেত্রে তারা বিভিন্ন অফিস, শপিংমল ব্যবহার করে। তাদের দেওয়া নির্ধারিত স্থানে চাহিদাকৃত মালামাল বিক্রয়ের জন্য আসলে তারা অফিসে বসিয়ে উক্ত অফিসের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের দেখানোর নাম করে সু-কৌশলে ল্যাপটপ নিয়ে চলে যায়।  জিজ্ঞাসাবাদে তারা আরো জানায়, দীর্ঘদিন যাবৎ তারা এ কাজ করে এবং এক্ষেত্রে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পন্থা অবলম্বন করে থাকে।