কৃষক এবং জনস্বার্থে অতিসত্বর চাল আমদানি বন্ধে সক্রিয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হোক

সরকারি-বেসরকারি উভয় পর্যায়ে চাল আমদানি হচ্ছে। তবে সরকারি পর্যায়ে আমদানির পরিমাণ বেশি। ২০১৪ সালের জুলাই থেকে চলতি ২০১৫ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত যে পরিমাণ চাল আমদানি হয়েছে, এর ৯১ শতাংশই হয়েছে সরকারি পর্যায়ে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ঋণপত্র পর্যালোচনায় দেখা গেছে, আড়াই হাজার কোটি টাকার চাল আমদানি করা হয়েছে। এর মধ্যে বেসরকারি পর্যায়ে আমদানি হয়েছে মাত্র ২৩৯ কোটি টাকার চাল। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৪ সালের জুলাই থেকে চলতি ২০১৫ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময়ে ৯ লাখ ২৬ হাজার টন চাল আমদানি করা হয়েছে। ইতোমধ্যে চালের আমদানি আরো বেড়েছে। ১৭ মার্চ পর্যন্ত চাল আমদানি হয়েছে ১১ লাখ ৯ হাজার টন। আর আমদানি ঋণপত্র খোলা হয়েছে ১৩ লাখ ৩৪ হাজার টন। অব্যাহতভাবে এ রকম চাল আমদানির কারণ সরকারের তরফে ব্যাখ্যা করা হয়নি। দেশ যদি খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণই হয়, তাহলে এত চাল আমদানি কেন?
খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম গত ইয়াওমুছ ছুলাছা (মঙ্গলবার) বলেছে, ‘দেশে খাদ্য মজুদ যথেষ্ট রয়েছে। গুদামগুলো খাদ্যশস্যে পরিপূর্ণ, এমনকি মজুদ ৩ লাখ টন বেশি আছে।
অর্থাৎ চালের পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে। তাই চাল রফতানিও করেছে সরকার। কিন্তু তাহলে কেন ভারত থেকে চাল আমদানি বেড়েই চলছে?

বাংলাদেশ অটো রাইস মিল ওনার্স এসোসিয়েশনের সভাপতি অভিযোগ করেছে, ইম্পোর্ট ডাম্পিং (বাজার দখলে কমমূল্য পণ্য সরবরাহ) করা হচ্ছে। ভারত থেকে নিম্নমানের চাল কম দামে আমদানি করে কম দামে বিক্রি করা হচ্ছে। সঙ্গতকারণেই খারাপ চাল হিসেবে ভারতীয় চালের দাম কম। কিন্তু আরো কম দামে ভারতীয় ব্যবসায়ীরা চাল রফতানি করছে কিনা, সেটা খতিয়ে দেখার বিষয়। কম দামে পণ্য ঢুকিয়ে দিয়ে বাজার দখল করা একটা পুরনো কৌশল। ভারতীয় হিন্দু মাড়োয়ারিরা সেই কৌশল অবলম্বন করেছে। সরকারি ও বেসরকারি আমদানিকারকরা সেই কৌশলের খপ্পরে পড়েছে; বিষয়টি তলিয়ে দেখা বিশেষ জরুরী।

অতি সাধারণ মানুষও বোঝে, ধানের দাম না পেলে কৃষকরা ধান চাষে আগ্রহ হারাবে, অন্য ফসল চাষে চলে যাবে। মিলাররাও বিপন্ন দশায় পতিত হবে। তাদের বিনিয়োগ ও ব্যবসা লাটে উঠবে। আর দেশ খাদ্যের ক্ষেত্রে বিশেষতঃ ভারতনির্ভর হয়ে পড়বে। নাঊযুবিল্লাহ!
এক্ষেত্রে স্মরণ করা দরকার, ২০০৭-০৮ সালে বাংলাদেশে কৃত্রিমভাবে খাদ্যসঙ্কট সৃষ্টি করা হলে কিনে আমদানি করার মতো চাল খুঁজে পাওয়া যায়নি। কেউ চাল দিতে চায়নি। আর ভারত প্রথমে দাম বাড়িয়ে দিয়েছিল এবং পরে রফতানিই বন্ধ করে দেয়। এমনকি পাঁচ লাখ টন চাল দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েও তা রক্ষা করেনি। এই অভিজ্ঞতা মাথায় থাকার পরও কেন আমরা চালের জন্য ভারতনির্ভরতার পথে এগিয়ে যাচ্ছি- সে প্রশ্নের কোনো জবাব নেই।
এদিকে ইম্পোর্ট ডাম্পিংয়ের বিষয়টি স্বীকার করেছে খোদ আমদানিকারকরা। বেনাপোলের আমদানিকারক মিজানুর রহমান বলেছে, কেজিতে ২০-২৫ পয়সা লাভ হলেই আমরা চাল ছেড়ে দেই। প্রতি ট্রাকে ৩ থেকে ৪ হাজার টাকা লাভ হয়। এতেই আমাদের চলে। ২০০৮ সালে দেশে খাদ্যের ব্যাপক ঘাটতি (২০.৫ লাখ টন) দেখা দিলে চাল আমদানির শুল্ক প্রত্যাহার করা হয়। তা এখনো বহাল আছে। কিন্তু বলার অপেক্ষা রাখে না, সে সুবিধা এখনই রোধ করা অতীব জরুরী।
উৎপাদন খরচের চেয়ে বাজারে চালের দাম কম হওয়ায় মন্ত্রিসভার বৈঠকে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী। এজন্য মন্ত্রী গত ইয়াওমুল ইছনাইনিল আযীম (সোমবার) মন্ত্রিসভার বৈঠকে আমদানিকৃত চালের উপর বেশি করে ট্যাক্স আরোপের প্রস্তাব করেছে। তবে চালের বাজার অস্থিতিশীল হওয়ার আশঙ্কায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার মন্ত্রিসভার সিনিয়র সদস্য মতিয়া চৌধুরীর এ প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছে। প্রসঙ্গত আমরা মনে করি, কৃষক এবং জনস্বার্থে প্রধানমন্ত্রীর এ সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করা একান্ত জরুরী। বরং চাল আমদানি রোধে অনিবার্যভাবে তার আশু হস্তক্ষেপ একান্ত জরুরী।
বলার অপেক্ষা রাখে না, কৃষকরা অতিরিক্ত অর্থ ও শ্রম বিনিয়োগ করে ধানের ফলন বৃদ্ধি করে কোনোমতে টিকে আছে। এখন যদি বিদেশ থেকে চাল আমদানি অব্যাহত থাকে, তাহলে তারা ন্যায্য দাম পাবে কী করে?
প্রসঙ্গত, আমাদেরকে মনে রাখতে হবে- সারা দেশের বেশির ভাগ কৃষকই পাইকারদের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে ধান আবাদ করে থাকে। শর্ত থাকে, ধান উঠলে বাজারদামে ওই পাইকারের কাছে ধান বিক্রি করবে। পাইকাররা এই ধান দেয় নির্দিষ্ট চালকলে। এসব চালকল থেকে টাকা নিয়েই পাইকাররা কৃষকদের দেয়। তবে এবার ব্যাপক হারে আমদানির কারণে চালের দাম কৃষকদের অনুকূলে নেই। এজন্য মিল মালিকেরা চাল বিক্রি করতে পারছে না। চাল বিক্রি করতে না পারায় মিল মালিকেরা টাকা দিতে পারছে না। কৃষকেরা বাধ্য হয়ে দাদন ব্যবসায়ীদের কাছে যাচ্ছে। তারা মহাজনের জালে আটকা পড়ে যাচ্ছে। সময়মতো টাকা না পাওয়ায় অনেকেই ঠিকমতো সার ও সেচ দিতে পারেনি। বাংলাদেশের বাজারে ডাম্পিং করে ভারতীয় চাল ঢোকানো হচ্ছে, এমন অভিযোগ ধানকল মালিকদেরও।
লেখাবাহুল্য, ভারতীয় চাল আমদানির খেসারত গুনতে হবে ব্যবসায়ী, কৃষক ও সাধারণ মানুষকে। বাংলাদেশকে ভারতীয় চালের বাজারে রূপান্তর দীর্ঘমেয়াদে চরম ক্ষতি বয়ে আনবে। দেশবাসীর অস্তিত্ব রক্ষার্থে অতিসত্বর চাল আমদানি বন্ধে সব ধরনের সক্রিয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরী। বিজ্ঞপ্তি