পরাধীনতার শৃঙ্খল ভাঙার দিন আজ

bangladeshসুরমা টাইমস ডেস্কঃ আর দশটা দিনের মতো আজকের ভোরেও পূর্ব দিগন্ত জুড়ে ছড়িয়ে পড়বে ভোরের আলোকচ্ছটা। গ্রামীণ পথ শেষে নদীর তীর ঘেঁষে ভেসে আসবে কোকিলের কুহুতান। নীলাকাশের বুকে চিড়ে উড়ে বেড়াবে গাংচিল। তবুও অন্য আর দিনগুলোর চেয়ে আজকের দিনটি ভিন্ন। কারণ, আজকে আমাদের স্বাধীনতার দিন। পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে মুক্ত বিহঙ্গের মতো পাখা মেলার দিন। বাংলাদেশের জাতীয় জীবনের সবচেয়ে আলোচিত, আলোকিত ও গৌরবের স্মৃতি নিয়ে আবারো আমাদের মাঝে ফিরে এসেছে চির অম্লান, অম্ল-মধুর স্মৃতির স্বাধীনতা দিবস। এবার আমাদের স্বাধীনতা ৪৪ বছর পূর্তি করে ৪৫ বছরে পা রাখছে। আর মাত্র ৫ বছর পার করার পর আমরা পালন করবো আমাদের স্বাধীনতার সূবর্ণজয়ন্তী। একই সাথে আজ ২৬ মার্চ, আমাদের জাতীয় দিবস।
স্বাধীনতার ৪২ বছর পর আজ বিশ্বময় ছুটছে বাংলাদেশের জয়যাত্রা। বিশ্বের অনেক দেশই এখন মনে করছে, অচিরেই বাংলাদেশ নামক মাত্র ৫৬ হাজার বর্গমাইলের দেশটি পরিণত হবে বিশ্বের পরাশক্তি হিসেবে। তারুণ্যের শক্তি আর প্রবীণের প্রজ্ঞা- এ দুইয়ে মিলে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা কেউ থামাতে পারবে না। যেমনটি পারেনি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। ১৯৭১ সালে আধুনিক সমারাস্ত্রে সজ্বিত পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর বিপক্ষে দেশপ্রেম ও অসীম সাহসীকতা নিয়ে লড়েছিল বীর বাঙাল। আজো তারা লড়ছে, ভবিষত্যেও লড়বে- কারণ, বাঙালি মাথা নত না করা এক জাতির নাম।
আসুন ফিরে যাই ৪৫ বছরের আগের সেই দিনটিতে। আগের রাতের ভয়াবহতার চিহ্ন নিয়ে সেদিনও রাঙা প্রভাত এসেছিল বাংলার এ প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। কিন্তু কী বিভৎস্য, কী নির্মম প্রভাত ছিল! চারপাশে ধ্বংসস্তূপ আর লাখো মানুষের বিকৃত লাশ। সূর্যের কিরণ ভেদ করে তখন কুণ্ডলী পাকাচ্ছিল ছাইচাপা আগুন। চোখের সামনে সারি সারি স্বজনের লাশ। এই ভয়াল চিত্রের মাঝেই অসীম সাহসী বাঙালি শপথ নিয়েছিল- বাংলাদেশ স্বাধীন করেই ছাড়বো। দেশকে শত্রুমুক্ত করে তবেই ঘরে ফিরবো। সেই শপথবাক্য কড়ায়গণ্ডায় পালন করেছিলেন তারা। নয় মাসের রক্তাস্নাত লড়াই আর ত্রিশ লাখ শহীদ ও তিন লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর অর্জিত হয়েছিল বিজয়। আর ‘সেই থেকে স্বাধীনতা শব্দটি আমাদের’।
একদিনের ঘোষণায়, কোনো হুইসেল বা সৈনিকের ঘোষণায় গোটা জাতি জীবনবাজি রেখে মরণপণ লড়াই-সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েনি। দীর্ঘ ২৩ বছরের সংগ্রাম শেষে মৃত্যুপণ লড়াই ও রক্তসমুদ্র পাড়ি দিয়ে বীর বাঙালি ছিনিয়ে এনেছে জাতীয় ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন ‘মহান স্বাধীনতা’। বঙ্গবন্ধু ধাপে ধাপে পুরো বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতার প্রশ্নে ঐক্যবদ্ধ করেন।
১৯৪৭ সালে ভৌগলিকভাবে অসম্ভব ভারত ভাগের পরে পাকিস্তানের পূর্ব অংশ হয় বাংলাদেশ। নতুন রাষ্ট্রের শুরুতেই ভাষা নিয়ে বিরোধ। ১৯৪৮ সালে জিন্নাহর ঘোষণা- একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। এরপর থেকে ক্ষোভে ফেটে পড়ে পুরো বাঙালি জাতি। লড়তে শুরু করে মাতৃভাষার জন্য। যার চূড়ান্ত পরিণতি পায় ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। ১৪৪ ধারা ভেঙে মিছিল বের করলে পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারায় অসংখ্য ছাত্র-জনতা। এরপর চুয়ান্নর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ছেষট্টির ছয় দফা আন্দোলন। পঞ্জিকার পথ বেয়ে আসে ১৯৬৯। ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানে কেঁপে ওঠে জেনারেল আইয়ুব খানের মসনদ। জনতার সাগরে তৈরি হয় উন্মাতাল স্রোতধারা। ‘জাগো জাগো বাঙালি জাগো’, ‘তোমার আমার ঠিকানা/পদ্মা মেঘনা যমুনা’, ‘জয় বাংলা’- স্লোগানে স্লোগানে প্রকম্পিত হয় বাংলার জনপদ।
শত ষড়যন্ত্র ও সামরিক জান্তার রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে সত্তরের জাতীয় ও প্রাদেশিক নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পায় বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ।
কিন্তু বাঙালির হাতে শাসনভার দেয়ার বদলে শুরু হয় ষড়যন্ত্র। রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খান ও পাকিস্তান পিপলস পার্টির প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টো বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনার নামে করতে থাকেন কালক্ষেপণ। আড়ালে প্রস্তুত করতে থাকেন কীভাবে বাঙালি নিধন করা যায়। বাঙালিও তখন দ্বিধাবিভক্ত।
তবে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণেই মুক্তিপাগল বাঙালি পায় মুক্তিযুদ্ধের দিকনির্দেশনা। আক্ষরিক অর্থেই তখন পূর্ব পাকিস্তানের প্রশাসন চলছিল বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে। সময় যতই গড়াচ্ছিল বাঙালির হৃদয়ে ততই স্পষ্ট হচ্ছিল স্বাধীন দেশের স্বপ্ন। সেই স্বপ্নকে দুঃস্বপ্নে পরিণত করতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে শুরু করে নিষ্ঠুর গণহত্যা। সেই কালরাত থেকেই শুরু হয় মৃত্যু, ধ্বংস, আগুন আর আর্তনাদের পৈশাচিক বর্বরতা।
ওইদিন রাতেই গ্রেপ্তার হোন বঙ্গবন্ধু। তার আগেই ওয়্যারলেসের মাধ্যমে ঘোষণা দেন, ‘এটাই হয়তো আমার শেষ বার্তা, আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। পাকিস্তান সেনাবাহিনী অতর্কিতে পিলখানার ইপিআর ঘাঁটি, রাজারবাগ পুলিশ লাইন আক্রমণ করেছে এবং শহরের লোকদের হত্যা করছে। ঢাকা, চট্টগ্রামের রাস্তায় রাস্তায় যুদ্ধ চলছে। আমি বিশ্বের জাতিগুলোর কাছে সাহায্যের আবেদন করছি। আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা বীরত্বের সঙ্গে মাতৃভূমি মুক্ত করার জন্য শত্রুদের সঙ্গে যুদ্ধ করছে। সর্বশক্তিমান আল্লাহর নামে আপনাদের কাছে আমার আবেদন ও আদেশ- দেশকে স্বাধীন করার জন্য শেষ রক্তবিন্দু থাকা পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যান। আপনাদের পাশে এসে যুদ্ধ করার জন্য পুলিশ, ইপিআর, বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও আনসারদের সাহায্য চান। কোন আপোস নাই, জয় আমাদের হবেই। আমাদের পবিত্র মাতৃভূমি থেকে শেষ শত্রুকে বিতাড়িত করুন। সব আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী এবং অন্য দেশপ্রেমিক ও স্বাধীনতাপ্রিয় লোকদের এ সংবাদ পৌঁছে দিন। আল্লাহ আমাদের মঙ্গল করুন। জয় বাংলা।’
বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণার পর থেকে শুরু হয় লড়াই। দেশের প্রতিটি প্রান্তরে চলতে থাকে প্রতিরোধ যুদ্ধ। দেশের অকুতোভয় সূর্যসন্তানরা তুমুল যুদ্ধ করে লাখো প্রাণের বিনিময়ে ছিনিয়ে আনে স্বাধীনতা। একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর হানাদার বাহিনী মাথানত করে পরাজয় স্বীকার করে আত্মসমর্পণে বাধ্য হয়। বিশ্বের মানচিত্রে স্থান পায় এক সাগর রক্তের বিনিময়ে একটি স্বাধীন দেশ, স্বাধীন পতাকা- যার নাম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ।
আজ দেশবাসী গভীর শ্রদ্ধা ও পরম মমতায় স্মরণ করছে সেইসব বীরাঙ্গনা মায়েদের যাদের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছিল স্বাধীনতা। স্মরণ করছে সেই ত্রিশ লাখ শহীদ যারা এ দেশটাকে স্বাধীন করার পথে হাসিমুখে বিলিয়ে দিয়েছে নিজেদের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ।
জাতির সবচেয়ে বড় অর্জনের আনন্দ আর স্বজন হারানোর বেদনার এক আবেগঘন মিশ্র পরিবেশের মধ্য দিয়ে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান মুক্তিযোদ্ধা, তাদের পরিবার, আত্মীয়-স্বজন ও মুক্তিকামী লাখো মানুষ নানা ব্যঞ্জনায় পালন করবে আজকের দিনটি। ফুলে ফুলে ভরে উঠবে জাতীয় স্মৃতিসৌধসহ দেশের সব শহীদ মিনার। স্মরণ করবে স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাকারী তার সহকর্মী জাতীয় নেতাদের। বজ্রমুষ্ঠিতে শপথ নেবে- এ দেশকে সোনার বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে তোলার।
মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম রওশন এরশাদ, বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ পৃথক পৃথক বাণীতে দেশবাসীকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন।
স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবসের কর্মসূচি
যথাযোগ্য মর্যাদায় স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস পালনের উপলক্ষে সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নেয়া হয়েছে। সংবাদপত্রগুলোও প্রকাশ করছে বিশেষ ক্রোড়পত্র। সরকারি ও বেসরকারি টেলিভিশন ও রেডিও স্টেশনগুলো প্রচারিত হবে বিশেষ অনুষ্ঠানমালা। সেই সঙ্গে আছে বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের নানা আয়োজন।
আজ সকালে ৩১ বার তোপধ্বনির মাধ্যমে সরকারিভাবে দিবসটির কর্মসূচির সূচনা হবে। সকালে বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে শিশু কিশোর সমাবেশ ও কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠিত হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন।
আজ সরকারি ছুটির দিন। সব সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারি ভবনে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হবে এবং বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ভবন ও স্থাপনাসমূহ আলোক সজ্জায় সজ্জিত করা হবে। ঢাকা ও দেশের বিভিন্ন শহরের প্রধান সড়ক ও সড়কদ্বীপগুলো জাতীয় পতাকা ও অন্যান্য পতাকায় সজ্জিত করা হবে। দিবসটি উপলক্ষে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী, বাংলাদেশ শিশু একাডেমীসহ বিভিন্ন সংগঠন আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে।