রেলের ৫০ লাখ টাকার সম্পদ ৫ লাখে বিক্রি!
নুরুল হক শিপুঃ সিলেট রেলওয়ের ৫০ লাখ টাকার সম্পদ ৫ লাখ ২৬ হাজার টাকায় নিলামে বিক্রি করে দেয়া হয়েছে। রেলের অসাধু কয়েকজন কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করে এমনটি করা হয়। আর ওই নিলামের সময় ১৪৮ জন ব্যবসায়ীর মধ্যে ১৪৬ জনকে জিম্মি করে প্রায় ৫০ লাখ টাকার সম্পদ মাত্র ৫ লাখ ২৬ হাজার টাকায় হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ ওঠেছে সিলেট সিটি কর্পোরেশনের ২৫ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর তকবির ইসলাম পিন্টু ও ২৬ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর সেলিম আহমদ রনির বিরুদ্ধে। ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করেন, পিন্টু ও রনি ব্যবসায়ীদের কথার মাধ্যমে জিম্মি করে রেলের অসাধু কিছু কর্মকর্তাকে হাত করে এ নিলাম হাতিয়ে নেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত ৯ মার্চ রেলওয়ের ১৯টি পুরাতন কোয়াটার নিলামে বিক্রি করেন সিলেট রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। উম্মুক্ত নিলামে অংশ নেন সিলেটের প্রতিষ্ঠিত ১৪৮ জন ব্যবসায়ী। ওই দিন নতুন রেলওয়ে স্টেশনের ৩ তলায় নিলাম চলে। নিলামে ওয়ার্ড কাউন্সিলর তকবির ইসলাম পিন্টু ও সাবেক কাউন্সিলর সেলিম আহমদ রনি এক হয়ে নিজস্ব বাহিনী নিয়ে যোগ দেন বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। নিলামের আগে পিন্টু ও রনি উপস্থিত ব্যবসায়ীদের সাথে কথাও বলেন। ব্যবসায়ীদের তারা বলেন, যেকোনো মূলে রেল কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে সর্বনিম্ন মূলে নিলাম নিতে হবে। পরে সব ব্যবসায়ী মিলে নিজেদের মধ্যে নিলাম করা যাবে। তাদের এমন প্রস্তাব কিছু ব্যবসায়ী নাকচ করেদেন। এরপর পিন্টু ও রনির লোকজন ব্যবসায়ীদের বলেন, যদি কেউ নিলাম ডাকে আর ওই নিলাম যদি সে নেয় তাহলে কাজ করাতে পারবেনা। পরে ব্যবসায়ীরা নিলাম না ডেকেই নিলামের সময় নিরব ভূমিকা পালন করেন বলেও জানান। এরপর নিলামটি পেয়ে যান পিন্টু ও রনি। তারা ৭ দিন পর ফের ওই ব্যবসায়ীদের সাথে বৈঠক করেন। বৈঠকে তারা ব্যবসায়ীদের মধ্যে নিলামের বিয়টি প্রত্যাহার করেন। ওই কাজটি তারাই করতে চান বলে জানান ব্যবসায়ীদের। পরে ব্যবসায়ীরা চলে আসেন। বর্তমানে নিলামে নেয়া ওই ১৯টি কোয়াটার ভেঙে বিভিন্ন জিনিসপত্র বিক্রি করা হচ্ছে।
রেলওয়ে সূত্র জানায়, ১৯ টি পুরাতন কোয়াটার নিলামে অংশ গ্রহণকারী ১৪৮ জন ব্যবসায়ী প্রত্যেকে ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা করে মোট ২ কোটি ৭২ লাখ টাকা জমা করেন। অবশ্য নিলাম শেষে রেল কর্তৃপক্ষ ওই টাকা ব্যবসায়ীদের ফিরিয়ে দিয়েছেন।
রেলওয়ের সহকারি নির্বাহী প্রকৌশলী মুজিবুর রহমান, জৈষ্ঠ সহকারি প্রকৌশলী (পূর্ত) আকবর আলীসহ রেলের উর্ধ্বতন কয়েকজন কর্মকর্তা ও কর্মচারিকে মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে ৫ লাখ ২৬ হাজার টাকায় এ নিলাম হাতিয়ে নেন পিনটু ও রনি।
রেল সংশ্লিষ্ট সূত্র ও নিলামে অংশ গ্রহণ করা ব্যবসায়ীরা দাবি করেছেন, ওই ১৯টি কোয়াটার ভেঙে মূল্যবান জিনিস বিক্রি করে প্রায় ৫০ লাখ টাকা পাওয়া যাবে।
এছাড়া নিলামে অনিয়মের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠে এসএসএই ওয়ার্ক (কর্মচারি) ইউনুস মিয়ার বিরুদ্ধেও। কিন্তু তিনি সুরমা টাইমসকে জানান ভিন্ন তথ্য। তিনি বলেন, এ নিলামে আমি অনিয়মের সাথে জড়িত থাকার প্রশ্নই ওঠেনা। কারণ যখন নিলাম হয় তখন তিনি স্টেশনেই ছিলেন না। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিষয়টি ভালভাবে তদন্ত করলে আপনারা অনেক কিছুই জানতে পারবেন। ইউনুস বলেন, যে দামে নিলাম ডাকা হল ওই দামেই আবার নিলাম বিক্রি করা হয়েছে তা তিনি শুনেছেন। সরকারের সম্পদ একবার নিলাম ডাকা হয়েছে নিলামে তার সঠিক দাম না মিললে আবার নিলাম ডাকা যেত। কিন্তু তা না করে রেল কর্তৃপক্ষের নির্ধারিত দামেই নিলাম বিক্রি হয় কিভাবে? যাচাই-বাচাই করা ধরকার ছিল বলেও জানান তিনি।
রেলওয়ের জৈষ্ঠ্য সহকারি প্রকৌশলী (পূর্ত) আকবর আলী নিলাম নিয়ে তার বিরুদ্ধে আনা অনিয়মের অভিযোগ মিথ্যা উল্লেখ করে বলেন, কাজিরবাজর সেতুর কাজ চলছে। ওই সেতুর জন্য রেলের একটি ভবন ভাঙা পড়েছে। সেতুর কাজ সম্পন্ন করতে আমাদের ওপর সড়ক ও জনপদের লোকজন ওই পুরাতন কোয়াটার ভেঙে ফেলতে চাপ সৃষ্টি করেন, জেলা প্রশাসক অফিস থেকেও বারবার তাগিদ দেয়া হয়। পরে পত্রিকার মাধ্যমে নিলামের ডাক দেয়া হয়। গত ৯ মার্চ ১৪৮ জন ব্যবসায়ীর উপস্থিতিতে ওপেন নিলাম হয়। তিনি বলেন, সরকারি বিধি মোতাবেক এ নিলাম সম্পন্ন হয়েছে। ৫ লাখ ২৫ হাজার ১৬৭ টাকায় ডাকা নিলাম সরকারি ভ্যাটসহ ৬ লাখ ৩০ হাজার ৯৬২ টাকা বিক্রি করা হয়।
এদিকে সোমবার সরেজমিনে কোয়াটার পরিদর্শনের সময় ২৫ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর তকবির ইসলাম পিন্টুর বন্ধু মহানগর ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক পরিচয়দানকারী সুবেল কর্তব্যরত ফটো-সাংবাদিককে ফোটো তুলার কারণ যানতে চান। এক পর্যায়ে তিনি প্রতিবেদক ও ফটো-সাংবাদিকে ভিজিটিং কার্ড রাখেন। এ সময় তিনি বলেন, নিলামে তারা যে কোয়াটার নিয়েছেন তা ভাঙার কাজ চলছে। তবে কোয়াটারের ৪টি কক্ষ কাজিরবাজার সেতুর ভেতরে ঢুকে যাওয়ায় যে দামে তারা নিলাম কিনেছেন ওই দাম ওঠবেনা। লোকসান হবে বলেও দাবি করেন তিনি।
২৫ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর তকবির ইসলাম পিন্টু নিলামের সার্বিক বিষয়ে সুরমা টাইমসকে জানান, নিলামটি ওপেন হয়েছে। তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা। কারণ তিনি নিলাম পাওয়ার এক সপ্তাহ পর ১৪৮ জন ব্যবসায়ীকে সাথে নিয়ে বৈঠক করেছেন। যারা এ ব্যাপারে অসন্তুষ ছিলেন তাদেরকে খুশি করা হয়েছে। পিন্টু বলেন, ওই নিলামে তার সাথে জড়িত আছেন সাবেক কাউন্সিলর সেলিম আহমদ রনিসহ আরো কয়েকজন। এছাড়া রেলের কাছ থেকে প্রাপ্ত এ নিলামে তার ক্ষতি হবে জানিয়ে তিনি বলেন, কাজিরবাজার সেতুর নিচে ৪ কক্ষের কোয়াটার ঢুকে গেছে। ওই কক্ষ গুলো থেকে এক টাকার মালামালও উদ্ধার করা সম্ভব নয়। রেলের কর্মকর্তাদের সাথে সমঝোতা করে নিলাম পেয়েছেন কিনা এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, কর্তৃপক্ষের সাথে প্রশ্নই ওঠেনা সমঝোতা করার। কারণ ১৪৮ জন ব্যবসায়ীসহ প্রায় ৪’শ মানুষের উপস্থিতিতে নিলাম হয়েছে। কত টাকায় নিলাম রাখলেন এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ৫ লাখ ২৬ হাজার টাকার নিলাম ভ্যাটসহ ৬ লাখ ৩০ হাজার ৯৬২ টাকা দিয়েছেন।
রেলওয়ের সহকারি নির্বাহী প্রকৌশলী মুজিবুর রহমান সোমবার মোবাইল ফনে এ প্রতিবেদককে বলেন, কর্তৃপক্ষের যতা নিয়মে নিলাম কাজ সম্পন্ন হয়েছে। তিনি বলেন বিস্তারিত পরে বলবেন। এরপর যতবার তাকে ফোন করা হয় তিনি ব্যস্ততা দেখিয়ে ফোন রেখে দেন।