মুখে ‘আঙ্কেল’ মনে আতঙ্ক

Sayeedইয়াহইয়া মারুফঃ অপহরণ ও খুনের দায় স্বীকার করা পুলিশ কনস্টেবল এবাদুরকে আঙ্কেল বলে ডাকত সাইদসহ তার ভাই-বোনেরা। গতকাল কথা বললে সেই ‘আঙ্কেল’ সম্মোধন করল সাইদের বড় বোন অষ্টম শ্রেনীর ছাত্রী সাউদা। কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলে ‘এবাদুর আঙ্কেল সহ আমার ভাইয়ের খুনিদের ফাঁসি চাই’। নিজের আঙ্কেলের চেয়ে বেশী আদর করতাম এবাদুর আঙ্কেলকে। প্রশ্ন রাখে সেই আঙ্কেল কি অপরাধে আমার ভাইকে নির্মমভাবে হত্যা করলো? আঙ্কেল নামের মানুষ গুলো কি এত নিষ্ঠুর? আমার আঙ্কেলে যদি সাইদকে বলতেন। তোমার মা-বাবার কাছে আমার কথা না বল্লে তোমাকে ছেড়েদিব। আমার ভাই জীবনেও আঙ্কেলের কথা কারো কাছে বলতো না। এভাবেই গতকাল সোমবার সবুজ সিলেটের এই প্রতিবেদককে মোবাইল ফোনে হৃদয়বিদায়ক কথাগুলো বলেছিল অপহিৃত হয়ে নির্মমভাবে খুন হওয়া।
সিলেট নগরীর শাহী ঈদগাহস্থ হাজী শাহমীর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৪র্থ শ্রেনীর ছাত্র আবু সাঈদের বড় বোন সাউদা আক্তার। সাউদা জানায়, সাইদ আমাকে আনেক আদর করত। সবসময় বলতো আপু আমি বড় হয়ে তোমাকে অনেক দামি দামি জামা-কাপড় কিনে দিব। সোনা-রোপার অলঙ্কার কিনে দিব। কখনো রাগ করলে বা মন খারাপ থাকলে খুশি করার জন্য কত বায়না ধরতো। বলতো আপু আমি আছিনা তুমি মন খারাপ কর কেন। আমি তোমার সব আশা পুরন করে দিব। তুমি শুধু দোয়া কর আমি যেন তাড়াতাড়ি বড় হই। আমার ভাই সেই স্বপ্নের বাস্তবায়ন হতে দিলনা আঙ্কেল রূপ ধারনকারী ঘাতক। সাউদা কাঁন্নায় ভেঙ্গে পরে আরো জানায়, বাবার মুখে শুনেছি এবাদুর আঙ্কেল আদালতে বলেছেন সাইদ আঙ্কেলের পায়ে ধরে প্রাণভিক্ষা চেয়েছিল। বলেছিল আমাকে ছেড়েদিলে কাউকে এ অপহরণের কথা বলবে না। খুনের আগে সাইদ তাদের পরিকল্পনার কথা জেনে যাওয়ায় এবং সবাইকে চিনে ফেলায় নাকি নিজেদের রক্ষা করতে আমার কলিজার টুকরা আদরের ভাইটিকে গলাটিপে হত্যা করেছে। এর লাশ গোপন রাখতে তারা ৭টি বস্তার ভেতরে বন্দি করে রাখে। এখন কে আমাকে আপু বলে বড় বড় স্বপ্ন দেখাবে? কে বলবে আমি বড় হয়ে তোমার সব আশা পুরণ করব? কার রাত জেগে গল্প করব? কেনই বা আমাদের ময়ার বন্ধন ছিড়ে দু‘জনকে দু‘জগতের বাসিন্দা করা হলো? কি ছিল অপরাধ? সাইদের ছোট ভাই পাঁচ বছরের শিশু আবু শাফি। অবুঝ শিশুটি কাঁন্না করে আর বলে, আমার ভাইয়াকে পুলিশ আঙ্কেল তুলে নিয়ে মেরে ফেলেছে। এই নিষ্পাপ ছোট শিশুটির কাছেও আঙ্কেল ও পুলিশ দু‘টি শব্দ ঘৃনার। শাফিরও একই কথা এবাদুর আঙ্কেল সহ ভাই হত্যায় জরিতদের ফাসি চাই। আসলে এই পাঁচ বছরের শিশু শাফি ফাসিই কি বুঝে? আর তার মত শতশত শাফিরা কি আঙ্কেল ও সাধারণ মানুষের জানমালের নিরাপত্তা দানকারী পুলিশকে সম্মান করবে? বা নিরাপত্তার জন্য পুলিশের কাছে আসবে? সেই প্রশ্ন এখন সিলেট নগরীর সর্বস্থরের মানুষের। গতকাল খুনিদের ফাসির দাবিতে মানববন্ধন কর্মসুচী পালন করে সাইদের স্কুলের সহপাঠী, শিক্ষক-শিক্ষিকারা। কর্মসুচীর পর প্রতিবেদকের কথা হয় হাজী শাহমীর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা কাবেরী রানী দেবীর সাথে। সাইদ নাম উচ্চারণের সাথে সাথে আবেগতাড়িত হয়ে কান্নাসংবরণ কে বলেন, প্রায় এক যুগ ধরে শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা। সাধারণত এই বয়সের ছেলেরা একটু দুষ্টমি, ঝগড়াঝাটি করে থাকে। কিন্তু সাইদ ছিল সম্পুর্ণ বিপরীত চরিত্রের একটা ছেলে। তার মত বয়সে এত ন¤্র, ভদ্র ছেলে আর একটা পাইনি। আর পাব বলেও মনে হচ্ছেনা। সাইদ কোন দিন ক্লাস মিছ করেনি। কোন দিন তার নামে কোন বিচার আসেনি। ক্লাসে প্রতিদিন একই স্থানে এসে বসতো। যা বলতাম তার কোন বিপরীত করেনি। তিনি বলেন, অপহরনকারীরা সাধারণ কোন সাইদকে হত্যা করেনি। বাংলাদেশের ভবিষৎ প্রজন্ম থেকে দেশ আলোকিত করার একটি বাতিকে নিভিয়ে ফেলেছে। এরা দেশের শত্রু। এদের জনসম্মুখে দৃষ্টান্তমুলক শাস্তি মাধ্যমে এই ধরনের অপরাধীদেরকে উচিত শিক্ষা দেওয়ার দবি জানান সাইদকে মানুষের মত করে গড়ে তুলার স্বপ্নদ্রষ্টা শিক্ষিকা কাবেরী রানী দেবী। সাইদের মা সালেহা বেগম। এঘটনার পর থেকেই বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছেন। হওয়ারই কথা। এভাবে অল্পদিনে আদরের সন্তানকে হারাতে হবে। তা কোন দিন কল্পনাতে ও আসেনা আর তা বাস্তবে গঠে গেল।
কথা হয় সাইদের মা সালেহা বেগমের সাথেও। কোন ভাবে কান্না থামাতে পাড়ছেন না। পারার কথাও যে আদরের সন্তান মায়ের আচল ধরে সাথে সাথে থাকার কথা। এটা ওটার জন্য সবসময় মায়ের আচল টেনে বায়না ধরার কথা। সেই সন্তানের এমন নিষ্ঠুর ভাবে হত্যা তো কোন মায়ের পক্ষেই শোনা বা সহ্য করা সম্ভব নয়। তেমনটি সালেহা বেগমেরও। কাঁন্নায় ভেঙ্গে পরে বলেন, এবাদুর আমার সাথে এক বাসায় তাকতো। আপন ভাইয়ের মত দেখছি। কোন দিন কল্পনা করিনি এমন সর্বনাশ করবে। এমন কি আমার সাইদ অপহরনের পর। পুলিশ বাহিনীতে কাজ করে বলে ছেলেকে উদ্ধারের সহযোগিতাও চাই। অশ^স্ত করেছিল। বলেছিল আপা কিচ্ছু হবেনা। আমি দেখছি। এই হলো তার দেখা। কি ক্ষতি করেছিলাম আমি তার। সাইদের মা বলেন, যেদিন ছেলের লাশের সন্ধান পাই, সেদিনও এবাদুরের সাথে ঝর্ণাপাড়ে দেখা হলে তখনো সাইদ উদ্ধারের সহযোগিতা চাই। জানতাম না এই জানোয়ারই আমার সর্বনাশের মূলহোতা। সালেহা বেগম আরো বলেন, এবাদুরের সাড়ে তিন বছরের এক মেয়ে জারা। সাইদ জারাকে হাতে ধরে হাটা শিখাইছে। সবসময় মুখে তুলে জারাকে খাওয়াই তো। এত গভীর সম্পর্কের পরও কিভাবে আমার বুক খালি করল এবাদুর? এই একই কথাগুলো বার বলেছিলেন সালেহা বেগম। সাইদের শোকাহত মা-বাবাকে সান্তনার ভাষা আমাদের এই সমাজের মানুষের কাছে আছে বলে মনে হয় না। কারণ সমাজের যে কোন শ্রেনীর মানুষই তো এই নিষ্টুর নির্মম হত্যার বর্ণনা শুনে স্তব্ধ হওয়ার কথা। সাথে ভাষা হারিয়ে ফেলাটাও স্বাবাভিক। সাইদের হত্যার বর্ণনা শুনা মাত্রই যে কেফরই চোখে পানি চলে আসবে। নিশ্চয় মনে অজান্তেই বেরিয়ে আসবে একটি কথা। এ হত্যার সাথে জরিত ও মদদ দাতাদের দৃষ্টান্তমুলক শাস্তির মাধ্যমে আঙ্কেল ও পুলিশ শব্দের। যে ভয় আমাদের শিশুদের মনে জন্মেছে তা দুর করা এবং এভাবেই যেন আর কোন সাইদের মায়ের বুক খালি না হয়। এই ব্যবস্থা গ্রহণের কথা।