সাহিত্য সমালোচনার ভূমিকা
আবদুল হক : সমস্ত শাস্ত্রের পেছনেই সমালোচনা আছে, থাকাটা স্বাভাবিক ও জরুরি বলেই আছে, কেননা শাস্ত্রিকের-গ্রাহকের বিচারবোধ আছে – কিন্তু তাবৎ শাস্ত্রসমালোচনার ওপরে সাহিত্যসমালোচনার আলাদা মূল্য আছে। সে এই যে, ঐশীবাণীর গুণালোচনা ঐশী নয়, চিত্রগীতশিল্পের সমালোচনা শিল্প নয়, কিন্তু সাহিত্যের সমালোচনাও সাহিত্য।
চিন্তাশীল পাঠকমাত্রই সমালোচক। তিনি পড়েন, বোঝেন; তারপর, যা পড়েন তা নিয়ে ভাবেন। লেখকের ভাবনা কি শুদ্ধ? তিনি কি নয়া কোনো কথা বললেন, নিত্যবৃত্তের বাইরে, সুন্দর করে? তাঁর বোধে গভীরতা ও স্পষ্টতা কত, ভাষায় শিল্পের সাজ কেমন? চিন্তাশীল পাঠক এদিকটা খেয়াল না করে পারেন না, রুচিবান পাঠক এগুলি তলিয়ে দেখেন, রসজ্ঞ পাঠক এসব খুঁটিয়ে পরখ করেন। এ পাঠকই প্রকৃত পাঠক; এবং একই সঙ্গে সমালোচকও, অন্তত তাঁর নিজের কাছে। তিনি জ্ঞানের জন্যে পড়েন, বোধের জন্যে পড়েন, আনন্দের জন্যে পড়েন; সমালোচনার ইচ্ছেয় নয় – সমালোচনা তবু হয়ে যায়, পাঠের সঙ্গে সঙ্গেই – কেননা তাঁর রুচি শীলিত, শুদ্ধের সিদ্ধিতে; কেননা তাঁর সত্তা জাগ্রত, সুন্দরের সান্নিধ্যে।
রুচিমান ও ভাবুক পাঠক তো অন্তর্গত সমালোচক, কর্মগত নন। তাই নিজের বোধবুদ্ধি দিয়ে নিজের পছন্দ-অপছন্দ তিনি স্থির করেন ইচ্ছেমতো, নিয়মমতো নয়। সাহিত্যবিচারে তাঁর অন্তরের সায় আছে, বাইরের দায় নেই। দায় আছে কর্মগত সমালোচকের। প্রথাগতভাবে, মনে মনে যিনি সাহিত্যবিবেচনা করেন তিনি নন, জনে জনে সেই বিবেচনা যিনি ছড়িয়ে দেন তিনিই সাহিত্যসমালোচক। ব্যক্তিগত সঞ্চয়টুকুই পুঁজি যদিও, তবু দায়বান সমালোচক নিছক ব্যক্তিগত পছন্দে চালিত হন না। সাহিত্যবিচারে তিনি কিছু নিয়ম মানেন। নিয়মগুলি আদালতি নিয়মের মতো স্পষ্ট ও ক্ষুদ্র নয়, আবহমান কালের মতো অস্পষ্ট আর বিরাট। আসলে সমালোচক কালের কথাই বলেন, কিংবা কাল কথা বলে তাঁর কণ্ঠে চারিত হয়ে। যথার্থ সমালোচনা তাই সকল কালেই যথার্থ। অতীত-বর্তমানের সাহিত্যকৃতির মূল্যায়নের সঙ্গে সঙ্গে, সমালোচকের দৃষ্টি আজকের সামান্য সৃষ্টি দেখে নয়া লেখকের আগামীর অসামান্য সম্ভাবনা আঁচ করতে পারে। বীজের ভেতরে দেখে বৃক্ষ। সাধারণ পাঠকসমাজ তো প্রায়শ বৃক্ষই দেখে না। সব বড় লেখককে আমরা সবসময় নিজের মেধায় বড় বলে, কিংবা ঠিক কত বড়, চিনে উঠতে পারি নি – চিনিয়েছেন সমালোচক। শুদ্ধ সমালোচনার ঘাটতির ফলে বহু প্রতিভাবান লেখককে আমরা জীবৎকালে লেখকস্বীকৃতি দিতে পারি নি, তাঁরা কালোত্তর লেখক বলে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন মৃত্যুর ঢের পরে – এমনকি তখনও, সেই প্রতিষ্ঠার পেছনে কাজ করেছে সমালোচনা, বিলম্বিত সমালোচনা – যেমন ডিকিনসন, জীবনানন্দ।
ধর্ম সমালোচনা পছন্দ করে না, সে চায় নির্প্রশ্ন ভক্তি। ফলে চিন্তাবিমুখ ধার্মিকেরাও সমালোচনা সহ্য করতে পারেন না। এরই প্রভাবে ধর্মপ্রধান সমাজে সমালোচনা সম্পর্কে একরকম সার্বিক নেতিবাচক মনোভাব গড়ে ওঠে। সাহিত্য সাহসের সমাচার, তাতে এইসব ক্ষুদ্র ভয়ভীতির জায়গা নেই। সাহিত্য ভক্তি চায় না, চায় জাগৃতি। সমালোচনা এতে সাহায্য করে। সমালোচক পথ দেখান সাধারণ পাঠককে, চিহ্নিত করে দেন লেখকের উপযুক্ত আসনটি। সে কারণেই সমালোচনা একটি জরুরি শিল্প, সাহিত্যের আলাদা এক শাখা। ভালো লেখক হতে হলে ভালো পাঠক হতে হয়, ভালো পাঠক হতে হলে ভালো লেখকদের চিনতে হয়, আর কোনাকুনি পথে ভালো লেখক চিনে নিতে হলে ভালো সমালোচনা পড়তে হয়। তারপর ভালো সমালোচনা চিনব কীভাবে – এই প্রশ্ন না করলেও চলবে। কেননা মন্দ সমালোচনা খুব কম। সাহিত্যে সিদ্ধিলাভ না করে সচরাচর কেউ সাহিত্যসমালোচনায় যান না। তবু আপনি সমালোচকের নিজের সাহিত্যকৃতির দিকে তাকাতে পারেন, দেখতে পারেন তিনি কতটা লিখেছেন আর কী কী সাহিত্যপুরস্কারে স্বীকৃত ও ভূষিত হয়েছেন।
যখন বই পড়তে শুরু করি, ছেলেবেলায়, স্বাভাবিকভাবেই ভালোমন্দের বিচারবোধ ছিল না। অনেক বাজে বই পড়ে আমি সময় নষ্ট করেছি এবং বাজে অভিজ্ঞতা লাভ করেছি। যদিও, মজার ব্যাপার, আজ সেই বাজে অভিজ্ঞতাও মাঝে মাঝে কাজে লাগে। অবশ্য আমার পড়া ‘অনেক বাজে বই’-এর সংখ্যা অনেক পাঠকের চেয়ে অনেক কম বলেই মনে হয়। কেননা অর্থ বোঝার চেষ্টা থেকে মূল্য বোঝার চেষ্টা কখনো আলাদা করি নি। তবু মোটামুটি গ্রাহ্য বিচারবোধ তৈরি করতে আমাকে টানা বছর পাঁচেক ধরে নির্বিচারে শো পাঁচেক বই পড়তে হয়েছিল। অতঃপর, আনন্দের কথা, সেই বোধ পরিণত হয়ে উঠতে বেশি সময় লাগে নি। সৈয়দ আলী আহসানের ‘আধুনিক বাংলা কবিতা : শব্দের অনুষঙ্গে’ এবং আবদুল মান্নান সৈয়দের ‘করতলে মহাদেশ’ পড়ে কবিতার মুখ আমি মুখস্থ করে নিয়েছিলাম, তারপর অকবিতা পড়ে আর সময় নষ্ট করি না। সৈয়দ শামসুল হকের ‘গল্পের কলকব্জা’ পড়ার পর মন্দ গল্প চিনতে দেরি হয় না। তপোধীর ভট্টাচার্যের ‘উপন্যাসের প্রতিবেদন’ পড়ার পর আর কোনো ‘অপন্যাস’ আমি পড়ি নি। প্রশংসা সমস্ত প-িত সমালোচকের, যাঁরা যুগে যুগে আপন চোখের আলোয় আবহমান সাহিত্যপাঠককে শুদ্ধ পথের সাহিত্য যুগিয়ে সাহায্য করেন।
গঠনমূলক সমালোচনা তা-ই, যা লেখক ও পাঠক সকলের জন্যে উপকারী। এর দ্বারা সমালোচিত লেখক সমালোচনায় চিহ্নিত তাঁর শক্তিমত্তা আরো বাড়াতে ও সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে উঠতে নিবিষ্ট হন, পরের লেখকেরা আগেই সতর্ক ও সংহত হওয়ার নির্দেশ পান এবং পাঠকেরা রচনার গুণাগুণ চেনেন ও গুণবিচার শেখেন। এমন সমালোচনা লিখতে কী কী নিয়ম মানতে হয় বা সমালোচকের কোন্ কোন্ গুণ থাকতে হয়, সেসব তালিকা করে বেঁধে দেওয়া যায় না। বরং সমালোচক, বেশিভাগ ক্ষেত্রে যিনি গুরুতম সাহিত্যিকও – তাঁর ভাষাজ্ঞান, শিল্পবোধ ও বিষয়প্রজ্ঞার ওপরই সমালোচনার সার্থকতার ভরসা। তবু, সমালোচকদের জন্যে নয়, নতুন পাঠক ও শিক্ষার্থীদের চিন্তায় সহায়তার উদ্দেশ্যে বিশেষ পাঁচটি মান্য নিয়ম উক্ত হলো:
১. লেখকের উদ্দেশ্য অনুধাবন। লেখক আসলে কী বুঝাতে চেয়েছেন আর কতটা, আগে হুবহু তা-ই বুঝতে হবে। সমালোচক এ বোঝায় ভুল করলে তাঁর সমালোচনাও ভুল হবে। লেখক যা বলতে চান নি, তা না বলার জন্যে তাঁকে দোষা যাবে না। রচনা ঠিক বোঝার ব্যাপার না হয়ে সূক্ষ্ম উপলব্ধির হলে, যেমন গূঢ়তর কবিতা, তবে তা ভুলশুদ্ধির সীমানার বাইরে; সমালোচক এক্ষেত্রে ওই উপলব্ধি ও তা প্রকাশের ধরনের অনন্যতা, শৈল্পিকতা ও তাৎপর্য খোলাসা করবেন কেবল, এর বেশি কিছু নয়।
২. আদর্শিক নিরপেক্ষতা। সমালোচক আসীন হবেন ধর্ম, জাতি, অঞ্চল ও অন্যান্য আদর্শিক বৃত্তের উপরে। শিল্পের ভেতরে দুনিয়ার সবই আছে, কিন্তু শিল্পকর্মের বিচারক দুনিয়ায় আর কেউ নেই, শিল্পই শুধু। অবশ্য তার মানে এই নয় যে, সাহিত্যিকের আদর্শিক ভ্রান্তির সমালোচনা করা যাবে না; যাবে, তবে তা সমালোচকের ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীগত আদর্শবোধ দিয়ে নয়, বরং প্রতিপন্ন সত্য ও নিরপেক্ষ শিল্পসাহিত্যের মানদন্ডে। পক্ষতাড়িত সমালোচনা মারামারিজগতের জিনিস, সাহিত্যজগতের নয়।
৩. ইতিবাচ্যে প্রাধান্য। সব রচনা যেমন সাহিত্য নয়, তেমনি সব সাহিত্যকর্মও সমালোচনীয় নয়। যা সমালোচনার জন্যে চয়িত হয়, তা নিশ্চয় বিশেষ বলেই হয়। তাই সমালোচনীয় রচনা সমালোচনার আগেই অসাধারণ এবং এক অর্থে প্রশংসনীয়। লেখকের এ কৃতিত্বের প্রতি সমালোচক সুবিচার করবেন। ত্রুটিনির্দেশের চেয়ে রচনার ভালো গুণগুলি খুঁজে বের করে সেসবেই তিনি আলোকপাত করবেন বেশি।
৪. সামাজিক মূল্যায়ন উপেক্ষা। বিশেষ বিশ্বাস-অবিশ্বাস, দৃষ্টিভঙ্গি বা মনস্তাত্ত্বিক কৌশল ধারণ করেন বলে কোনো লেখক সামাজিকভাবে অতি জনপ্রিয় বা অতি নিন্দিত হতে পারেন। সাহিত্যসমালোচক এসব নিন্দা-প্রশংসার একবিন্দু পরোয়া করবেন না। তিনি সবসময় মনে রাখবেন যে, তিনি লেখার বিচারক, লেখকের নন।
৫. প্রেক্ষাপট ও আবহমানতা। প্রত্যেকটি লেখারই নিজস্ব প্রেক্ষাপট থাকে, যা সেই লেখাকে সম্ভব করে তোলে কিংবা বিশিষ্ট করে। অন্যদিকে, বর্তমানতার বাইরে সেই লেখার থাকে একটি সর্বকালীন মূল্য। সমালোচক একই সঙ্গে এ দুটি দিকই মূল্যায়ন করবেন, তাহলে তাঁর সমালোচনাও হয়ে উঠবে মূল্যবান রচনা।
আবদুল হক, কবি ও প্রাবন্ধিক; সিলেট; ০১, ০২, ২০১৫; ০১৭৩৫৫৩০০০০; [email protected]