আদিবাসী এক নেতাকে নিয়ে এ কোন খেলা খেলছে পুলিশ?
নুরুল হক শিপুঃ জয় মাহাত্ম্য কুর্মী। আদিবাসী এক চাশ্রমিক নেতা। কাজ করেন রাবার বাগানে। বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন সংঘ সিলেট জেলা শাখার যুগ্ম সম্পাদক ও মালনীছড়া রাবার শ্রমিক সংঘের সভাপতি। সম্প্রতি তাকে একটি হত্যা মামলার আসামী দেখিয়ে পাঠানো হয় কারাগারে। আদায় করার চেষ্টা হয় স্বীকারোক্তির। পুলিশি নির্যাতন আর অন্ধকার কারাগার থেকে বিচারের বাণী উকি দেয় তার জীবনে। গত মঙ্গলবার জামিনে ছাড়া পান। কিন্তু পুলিশ নাছোড়বান্দা। জয়ের পিছু ছাড়েনি। চার দেয়ালের বাইরে একটু মুক্তির স্বাদ নেওয়ার সময়ই আমানবিকভাবে ফের জয়কে আটক করা হয়। একদিন পর গতকাল বুধবার তাকে যে মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়, সেই মামলার বাদীও জানেন না কে আসামি আর কে সন্দেহভাজন। পুলিশ মনগড়া তদন্তের নামে হাতের কাছে পাওয়া জয় মাহাত্ম্যকে এবার মামলার জালে ঢোকায়। সন্দেশভাজন হিসেবে আসামি করে কারাগারে পাঠানো হয়। এক জয় মাহাত্মকে নিয়ে পুলিশের এমন কান্ডে প্রশ্ন উঠছে- কার খেলা খেলছে পুলিশ?
মঙ্গলবার সকাল ১১টায় জয় মাহাত্ম্য কুর্মী কারাগার থেকে বের হন। জেল গেইটে বিপুল সংখ্যক রাবার শ্রমিক তাকে সংবর্ধনা দেন। এরপর মহাজনপট্টিস্থ কার্যালয়ে সহকর্মীদের নিয়ে যান জয় মাহাত্ম্য কুর্মী। কিন্তু সে আনন্দ আর বেশি সময় সয়নি তার কপালে। কার্যালয় থেকে জয় মাহাত্ম্য কুর্মীকে আলোচনার কথা বলে পুণরায় করা হয় গ্রেপ্তার। এয়ারপোর্ট থানা পুলিশ মাহাত্ম্য কুর্মীকে প্রথমে কোতোয়ালী থানা হাজতে রাখেন। পরে খবর মিলে তাকে একটি ছিনতাই মামলায় ফের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। মাহাত্ম্য কুর্মীর এ গ্রেপ্তার নিয়ে দেখা দিয়েছে রহস্য। কারণ পুলিশ বলছে তাকে গত ১৬ অক্টোবর লাক্কাতুড়া চা বাগানের দায়ের করা ডাকাতি মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আর বাগানের ম্যানেজার মামলার বাদি বলছেন বাগানের পক্ষ থেকে ছিনতাই মামলা দায়ের করা হয়েছে। বাগানো কোনো ডাকাতির ঘটনা ঘটেনি। আর এ মামলায় কোনো আসামীর নাম উল্লেখ নেই। মামলাটি বাগান কর্তৃপক্ষ দায়ের করেছেন অজ্ঞাত আসামী করে। এয়ারপোর্ট থানা পুলিশ এ মামলায় জয় মাহাত্ম্য কুর্মীকে সন্দেহ জনক আসামী হিসেবে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে প্রেরণ করে। ওই মামলায়ও জয় মাহাত্ম্য কুর্মী এজহার নামীয় আসামী নয় বলে দাবি রাবার শ্রমিকদের।
জানা গেছে, মঙ্গলবার গ্রেপ্তারের পর মাহাত্ম্য কুর্মীকে সংগঠনের নেতা কর্মীরা কোতোয়ালী থানা হাজতে দেখতে যান। এ সময় পুলিশ তাঁর সাথে কাউকে দেখা করতে দেয়নি। জয় মাহাত্ম্য কুর্মী জেল গেইট থেকে বের হওয়ার পর মালনীছড়া রাবার বাগান ম্যানেজার সাহাব উদ্দিন রাবার শ্রমিক শাহিনকে মোবাইল ফোনে মাহাত্ম্য কুর্মীর অবস্থান জানতে চাইলে রাবার শ্রমিক শাহিন জয় মাহাত্য কুর্মী সংগঠনের মহাজনপট্টিস্থ কার্য্যালয়ে আছে বলে জানান। এর ১৫ মিনিট পরেই এয়ারপোর্ট থানা পুলিশ কুর্মীকে গ্রেপ্তার করে।
সূত্র মতে, গত বছর ১৬ অক্টোবর লাক্কাতুড়া চা বাগানের শ্রমিকদের সাপ্তাহিক মজুরির ৬ লাখ টাকা ছিনতাই হয়েছে। ছিনতাইকারীরা গাড়ির গ্লাস ভাঙচুর করে ভেতরে থাকা টাকা ছিনিয়ে নিয়েছে। ওই দিন সকাল ১১টার দিকে আম্বরখানা-বিমানবন্দর সড়কের মজুমদারি জামে মসজিদের সামনে এ ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। ছিনতাইকারীদের ছুরিকাঘাতে বাগানের এক কর্মচারী আহত হন। এ ঘটনায় লাক্কারতুড়া চা বাগানের ম্যানেজার সৈয়দ মাহমুদ হাসান ওই দিনই এয়ারপোর্ট থানায় অজ্ঞাত আসামী করে একটি ছিনতাই মামলা দায়ের করেন। যার নং-৮ (১০/১৪)। কিন্তু রহস্য জনক কারণে পুলিশ রাবার শ্রমিক সংঘের সভাপতি জয় মাহাত্ম্য কুর্মীকে ওই মামলায় আসামী দেখিয়ে কারাগারে পাঠিয়েছে। এর আগে গত বছরের ৯ নভেম্বর মালনীছড়া চা বাগানের ভেতর থেকে এয়ারপোর্ট থানা পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে। পরে সাহেব বাজারে একটি হত্যা মামলায় তাকে জড়িয়ে কারাগারে প্রেরণ করা হয়।
এ ব্যাপারে কথা হয় ছিনতাই মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এয়ারপোর্ট থানার এসআই হুমায়ুন কবিরের সাথে। তিনি বলেন, জয় মাহাত্ম্য কুর্মীকে লাক্কারতুড়া চা বাগের দায়ের করা ডাকাতি মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তিনি ওই মামলায় জড়িত থাকার কারণ প্রসঙ্গে জানান, বিভিন্ন সোর্সের তথ্যমতে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আমরা তাকে ওই মামলায় সন্দেহজনক আসামী হিসেবে গ্রেপ্তার করি। আদালত তাকে কারাগারে প্রেরণের নির্দেশ দিয়েছেন। মামলার এজহারে জয় মাহাত্ম্য কুর্মীর নাম নেই জানিয়ে তিনি বলেন, বিষয়টি তদন্ত চলছে। তদন্ত সাপেক্ষে পরবর্তী প্রতিবেদন দেয়া হবে।
লাক্কারতুড়া চা বাগানের ম্যানেজার সৈয়দ মাহমুদ হাসান সুরমা টাইমস’কে জানান, ছিনতাইয়ের ঘটনায় দায়ের করা মামলাটি অজ্ঞাত আসামী দিয়ে করা হয়েছে। পুলিশ কখন কাকে গ্রেপ্তার করছে; তা তাদের জানা নেই। বিয়য়টি সম্পূর্ণ পুলিশের তদন্তের ব্যাপার।
পাল্টাপাল্টি এমন বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে সুরমা টাইমস’র অনুসন্ধানে আভাস মেলে জয় মাহাত্ম আসলে কার ক্রীড়ানক। সিলেটে চা বাগান রাজ্যে একচেটিয়া প্রভাব বিস্তার করে প্রভাবশালী একটি গোষ্ঠী পুলিশকে হাতিয়ার করে রেখেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন বাগানি জানান, মহানগর পুলিশের উত্তরেজুড়ে চা বাগান। তাই উত্তরের দায়িত্বে থাকা পুলিশ কর্মকর্তাদের বৃহস্পতি এখন তুঙ্গে। সামান্য চায়ের আড্ডা থেকে জীবনযাপনের সকল দায়ভার প্রভাবশালী গোষ্ঠী দেখভাল করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। কেউ কেউ ‘চাপতিদের দানে’ ডুপ্লেক্স আবাসনে বিনা ভাড়ায়ও বসবাস করছেন। এমন খবর মালনীছড়া চা বাগান, রাবার বাগান থেকে শুরু করে লাক্কাতুরা চা বাগানের পল্লির পরতে পরতে রয়েছে। যেখানে জয় মাহাত্ম্য কুর্মী আদিবাসী এক নেতার আসনে আসীন।
আদিবাসী চাশ্রমিককে নিয়ে পুলিশের এমন ভূমিকা প্রসঙ্গে মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (উত্তর ও গণমাধ্যম) মো. রহমত উল্লাহ এক হাত ক্ষোভ ঝাড়েন। গত রাতে সুরমা টাইমস’কে তিনি জানান, কুর্মীর বিরুদ্ধে অনেক তথ্য পুলিশের কাছে রয়েছে। একটা হত্যা মামলার এজহার নামীয় আসামী। মঙ্গলবার জয় মাহাত্ম্য কুর্মীকে গ্রেপ্তার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ডাকাতি মামলায় তাকে সন্দেহজনক আসামী হিসেবে গ্রেপ্তার করেছেন।
ছিনতাই ঘটনা আর বাদীর দায়ের করা ছিনতাই মামলা জয় মাহাত্ম্যকে ধরতে ডাকাতির মামলায় রূপান্তর প্রসঙ্গে তিনি বলেন, যে সকল ছিনতাইয়ের ঘটনায় বেশি লোক জড়িত থাকে; সেগুলোর ধারা ডাকাতিতে পড়ে।