বিবৃতি জালিয়াতি সরকারের কূটকৌশলের অংশ হতে পারে- সাদেক হোসেন খোকা
খালেদার দুই উপদেষ্টা জাহিদ ও মুজিবকে অব্যাহতি
নিউইয়র্ক ধেকে এনা: ছয় জন আমেরিকান কংগ্রেসম্যানের স্বাক্ষর জালিয়াতি করে দলের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করার অভিযোগে বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা এবং বৈদেশিক বিশষ দূত জাহিদ এফ সর্দার সাদীকে, সেই সাথে অপর উপদেষ্টা এবং বৈদেশিক বিষয়ক বিশেষ দূত, যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা আহবায়ক ডা. মজিবুর রহমান মজুমদারকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। একই সাথে বিবৃতি জালিয়াতি করা কেবল মাত্র সরকারের কূটকৌশলেরই অংশ হতে পারে, অন্য কিছু নয়। নিশ্চয় যথাসময়ে এই ঘটনার রহস্য উন্মোচিত হবে। গত ১৩ জানুয়ারি (নিউইয়র্ক সময়) সন্ধ্যায় জ্যাকসন হাইটসের ফুডকোর্ট রেস্টুরেন্টে বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির ব্যানারে এক সাংবাদিক সম্মেলনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সহ সভাপতি এবং ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকা এ কথা বলেন। সংবাদ সম্মেলনে অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির সাবেক সভাপতি আব্দুল লতিফ স¤্রাট, সাবেক সাধারণ সম্পাদক জিল্লুর রহমান জিল্লু, সাবেক সিনিয়র সহ সভাপতি গিয়াস আহমেদ, সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বাকির আজাদ, হেলাল উদ্দিন, বিএনপি নেতা গিয়াস উদ্দিন, ড. শওকত আলী, যুব দলের সাধারণ সম্পাদক আবু সাঈদ আহমেদ, যুব দল নেতা রেজাউল আজাদ ভূইয়া, আতিকুল হক আহাদ, সরোয়ার খান বাবু প্রমুখ।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে সাদেক হোসেন খোকা বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধে অগণিত শহীদের জীবন ও অসংখ্য মা- বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ আজ এক কঠিন দু:সময় পার করছে। বর্তমান স্বৈরাচারি ও জুলুমবাজ সরকার যে কোন মূল্যে অবৈধভাবে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার অসৎ উদ্দেশ্যে গোটা দেশকে এক অনিবার্য সংঘাতের মুখে ঠেলে দিয়েছে। সংকীর্ণ দলীয় স্বার্থ হাসিলের জন্য সকল রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে তারা অবলীলায় ধ্বংস করে চলেছে। আইন- শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দাঁড় করিয়ে দেয়া হয়েছে জগণের মুখোমুখি। এসব বহিনীর এক শ্রেণীর দলবাজ এবং বিশেষ একটি এলাকার সদস্যরা প্রকাশ্যে নির্বিচারে গুলি করে নিরীহ জনসাধারণকে হত্যা করার এক পৈশাচিক উৎসবে মেতেছে। দেশের সীমান্ত প্রহরায় থাকা বিজিবির সদস্যদেরকে তাদের বিধিবদ্ধ দায়িত্ব থেকে তুলে এনে বিরোধী দল দমনের কাজে লেলিয়ে দেয়া হয়েছে। এসব বাহিনীর পাশাপাশি রাষ্ট্রের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা এবং আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ সংগঠনসমূহের সশস্ত্র ক্যাডারদেরকেও নিয়োজিত করা হয়েছে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ নির্মূলের কাজে।
তিনি আরো বলেন, সরকারের এমন একগুঁয়ে ও আক্রমণাত্মক ভূমিকায় দেশ থেকে গণতন্ত্র আজ পুরোপুরি নির্বাসিত। বিরোধী দলসমূহের ন্যুনতম রাজনৈতিক অধিকারও আজ আর অবশিষ্ট নেই। ক্ষমতাসীনরা তথাকথিত ১৪৪ ধারার মধ্যেই খুশি মতো সভা- সমাবেশ এবং বিরোধী দল দমনের উৎসব করছে। অথচ বিরোধী দলের কর্মী- সমর্থকদের রাস্তায়ও দাঁড়াতে দেয়া হচ্ছে না। কথায় কথায় গুলি, বেধড়ক পিটুনি অথবা গণগ্রেফতার। এই হলো বাংলাদেশে আজ গণতন্ত্রের চেহারা। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নানা রকম নিয়ন্ত্রণ আরোপের ফলে মত প্রকাশের অধিকার তথা গণমাধ্যমের স্বাধীনতাও এখন সম্পূর্ণরূপে খাঁচায় বন্দী। প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় চলছে নিয়ন্ত্রিত সম্প্রচার। সরকারের নির্দেশ সম্পূর্ণরূপে অনুসরণে ব্যর্থ হওয়ায় একুশে টেলিভিশনের চেয়ারম্যান আব্দুস সালামকে মিথ্যা মামলায় গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। গণমাধ্যমের অন্য সদস্যরাও রয়েছেন আতঙ্কে। সর্বত্র এক শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা বিরাজ করছে।
তিনি বলেন, বিগত দেড় সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয় তালাবদ্ধ। অবৈধ সরকারের নির্দেশে পুলিশ গত ৩ জানুয়ারি বিএনপি অফিসে তালা ঝুলিয়ে দেয়। অন্যদিকে বিএনপির চেয়ারপার্সন ও তিনবারের প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে তারা তার গুলশান কার্যালয়ে বর্বরোচিত কায়দায় বন্দী করে রাখেছে। এমন কি তাঁকে লক্ষ্য করে আন্তর্জাতিকভাবে ব্যবহার নিষিদ্ধ বিষাক্ত পিপার স্প্রে নিক্ষেপ করতেও দ্বিধা করেনি সরকারের পেটোয়া বাহিনী। তিনি বলেন, সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ও বিএনপির চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা রিয়াজ রহমানের মত অত্যন্ত নিরীহ ও সজ্জন ব্যক্তিকে আজ গুলি করে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়া হয়েছে। সাবেক কূটনৈতিক সাবিউদ্দিনের উপর হামলা করা হয়েছে। বিএনপি নেতাদের বাড়িতে একের পর এক বোমা হামলা চালানো হচ্ছে। প্রায় প্রতিদিনই বিরোধী দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের দলে দলে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠানো হচ্ছে। মিথ্যা ও বানোয়াট মামলায় তাদের রিমান্ডে নিয়ে চালানো হচ্ছে নির্মম নির্যাতন। সরকারের এমন পাশবিক দমন- পীড়নের বিরুদ্ধে ইতিমধ্যেই দেশ জুড়ে জনগণের স্বত:স্ফূর্ত সংগ্রাম গড়ে উঠেছে। রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে দেশের প্রতিটি শহর, বন্দর, গ্রাম এমন কি প্রত্যন্ত পাড়া- মহল্লায়ও আপামর জনতার প্রতিরোধ- সংগ্রামের ক্রম:বর্ধমান তীব্রতায় নড়ে উঠেছে স্বৈরশাসকের ভিত। আর তাতেই দিশেহারা হয়ে সরকার অত্যাচার- নির্যাতনের মাত্রা বৃদ্ধির পাশাপাশি আন্দোলনের কর্মী- সমর্থকদের বিভ্রান্ত করতে নানা রকম কূট- কৌশলেরও আশ্রয় গ্রহণ করছে। এই প্রক্রিয়ার অংশ হিসাবে তারা মিডিয়া নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে বিএনপির বিরুদ্ধে বিরামহীন অপপ্রচারে লিপ্ত হয়েছে।
তিনি আরো বলেন, একটি আনাকাঙ্খিত ঘটনার প্রতি আমি আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। আপনাদের মত আমরাও গণমাধ্যমের সূত্রে বাংলাদেশের চলমান পরিস্থিতির বিষয়ে মার্কিন কংগ্রেসের কতিপয় সদস্যের একটি তথাকথিত বিবৃতির খবর জানতে পারি। পরক্ষণে আবার সংবাদ মাধ্যমের খবরেই জানা যায় যে, বিবৃতিটি সঠিক নয়। এটি ছিলো ব্যক্তি বিশেষের রহস্যময় তৎপরতার ফসল। নিন্দনীয় এই ঘটনার সঙ্গে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) দুই জন প্রবাসী প্রতিনিধির সম্পৃক্ততার তথ্য জানাজানি হওয়ার প্রেক্ষিতে বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া তাৎক্ষণিকভাবে তাদের নিয়োগ বাতিলের নির্দেশ দেন। সে অনুযায়ী ১৩ জানুয়ারি ২০১৫ বিএনপির কেন্দ্রীয় দফতরের দায়িত্বপ্রাপ্ত যুগ্মমহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদ স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত ডা. মজিবুর রহমান মজুমদার ও জাহিদ এফ সর্দার সাদিকে বিএনপির বিশেষ উপদেষ্টা ও বৈদেশিক দূতের পদ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। উল্লেখ্য, ২০১৩ সালের ১৭ নভেম্বর নির্দিষ্ট একটি দায়িত্ব পালনের জন্য তাদেরকে সাময়িকভাবে এই নিয়োগ দেয়া হয়েছিলো, আজকের বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে সেই নিয়োগ বাতিল করা হলো। রিবজী আহমেদের স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিটি উপস্থিত সাংবাদিকদের হাতে তুলে দেয়া হয়। তিনি আরো বলেন, আমরা খুঁজে দেখার চেষ্টা করছি যে, মার্কিন কংগ্রেসের সদস্যদের কথিত বিবৃতি জালিয়াতির এই ঘটনার সঙ্গে বিএনপির নিয়োগ বাতিলকৃত এই ব্যক্তি সরকারের কোন ষড়যন্ত্রের অংশীদার হয়েছে কিনা। তিনি সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, এ ব্যাপারে বিএনপির সাবেক মন্ত্রী ওসমান ফারুককে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। তিনি বর্তমানে ওয়াশিংটন রয়েছেন এবং সংশ্লিষ্ট কংগ্রেসম্যানদের সাথে দেখা করছেন। অন্যদিকে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে যেহেতু সরকার তালা লাগিয়ে দিয়েছে সেহেতু আমাকে বিষয়টি তুলে ধরার দায়িত্ব দেয়া হয়। সেই দায়িত্বের অংশ হিসাবেই বিএনপি কেন্দ্রীয় কমিটির ব্যানারে আমি আজকে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেছি।
তিনি বলেন, এ কথা সকলেরই জানা যে, বাংলাদেশে বিগত কয়েক বছর যাবত সরকারের অগণতান্ত্রিক স্বেচ্ছাচারি কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে জাতিসংঘ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ দুনিয়ার সকল উল্লেখযোগ্য শক্তি অব্যাহতভাবে তাদের সুস্পষ্ট অবস্থানের কথা জানিয়ে আসছে। বিশেষত: গত বছরের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের নামে বাংলাদেশে যেভাবে গণতন্ত্র হত্যা করা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক মহল এর বিরুদ্ধে তাদের পরিষ্কার অবস্থানের কথা দফায় দফায় জানান দিয়েছে। এমতাবস্থায় বাংলাদেশের বর্তমান স্বৈরশাসকের অগণতান্ত্রিক কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস সদস্যদের বিবৃতি জালিয়াতি করা একটি রহস্যময় ঘটনাই বটে। যেখানে যুক্তরাষ্ট্র সরকার, কংগ্রেস ও সিনেট প্রায় নিয়মিতভাবেই বাংলাদেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার তাগিদ দিয়ে চলেছে, সেখানে এই ইস্যুতে তাদের বিবৃতি জালিয়াতি করা কেবলমাত্র সরকারের কূট- কৌশলেরই অংশ হতে পারে, অন্যকিছু নয়। নিশ্চয় যথাসময়ে এই ঘটনার রহস্য উন্মোচিত হবে।
তিনি আরো বলেন, চিকিৎসার প্রয়োজনে এই দূর দেশে অবস্থানের কারণে জাতির এই কঠিন দু:সময়ে রাজপথের আন্দোলন- সংগ্রামে সশরীরে অংশ নিতে না পারায় বেদনায় আমি প্রতি মহূর্তে দগ্ধ হচ্ছি। আজ আপনাদের মাধ্যমে আমি বাংলাদেশের স্বেচ্ছাচারি অবৈধ সরকারের প্রতি অবিলম্বে ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে দেশে গণতন্ত্র পুন:প্রতিষ্ঠাতার পথ সুগম করার দাবি জানাই। অন্যথায় দেশের মানুষ অচিরেই সর্বাত্মক আন্দোলন- সংগ্রামের মাধ্যমে এই ক্ষমতালিপ্সু ডাকাত- সরকারকে টেনে হিঁচড়ে ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপের মধ্য দিয়ে আমাদের প্রিয় স্বদেশে স্বদেশে গণতন্ত্র পুনরুজ্জীবিত করবে।
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমি পালিয়ে থাকিনি। আমি ক্যান্সারের চিকিৎসা নিচ্ছি। তিনি পরিষ্কারভাবে বলেন, মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করি এমন কোন আন্দোলন- সংগ্রাম ছিলো না যেখানে আমি অংশগ্রহণ করিনি। রজপথে গুলিকে আমি ভয় করিনি। এখন দেশের থাকার শারীরিক অবস্থা থাকলে আমি অবশ্যই দেশে থাকতাম। আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বেগম খালেদা জিয়ার সাথে আমার আজকেও কথা হয়েছে। তিনি ক্ষমতায় যাবার জন্য আন্দোলন করছেন না। তিনি মানুষের গণতান্ত্রিক এবং ভোটের অধিকারের জন্য আন্দোলন করছেন। ভারতের বিজেপির সভাপতি অমিত সাহার সঙ্গে খালেদা জিয়ার টেলিফোন আলাপ সম্পর্কে তিনি বলেন, অমিত সাহা খালেদা জিয়াকে ফোন করেছিলেন। দেশের যে দুটো গণমাধ্যমে (৭১ টিভি, চ্যানেল ২৪) যে অমিত সাহার বক্তব্য পেশ করা হয়েছে। সেটা আসল অমিত সাহার কথা নয়। এই ঘটনা যদি মিথ্যা হতো তাহলে বিজেপির পক্ষ থেকেই কোন বিবৃতি প্রদান করা হতো। এই অবস্থা থেকে মুক্তির উপায় কী- এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, সরকারকে অবশ্যই সংলাপের আহবান করতে হবে। না হয় সর্বদলীয় সরকার গঠন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন দিতে হবে। তিনি আরো বলেন, দেশে যে অবস্থা বিরাজ করছে তা কোনভাবেই সুখকর নয়। তিনি ক্ষোভের সাথে বলেন, প্রধানমন্ত্রী কীভাবে এমন নির্জলা মিথ্যা কথা বলে যাচ্ছেন। তারেক রহমান ও বেগম জিয়া সম্পর্কে কটুক্তি করে প্রধানমন্ত্রী তার পদকেই কলঙ্কিত করছেন।