পে-স্কেল/২০১৪ খ্রি. জনমত যাচাই পূর্বক পুনর্বিবেচনা প্রসঙ্গে
মো. নুরুল ইসলাম মজুমদার
সরকারি কর্মকর্তা, কর্মচারীদের জন্য পে-স্কেল-২০১৪ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে পে-কমিশনের পক্ষ থেকে সরকারের নিকট যে খসড়া পেশ করা হয়েছে যা আমরা প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার মাধ্যমে অবগত হয়েছি। খসড়াটি পেশ করার সাথে সাথে অনেক স্থানে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে, রিক্শাসহ ছোট ছোট যানবাহনের ভাড়া বৃদ্ধি পেয়েছে, বহু বাসা/বাড়ির মালিকগণ বাসা/বাড়ির ভাড়া বৃদ্ধি করে ফেলেছেন। ১৬ কোটি মানুষের এদেশে ১২ লক্ষ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য যে রাজকীয় পে-স্কেল প্রদানের প্রস্তাব পেশ করা হয়েছে, প্রস্তাব দেখে মনে হচ্ছে পে-কমিশন দরিদ্র জনগোষ্ঠী ও খেটে খাওয়া মানুষদের কথা বেমালুম ভুলে গেছেন। প্রস্তাবিত পে-স্কেল বাস্তবায়িত হলে সাধারণ মানুষ দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সমাজে বৈষম্য প্রকট আকার ধারণ করবে। দরিদ্র মানুষেরা ক্রয়-ক্ষমতা হারিয়ে ফেলবে। দেশের উন্নয়ন ক্ষতিগ্রস্ত হবে। জানমালের নিরাপত্তা বিঘিœত হবে, এমনকি সমাজের শান্তি ব্যাহত হবে। দাখিলকৃত প্রস্তাবিত পে-স্কেল সমর্থন করা যায় না।
পে-কমিশন পিতা-মাতাসহ ৬ জনের হিসাব ধরে প্রস্তাব দাখিল করেছেন, তা বাস্তবের সাথে মিল নেই। আমরা সবাই সর্বপ্রথমেই রাষ্ট্রের কল্যাণের কথা চিন্তা করে পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। তারপর জানতে হবে পরিবার কাকে বলে? একটি পরিবার বলতে আমরা কী বুঝি? একটি পরিবারে কত সংখ্যক সদস্য থাকবে তার সংখ্যা নির্ধারণ করতে হবে। অর্থাৎ পরিবারের সংজ্ঞা ঠিক করতে হবে। একজন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর চাকরিকালীন সময়ে যদি তার পিতা বা মাতা মারা যান তবে তিনি কী ৬ সদস্য বিশিষ্ট পে-স্কেলের বেতনভাতা ভোগ করবেন? যার পিতা-মাতা নেই (এতিম) তিনি কী ৬ সদস্য বিশিষ্ট পে-স্কেলের বেতনভাতা পাবেন? কোন কর্মকর্তা বা কর্মচারীর মাতা জীবিত আছেন পিতা মৃত্যুবরণ করেছেন তা হলে তিনি কী ৬ সদস্য বিশিষ্ট প্রস্তাবিত পে-স্কেলের বেতনভাতা পাবেন? এ ধরনের আরো অনেক প্রশ্ন হতে পারে। আমরা লক্ষ্য করলে দেখতে পাবো- আনুমানিক ২০-২৫ ভাগ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সাথে একীভূত হয়ে পিতা-মাতা বসবাস করেন এর বেশি হবে না। আরো একটি বিষয় উল্লেখ আবশ্যক যে, একজন সরকারি চাকরিজীবী চাকরিতে প্রবেশের পর চাকরিতে প্রবেশের পর চাকরিরত অবস্থায় তার বয়স যখন ৫০ বছরে দাঁড়াবে তখন হিসাব করলে দেখা যাবে তার পিতা-মাতার বয়স দাঁড়াবে ৫০+৩০=৮০ বছর। অনেক মানুষ ৮০ বছর বয়স পর্যন্ত জীবিত থাকেন না। একজন সরকারি চাকরিজীবী পিআরএল’সহ ৬০ বছর পর্যন্ত চাকরি করেন। তাহলে ব্যাপারটি কী দাঁড়ায়, ৬০+৩০=৯০ বছর। বিজ্ঞজনেরা একটু ভেবে দেখবেন কী? কোন কোন পরিবারে পিতাও চাকরি করেন আবার মাতাও চাকরি করেন। কোন-কোন পরিবারে পিতা ব্যবসা করেন, তারা সন্তান-সন্ততি থেকে পৃথকভাবে বসবাস করেন। অনেক পিতা মধ্যপ্রাচ্যসহ পৃথিবীর উন্নত রাষ্ট্রগুলোতে অবস্থান করে আয়-রোজগার করে থাকেন। অনেক পরিবার রয়েছে তারা সন্তান-সন্ততি থেকে দূরে পৃথকভাবে বসবাস করেন। আমরা পত্র-পত্রিকায় লক্ষ্য করেছি, বনখেকো নামে পরিচিত সাবেক বন সংরক্ষক যিনি এখন জেলে আছেন, অঢেল সম্পদ থাকা সত্বেও তিনি তার মাকে মাসিক মাত্র ২ হাজার ৫শ’ সংসার পরিচালনার জন্য দিতেন। এরকম অনেক ঘটনা সমাজে রয়েছে। উদাহরণ দিয়ে শেষ করা যাবে না। এ হল বাস্তব চিত্র। আমরা সবাই মূলত গ্রামের মানুষ, বাস্তব চিত্র আমরা প্রতিনিয়ত দেখতে পাচ্ছি, তাহলে কোন যুক্তিতে ৬ সদস্য বিশিষ্ট পে-স্কেলের খসড়া দীর্ঘ এক বছর কষ্ট করে দাখিল করা হল? এদেশে শুধুমাত্র সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীগণই বসবাস করেন না। নির্বাচিত প্রতিনিধি, আধা-সরকারি, সায়ত্ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক, বীমা, এনজিও, গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি, বিভিন্ন কলকারখানা, হোটেল রেস্তোরাঁর শ্রমিক, কৃষি শ্রমিক, চা শ্রমিক, বেসরকারি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সংবাদকর্মী তাদের কী হবে? তাদেরকে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ন্যায় বেতনভাতা প্রদান করা আদৌ কী সম্ভব? আয়ের রাস্তা কোথায়? পে-স্কেলের টাকা জোগান দেয়ার জন্য বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি করতে হবে এবং বিভিন্ন খাতে কর বৃদ্ধি করতে হবে। দরিদ্র মানুষগুলোর পক্ষে করের বোঝা বহন করা সম্ভব কী না তা গভীরভাবে ভেবে দেখতে হবে। যারা দিনরাত পরিশ্রম করে দেশের আইন-শৃংখলা রক্ষা করছেন যেমন- ইউনিফর্ম সার্ভিসের সদস্যগণ ৩০% ঝুঁকি ভাতা, ভর্তুকি মূল্যে ৪ ইউনিট রেশন পেয়ে থাকেন এখনও পর্যন্ত তাদের অনেক চাহিদাই পূরণ করা সম্ভব হয়নি। এখন তারা ৪ ইউনিট রেশন পাচ্ছেন। স্বাভাবিকভাবেই পে-কমিশনের প্রস্তাব অনুযায়ী তারা ৬ ইউনিট রেশন পাওয়ার আবেদন জানাবেন। বাংলাদেশ এখনও উন্নত রাষ্ট্রে পদার্পণ করেনি। আমরা শতকরা কতভাগ মানুষ সৎভাবে জীবনযাপন করছি, রাষ্ট্রের উন্নয়নের জন্য আমাদের মন-মানসিকতা কতটুকু উন্নত হয়েছে।
পে-স্কেল বাস্তবায়নের পূর্বে সকল স্তরের মানুষের সম্পদের হিসাব নেয়া আবশ্যক। আয়ের সাথে ব্যয়ের মিল আছে কি না? বৈধ ও অবৈধ টাকার উৎস খুঁজে বের করা দরকার। দাখিলকৃত খসড়া পে-স্কেল বাস্তবায়িত হলে দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠী কঠিন সমস্যার সম্মুখিন হবে। খসড়া পে-স্কেলের বিষয়টি জনমত যাচাই করে প্রতিটি পরিবারে ৪ সদস্য বিশিষ্ট হিসাব ধরে ২০১৪ সালের জুলাই মাস থেকে অথবা ১ জানুয়ারি ২০১৫ থেকে অথবা ১ জুলাই ২০১৫ এর পরিবর্তে বাঙালির ঐতিহ্য নববর্ষ ১ বৈশাখ থেকে আর্থিক সাল শুরু করে সংশোধিত আকারে তবে বিভিন্ন বিষয় বিবেচনায় এনে সরকারকে ঝুঁকি না নিয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য ১লা জানুয়ারি ২০১৫ থেকে বাস্তবায়ন শ্রেয় হবে। বিষয়টি সরকারের সদয় দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য আমার মতামত পেশ করছি।
- লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট।
- মোবা: ০১৭৯৪-৩৬৩৪৩৬