‘দেশে অস্বাভাবিক পরিস্থিতি বিরাজ করছে’
সুরমা টাইমস ডেস্কঃ একই অনুষ্ঠানে ছিলেন আওয়ামী লীগ-বিএনপিসহ কয়েকটি দলের নেতারা। ছিলেন সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ও বিশিষ্টজনরা। যারা কথা বলেছেন তাদের প্রত্যেকে তাগিদ দিয়েছেন চলমান রাজনৈতিক সঙ্কট নিরসনে একটি অর্থবহ সংলাপের। সংলাপের বিষয়ে নিজ নিজ অবস্থান থেকে তারা ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তবে সংলাপের গুরুত্ব সম্পর্কে দ্বিমত ছিল না কারও। গতকাল ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব গভর্ননেন্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট আয়োজিত ‘বাংলাদেশের শাসন পরিস্থিতি ২০১৩: গণতন্ত্র, দল, রাজনীতি’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে সংলাপের বিষয়ে এমন ঐকমত্যের বক্তব্য আসে রাজনৈতিক দলের নেতাদের কাছ থেকে। দেশে বর্তমানে অস্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করছে বলেও মন্তব্য করেছেন বক্তারা। ওই গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে বাংলাদেশ বিগত সময়ে যে ভাবে এগিয়েছে ঠিক সেভাবে এগোয়নি দেশের রাজনীতি। প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের মধ্যেই গণতন্ত্র অনুপস্থিত।
অনুষ্ঠানে আলোচনায় অংশ নিয়ে গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন বলেন, দেশের সাধারণ মানুষ সবাই গণতন্ত্র চায়। কিন্তু বাংলাদেশের পত্রপত্রিকা দেখলে মনে হয় জাতি দুটি উপজাতিতে বিভক্ত হয়ে গেছে। একটা দল আরেকটা দলকে দেখলে মেরে ফেলবে। কিন্তু বাংলাদেশের বাস্তব অবস্থা এমন না। সব দলের লোকেরা পারিবারিক, ব্যবসায়িক এমনকি রাজনৈতিকভাবে সম্পর্কিত হতে পারে এবং হওয়া উচিত। এটা আমাদের আশার আলো দেখায়। বর্তমানে আমরা যে অবস্থায় আছি সে জায়গা থেকে কিভাবে অগ্রসর হবো সে বিষয়ে আমরা সবাই একমত। বর্তমানে এটা স্বাভাবিক অবস্থা না। এ অবস্থা থেকে বের হওয়ার স্বাভাবিক পথ বের করতে হবে। প্রকাশিত জরিপ সম্পর্কে ড. কামাল বলেন, দেশে যে গণতন্ত্র থাকার কথা সেটা কিভাবে আছে সেটা মূল্যায়ন করা হয়েছে। এটা নিয়ে উপস্থিত কোন রাজনৈতিক দলের নেতাই প্রতিবাদ করেননি। অনেক দায়িত্ববোধ থেকে মূল্যায়ন করার চিন্তা নিয়ে অস্বীকার করেননি। তারা সংলাপের কথা অস্বীকার করেননি। ড. কামাল বলেন, দুই জোটের বাইরেও ১৪ কোটি মানুষ দেশে আছে। আমরা ১৪ কোটি সাধারণ নাগরিক হিসেবে এটা আমাদের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে দেশের মৌলিক বিষয়ে ঐক্যমতে আছে। সবার ভোট হওয়া উচিত। কারও এ বিষয়ে দ্বিমত নেই। সবার একটা ভোট আছে। সেই ভোট দিয়ে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে প্রতিনিধি নির্বাচন করবে এ নিয়ে কারও দ্বিমত নেই। এ নির্বাচন পরিচালনা করবে নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন। তরুণদের রাজনীতিতে সুযোগ করে দেয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে সবাই গর্ব করি। সে বিশ্ববিদ্যালয় কি অবস্থায় আছে? আজকের ছাত্রদের প্রাপ্য পরিবেশ দিচ্ছি না। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় মূল্যবোধ তৈরি হচ্ছে না। দলের ভেতরে গণতন্ত্র নেই বলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসংসদগুলোয় নির্বাচন হয় না। ফলে ছাত্ররা অশুভ শক্তির নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে গড়ার জন্য এ ধরনের প্রতিষ্ঠানে নির্বাচন গুরুত্বপূর্ণ। জাতীয় ঐক্যের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করে তিনি বলেন, সবক্ষেত্রে ঐক্য হয় না। বহুদলীয় গণতন্ত্র হলে মতবিরোধ থাকবে। ভেদাভেদ থাকবে। সংবিধানের মৌলিক কথার ব্যাপারে ঐকমত্য থাকতে হবে। সংবিধানের মৌলিক কথার ব্যাপারে ঐক্য থাকতে হবে। জনগণ ক্ষমতার মালিক। রাষ্ট্রক্ষমতা প্রয়োগ করতে হলে যেভাবে সংবিধান বলে সেভাবে করতে হয়। অন্য কোনভাবে করা যায় না। সত্যিকারের নির্বাচিত প্রতিনিধি সংসদে ও অন্যান্য নির্বাচিত প্রতিষ্ঠান এ সব ব্যাপারে কোন বিতর্কের অবকাশ নেই। এই ঐক্যকে কেন্দ্র করে সংলাপে বসা যায়। জামায়াতকে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি পরিহার করে সংবিধানের মৌলিক বিষয়ে একমত হওয়ার আহ্বান জানিয়ে ড. কামাল বলেন, আমরা যদি বলি সব দল গণতন্ত্রের পক্ষে যারা আছেন। সেখানে যারা আসবেন সংবিধানের মৌলিক বিষয়গুলো মেনে আসতে হবে। সবাইকে অংশ নেয়ার সুযোগ দিতে হবে- যদি জামায়াত ধর্মনিরপেক্ষতা মেনে চলে আসে। কিন্তু তারা ’৭২ থেকে ’৭৫ এটা করেনি।
৫ই জানুয়ারির নির্বাচনের প্রেক্ষাপট উল্লেখ করে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য এডভোকেট ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন বলেন, আমরা তৎকালীন বিরোধী দলকে সংলাপের জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছি। সংবিধানের যে অবস্থান আছে একটা আপিল বিভাগের রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার চলে গেছে। সংবিধান সংশোধনের আগে আমরা আলোচনা করার আহ্বান জানিয়েছি। এমনকি সংসদে সমস্যা হলে বাইরে বসার আমন্ত্রণ জানিয়েছি। তারা আসেনি। সংলাপ চেয়েছি আমরা। আমরা চাই অর্থবহ সংলাপ। বিএনপিকে পূর্বশর্ত না দিয়ে সংলাপে আসার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, সবার অংশগ্রহণের মাধ্যমে নির্বাচন করা হবে। তারা আসেনি। কেউ আসতে নিষেধ করেনি। এখন যদি বাইরের দেশের ওহি নির্ভর করে নির্বাচনে না আসে তাহলে কিছু করার নেই। এমনকি তারা নির্বাচনকে প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়েছে। এ নির্বাচনের বিকল্প কিছু ছিল না। গণতন্ত্রের জন্য সংলাপ প্রয়োজন। জাতীয় ইস্যু নিয়ে আলোচনা হতে পারে। আমি যদি বলি ইস্যু একটাই। তাহলে পূর্বশর্ত দিয়ে সংলাপ হয় না। দেশকে এগিয়ে নেয়ার জন্য রাজনৈতিক সমঝোতার জন্য আলোচনা হতে পারে। পূর্বশর্ত দিয়ে আলোচনা এগোবে না।
ক্ষমতাসীন দলের আরেক উপদেষ্টা সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেন, অর্থনৈতিক উন্নয়ন আমরা যদি মেনে নেই তাহলে বলতে হয় সুশাসনের অভাব থাকলে অর্থনৈতিক উন্নয়ন কিভাবে হয়? সুশাসন আছে বলেই উন্নয়ন হয়েছে। এখন দরকার নতুন করে ভাবা, নতুন করে সংলাপ শুরু করা। ৫ই জানুয়ারিতে আরেকটা ওয়ান ইলেভেন হতে পারতো। আরেকটা বীভৎস হত্যাকা- হতে পারতো।
তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুকে যদি আমরা বলি রাজাকার এপর্যায়ে যদি আমাদের অবস্থান নেমে যায় তাহলে সংলাপের পরিবেশটা সৃষ্টি হবে কিভাবে? পরিবেশ সৃষ্টি করতে হলে আপনাকে বলতে হবে আমি মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা ও সংবিধান- মেনে আমাদের এগোতে হবে। তাহলে জামায়াত ত্যাগ করতে হবে। জামায়াতকে যুদ্ধাপরাধীদের ত্যাগ করতে হবে। নির্বাচন মানেই গণতন্ত্র ধরে রাখলে হবে না। দেশে স্বাধীন গণমাধ্যম ও বিচার বিভাগ আছে। সমাজের সর্বস্তরে কথা বলার সুযোগ আছে। বিএনপি পার্লামেন্টে সিদ্ধান্ত নিয়ে গেলে ভাল হতো। এবার যেতে পারে নাই। পরে যাবে। বিএনপি নেতাদের উদ্দেশে তিনি বলেন, বিরোধী দলের ভেতরে যদি বোধগম্য হয়, তারা যদি নতুনভাবে ভাবেন এবং তারা যদি জামায়াতসহ অন্যান্য রাষ্ট্রদ্রোহী শক্তি ও স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি পরিত্যাগ করে স্বাধীনতার ইতিহাসের প্রতি গণতান্ত্রিক উৎকর্ষ সাধনের বিষয়ে আলোচনা করতে চান অবশ্যই সরকার এ বিষয়ে বিবেচনা করবে।
আলোচনায় অংশ নিয়ে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও সাবেক মন্ত্রী আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, রিপোর্টটিতে যে বিষয়গুলো তুলে ধরা হয়েছে তার সবই ঠিক আছে। কিন্তু আমরা শুরু করবো কোথা থেকে। আমাদের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে হবে। নির্বাচিত সংসদ থাকতে হবে, সরকার থাকতে হবে। গণতন্ত্র ও সুশাসনের জন্য নির্বাচিত সরকার প্রয়োজন। এটাই অনুপস্থিত। দলীয়করণের বিষয়ে তিনি বলেন, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস পরিচালনা করার জন্য লোক দরকার। দলীয়করণ না থাকলে ক্ষমতায় টিকে থাকা যাবে না। আমি যদি জনগণের ভোটে নির্বাচিত না হই, আমি যদি রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের মাধ্যমে ক্ষমতায় যাই, আমাকে সেটা ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে হলে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস অব্যাহত রাখতে হবে। সর্বক্ষেত্রে আমার লোকজন না থাকলে এই ক্ষমতা ধরে রাখা সম্ভব হবে না। উন্মুক্ত আলোচনায় ড. আসিফ নজরুল বলেন, আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতরেই গণতন্ত্র নাই। দলের ভেতরের বিবেকবান মানুষেরা কথা বলতে পারেন না। জামায়াত ছাড়ার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, কার সঙ্গে কে জোট করবে সেটা রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর ছেড়ে দেয়া উচিত। গণতন্ত্র ছাড়া অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি দীর্ঘস্থায়ী হয় না, ধারাবাহিকতা থাকে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, আমাদের ভবিষ্যৎ কোন দিকে যাচ্ছে আমরা জানি না। আধুনিক রাষ্ট্রের জন্য আধুনিক রাজনৈতিক চর্চার প্রয়োজন। আমাদের রাজনৈতিক ভাষার ব্যবহারে সমস্যা রয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে গণতন্ত্রের অভাব প্রকট। পরিবারতন্ত্র থেকে রাজনৈতিক দলগুলো বের হয়ে আসতে পারছে না। অপশাসনে এখন লাভজনক ব্যবসা হয়ে গেছে। বিআইডিএসের গবেষণা পরিচালক ড. বিনায়ক সেন বলেন, আমাদের দেশের অর্থনীতি অদক্ষ চালকের ওপর ভর করে আছে। দেশে মধ্যবিত্তের সংখ্যা বাড়ছে। কিন্তু তারা সবসময় বিপদে থাকে না। তাদের পক্ষে সুশাসন দাবি করা মুশকিল। ফলে তারা সুশীল সমাজে ভূমিকা রাখতে পারছেন না। দেশের গণতন্ত্র পেছনের দিকে ধাবিত হচ্ছে। সুশীল সমাজের সঙ্গে রাজনীতিবিদদের দূরত্ব তৈরি হচ্ছে। তিনি বলেন, গণতন্ত্র, ক্ষমতা বদল ও সুশাসনের জন্য কংক্রিট আলোচনা প্রয়োজন। এজন্য সরকারের উচিত জায়গা তৈরি করা। বিএনপির উচিত জামায়াত ত্যাগ করা। আর জামায়াতের উচিত স্বাধীতাবিরোধীদের ত্যাগ করা। কারণ পলিটিক্যালি ইসলামের একটা ভবিষ্যৎ আছে। মানবজমিন