লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান ॥ রেলপথে পাচার হয় গাছ

Tree Smuglingইমন দেব চৌধুরী, মৌলভীবাজার: প্রাকৃতিক জীব বৈচিত্রে সমৃদ্ধ ১২৫০ হেক্টর আয়তনের মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল ও কমলগঞ্জ উপজেলার মধ্যবর্তী লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে চলছে বৃক্ষ নিধনের মহা উৎসব। প্রকাশ্য দিবালোকে দীর্ঘ দিন ধরেই এই বনের প্রাকৃতিক জীব বৈচিত্রের উপর চলছে তান্ডব! অভিযোগ রয়েছে গত ২০ দিনে কোটি টাকার গাছ পাচারের। জাতীয় উদ্যান সহ-ব্যবস্থাপনা কমিটির কতিপয় প্রভাবশালী সদস্যদের নিজস্ব লোক দিয়ে গঠিত পাহারাদার দলের সদস্যরা লাউয়াছড়া, কালাপুর ও চাউতলি বনবিট এলাকা থেকে গাছ পাচারে এখন ব্যস্ত সময় কাঠাচ্ছে। আর এতে হাত রয়েছে বন বিভাগের কিছু অসাধু কর্মকর্তা কর্মচারীর। প্রকাশ্য দিবালোকে মূল্যবান গাছ গছালি কেটে রেলপথে গাছচোরদের নিজস্ব ট্রলি ব্যবহার করে কাটা গাছ পাচার হচ্ছে। রেলপথে গাছ পাচারে নতুন করে ট্রেন চলাচলে ঝুঁকির আশঙ্কা বেড়ে গেছে। এসব দেখেও ক্ষুধ না দেখার ভ্যান করছে বন বিভাগ। সরেজমিন ঘুরে বনবাসীদের সাথে কথা বলে ও নির্ভরযোগ্য একাধিক সূত্রে গাছ পাচারের এ মহোৎসবের চিত্র পাওয়া যায়।
অনুসন্ধানে জানা যায়, জাতীয় উদ্যান সহ-ব্যবস্থাপনা কমিটির (সিএমসি) তত্ত্বাবধানে ৫৬ সদস্যের একটি বন পাহারাদর দল বনবিভাগের সাথে বন পাহারায় নিয়োজিত আছে। মাস খানেক পূর্বে ওই বন পাহারাদার দলে মহসিন, সুফি, ফজর, সোহেল ও করিম হোসেন নামের ৫ জনকে নিয়োগ দেয়া হয়। নতুন নিয়োগকৃত পাঁচজনের মাঝে করিম হোসেন ব্যতিত সবাই চিহ্নিত গাছচোরচক্রের সদস্য। তাদের বিরুদ্ধে একধিক বন মামলা রয়েছে বলে মৌলভীবাজার বন্যপ্রাণী রেঞ্জ সূত্রে জানা গেছে। এদের পাহারাদার দলের সদস্য হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর থেকে লাউয়াছড়ায় গাছচুরির ঘটনা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে গেছে।
অভিযোগ রয়েছে শক্তিশালী একটি গাছচোর চক্রের সাথে সখ্যতা রয়েছে জাতীয় উদ্যান সহ-ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্যসহ অনেকের। ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকা এই সদস্যদের রয়েছে সহ-ব্যবস্থাপনা কমিটির সাথে গভীর সম্পর্ক।
ইকো ট্যুর গাইডরা (পর্যটক নির্দেশক) গাছকাটাসহ বিভিন্ন অনিয়মের প্রতিবাদ করলে তাদের সিএমসি’( সহ-ব্যবস্থাপনা কমিটি)-র গাইড গ্রুপ থেকে অপসারণের হুমকি-ধামকি দেয়া হয়। ইকো ট্যুর গাইডরা জানান, ১৯২৫ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার কমলগঞ্জে বনায়নের সূচনা করেছিল। ১৯৯৬ সালে ১২৫০ হেক্টর বনাঞ্চলকে জাতীয় ঋদ্যান হিসেবে ঘোষানা করা হয়। লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে ৪৬০ প্রজাতির প্রাণ বৈচিত্রের ভেতরে ১৬৭ প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে। এসব উদ্ভিদের উপর নির্ভর করে বনাঞ্চরেল নানা জাতের জীব বৈচিত্র বেঁচে আছে। এখন যেভাবে গাছ উজাড় হচ্ছে তাকে এ বনের প্রাণীকূল রক্ষা করা দুরুহ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের ভেতর দিয়ে চলে যাওয়া রেলপথ দিয়ে গাছচোরচক্র নিজস্ব ট্রলি ব্যবহার করে কেটে নেওয়া গাছের খন্ডাংশ দাপটের সাথে পাচার করছে। পাচারকারী চক্রটি সব সময় সশস্ত্র থাকে বলে বনকর্মী বা কেউ তাদের প্রতিহত করতে সাহস পাচ্ছে না। রেলপথে নিজস্ব ট্রলি ব্যবহার করে চোরাই গাছ পাচার বেড়ে যাওয়ায় এ পথে এখন ট্রেন চলাচল নতুন করে ঝুঁকির মাঝে পড়েছে। এভাবে রলেপথে ট্রলি ব্যবহার করে গাছ পাচার হতে থাকলে যে কোন দিন আকস্মিকভাবে পাহাড়ি এলাকায় যে কোন ট্রেনের সাথে সংঘর্ষ হয়ে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে।
লাউয়াছড়া বনবিটের কয়েকটি স্থান ঘুরে দেখা যায় চোরদের কেটে নেওয়া বড় বড় অসংখ্য আওয়াল, সেগুন, আগর ও চাপালিশ কাঠের গাছের মোথা (নিচের অংশ) স্বাক্ষী হিসেবে পড়ে রয়েছে। পরবর্তীতে হামলার ভয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বনবাসী লোকজন জানান, আগে শুধু রাতে জাতীয় উদ্যান এলাকা থেকে মূল্যবান গাছ কেটে পাচার হলেও এখন প্রকাশ্য দিবালোকে গাছ কেটে পাচার হচ্ছে। বনবাসীরা জানান, গত ২০ দিনে এ পর্যন্ত লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান থেকে প্রায় তিন শতাধিক মূল্যবান গাছ কেটে পাচার করে সংবদ্ধ গাছচোরচক্র। কেটে নেওয়া তিন শতাধিক গাছের বাজার মূল্য কমপক্ষে কোটি টাকার উপরে হবে।‘আমরা প্রকৃতিকে বাঁচাবো আগামী প্রজন্মের জন্য’ Ñ এই স্লোগানকে নিয়ে বন বিভাগের সাথে এক হয়ে কাজ করছে ইউএসএআইডি’র আইপ্যাক-নিসর্গ প্রকল্পের (বর্তমানে ক্রেল প্রজেক্ট) সহ-ব্যবস্থাপনা কমিটি। জাতীয় উদ্যানের চারপাশের জনপদের অধিবাসীদের প্রতিনিধি ও সংশিষ্ট বন কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে গঠিত ২৯ সদস্য বিশিষ্ট সহ-ব্যবস্থাপনা কমিটি প্রতিমাসে একবার সভা করে সভার সিদ্ধান্তক্রমে বন ব্যবস্থাপনা ও বন সম্পর্কিত বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করে থাকে। বাস্তবে গাছ-গাছালি রক্ষায় কোন কাজ হচ্ছে না।
লাউয়াছড়া বনবিট কর্মকর্তা মাহমুদুর রহমান সম্প্রতি গাছচুরি বেড়ে যাবার কথা স্বীকার করে লোক বলের অভাবে তাদের সঠিকভাবে বিশাল এই বন রক্ষায় অসহায়ত্বের কথা বলেন। বিশাল এই বনে যেখানে কয়েকটি দলে বিভক্ত হয়ে এক সাথে দেড় থেকে দুই শত সশস্ত্র গাছচোর জাতীয় উদ্যানে প্রবেশ করে সেখানে মাত্র তিন থেকে চারজন বনকর্মী দিয়ে গাছ চোরদের প্রতিহত করা যায় না। গাছ চোরদের প্রতিহত করতে মাঝে মাঝে ফাঁকা গুলি ছোড়তে হয়। এভাবে শনিবার (১ নভেম্বর) রাতেও গাছচোরদের বাঁধা দিতে তিনি দু রাউন্ড গুলি করেছিলেন। তিনি আরো বলেন, গত বছর ২১ আগস্ট গাছচোররা (আমাকেও) কুপিয়ে আহত করেছিল।’
লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান সহ-ব্যবস্থাপনা কমিটির (সিএমসি) সভাপতি ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, ‘সাম্প্রতিক গাছ চুরির ঘটনাগুলো আমার জানা ছিল না। সংশ্লিদের সাথে কথা বলে প্রওয়াজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।
ক্রেল কর্মকর্তা আশরাফুল ইসলাম বলেন, ‘সিপিজি সদস্যদের প্রথমে কিছুদিন পর্যবেক্ষণে রাখা হয়। অপরাধের সাথে সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেলে সিএমসি মাসিক সভার সিদ্ধান্তক্রমে তাদের বাদ দেয়া হয়। যাদের বাদ দেয়া হয় তারাই প্রতিহিংসার সূত্র ধরে পুনরায় গাছকাটতে আসে।’
লাউয়াছড়া বনরেঞ্জ কর্মকর্তা (বন্যপ্রাণী) মরতুজ আলী জাতীয় উদ্যানে গাছ চুরির সত্যতা নিশ্চিত করলেও এর পরিমাণ কম বলে তিনি দাবী করেন। এ অবস্থা থেকে বনরক্ষায় সামাজিক ও রাজনৈতিক সচেতনতা ও অঙ্গিকার প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন।