‘অনিতা নাটকে’ থেমে গেছে উদ্ধার তৎপরতা

Anita---joyee-insetহাবিবুর রহমান তাফাদারঃ নগরীর শেখঘাট ভাঙাটিকর এলাকা থেকে চার বছরের কন্যাশিশু স্নিগ্ধা দেব জয়ী অপহরণের ১৭ মাস হতে চললেও শিশুটিকে উদ্ধারে ব্যর্থ হচ্ছে আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী। অভিযোগ উঠেছে অপহরণ মামলাটি ভিন্নখাতে প্রভাবিত করার। উদ্ধার তৎপরতায়ও কৌশলে বাঁধা সৃষ্টির অভিযোগ করেছেন নিখোঁজ জয়ীর মা-বাবা। তাদের দাবি গ্রেফতারকৃত অনিতাকে যথাযথভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা গেলেই জয়ীকে উদ্ধার করা সম্ভব। অনিতাকে যাতে সঠিকভাবে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করতে না পারে সেজন্য একটি চক্র সংদ্ধভাবে রিমান্ডে নির্যাতন নাটক সাঁজায়। আর এই নাটকে কৌশলে পাড় পেয়ে যায় অপহরণকারী চক্রের মুলহোতা এই নারী। জানা যায়, মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গলের সাতগাঁও আলীশারকুলের সিএনজি অটোরিকশা চালক কিশোর ভট্টাচার্যের স্ত্রী ও নর্থ ইস্ট মেডিকেল কলেজের নার্স পরিচয়দানকারী অনিতা ভট্টাচার্য। তবে নর্থইষ্ট মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, সাত বছর ধরে অনিতা নর্থইষ্ট মেডিকেলের চক্ষু বিভাগে নার্সের সহকারি হিসেবে কর্মরত। পিতা সিলেট নগরীর শেখঘাট ভাঙ্গাটিকর এলাকার গোপীনাথ আখড়ার সেবায়েত রামেন্দ্র ভট্টাচার্য। সম্প্রতি সিলেট নগরীতে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু এই অনিতা। অভিযোগ সিলেট নগরী থেকে অপহৃত কন্যা শিশু স্নিগ্ধা দেব জয়ীর অপহরণ মামলায় গ্রেফতারকৃত অনিতাকে থানা হাজতে নির্মম নির্যাতন।
২০১৩ সালের ২১ জুলাই সিলেট নগরীর শেখঘাট ভাঙাটিকর এলাকা থেকে নিখোঁজ হয় চার বছরের কন্যাশিশু স্নিগ্ধা দেব জয়ী। সিলেট জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে রাজস্ব শাখায় অফিস সহকারী শর্বানী দেব তুলি ও তাজপুরের রাজচন্দ্র সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক সন্তোস কুমার দেব’র একমাত্র মেয়ে জয়ী। পরিবারের অন্যান্য সদস্যকে নিয়ে ১২ জুলাই সন্তোষ কুমার দেবের মামাতো বোন জয়া দামের বিয়ে উপলক্ষে শেখঘাট ভাঙাটিকর এলাকায় মামার বাড়িতে আসেন তিনি। সে বাসা থেকেই ২১ জুলাই হারিয়ে যায় চার বছরের কন্যাশিশু জয়ী। সেই থেকে আর কোন খোঁজ মেলেনি ছোট্ট জয়ীর। জয়ীকে হারিয়ে পাগলপ্রায় মা শর্বানী দেব তুলি। তখন সিলেট কোতোয়ালী মডেল থানায় জিডি করেন জয়ী’র পিতা সন্তোস কুমার দেব। জিডিকে সামনে রেখে তদন্তে অগ্রসর হয় সিলেট কোতোয়ালী থানা পুলিশ। পাশাপাশি দৌড়ঝাপ চালিয়ে যান শোকে বাকরুদ্ধ মা শর্বানী দেব তুলি। পুলিশের পরামর্শে অজ্ঞাতনামা আসামিদের উপর মামলাও করেন নিখোঁজ জয়ী’র শোকাহত পিতা সন্তোস কুমার দেব। দীর্ঘদিন পর মামলাটির তদন্তভার পড়ে লামাবাজার ফাড়ির ইনচার্জ এসআই সিরাজুল ইসলামের উপর। এসআই সিরাজ মামলাটির দীর্ঘ তদন্ত শেষে গত ২৪ আগস্ট সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার সোলেমানপুর গ্রামের আমির উদ্দিনের ছেলে মো. রবিউলকে গ্রেফতার করেন। রবিউল শেখঘাট সংলগ্ন কাজিরবাজার এলাকার মাছ বিক্রেতা। তার স্বীকারোক্তিমুলক (ফৌঃ কাঃ দঃ ১৬৪) জবানবন্দিতে পরদিন পুলিশ গ্রেফতার করে শেখঘাট ভাঙ্গাটিকর এলাকার বিনোদবিহারী দামের ছেলে শঙ্কর দামকে।
রবিউল ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে যে জবানবন্দি দিয়েছে তাতে অপহরণের মূল হোতা হিসেবে শঙ্কর দামের নামই উঠে এসেছে। শেখঘাট সংলগ্ন কাজিরবাজার এলাকার মাছ বিক্রেতা রবিউল জবানবন্দিতে বলেন, ঘটনার দিন শঙ্করের কোলে ‘তুলির বাচ্চা’কে দেখে সন্দেহ হলে তিনি পিছু নেন। শঙ্কর শিশুটিকে নিয়ে ওঠেন খেয়া নৌকায়। রবিউলও ওঠেন সে নৌকায়। নৌকাযোগে সুরমা নদী পেরোনোর পর শঙ্কর শিশুটিকে তুলে দেন নর্থ ইস্ট মেডিকেল কলেজের নার্স শেখঘাটেরই মেয়ে অনিতা ভট্টাচার্যের হাতে। তখনই শঙ্করের চোখে পড়ে রবিউলকে। ভয়ে চমকে ওঠেন শঙ্কর। ২০০০ টাকা গুঁজে দেন রবিউলের হাতে। বলেন, এ ঘটনাটি যেন সে কাউকে না বলে। রবিউল ফিরে আসেন শেখঘাটের বাড়িতে। পরদিন আবার শঙ্করের সঙ্গে দেখা হয় তার। শঙ্কর আরও ৫ হাজার টাকা দেন রবিউলকে। আবারও অনুরোধ করেন বিষয়টি যেন কেউ না জানে। নিখোঁজ বিষয়টি সম্পূর্ণ জানলেও তা চেপে যান রবিউল। ‘সমব্যথী’ হয়ে কাছে ভিড়েন জয়ী’র পরিবারের। জয়ী’র সন্ধানে মাইকিং, পোস্টারিংয়ের দায়িত্বও নেন রবিউল। আবার সবার অজান্তে সে বার্তা পৌঁছেও দেন শঙ্করের কাছে। শংকরকে গ্রেফতারের পর পুলিশের কাছে ঘটনার সাথে সম্পৃক্ততার কথা স্বীকার করলেও রবিউলের ১৬৪ ধারায় জবানবন্দী থাকা সত্বেও সামনে দূর্গা পুজা এই অজুহাতে আদালত থেকে জামিন পেয়ে যায় শংকর। তবে আরেকটি হত্যা মামলায় শংকর এখনও কারাবন্দী।
রবিউল, শংকরের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য ও কল লিস্টের সূত্র ধরে পুলিশ নিশ্চিত হয় অপহরণকান্ডে সংশ্লিষ্টতা রয়েছে অনিতা ভট্টাচার্যেরও। কল লিস্ট পর্যালোচনায় দেখা গেছে ঘটনার দিন অনিতা ও শঙ্করের মধ্যে ৪২ বার মোবাইলে কথোপকথন হয়েছে। রবিউল ও শঙ্কর ধরা পড়ার পর থেকেই আত্মগোপনে চলে যান অনিতা ভট্টাচার্য। অনেক সন্ধানের পর ৮ নভেম্বর ভোরে শ্রীমঙ্গলের সীমান্তবর্তী আমরইল রাবার বাগান এলাকা থেকে পুলিশ আটক করে অনিতাকে। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পরদিন আদালতের মাধ্যমে পুলিশি রিমান্ডে নেয়া হয় অনিতাকে।
অভিযোগ ওঠে রিমান্ডে নিয়ে কথা আদায় করতে না পেরে পুলিশ নির্মম নির্যাতন করে তার ওপর। অনিতার স্বামী কিশোর ভট্টাচার্য অভিযোগ করেন, কোতোয়ালি থানার ওসি (তদন্ত) মনিরুল ইসলাম ও এসআই হাসিনা আক্তার আঁখি মিলে শারীরিক নির্যাতন করেন তার স্ত্রীকে।
সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনারের কাছে দেয়া লিখিত অভিযোগে তিনি বলেন, ওসি মনিরুল প্রথমে অনিতার গলার ভেতর নল দিয়ে মদ ঢুকিয়ে দেন এবং বুট দিয়ে গলায় চেপে ধরে বলেন, স্বীকারোক্তি না দিলে তাকে ধর্ষণ করা হবে। স্বীকারোক্তি আদায় করতে এসআই আঁখি অনিতার শরীরের গোপন অংশে লাঠি ঢুকিয়ে নির্যাতন করেন। এ অভিযোগের প্রেক্ষিতে ক্লোজড করা হয় ওসি মনিরুল ও এসআই আঁখিকে। স্থানীয়, জাতীয় ও অনলাইন পত্রিকাগুলো ফলাও করে সংবাদ প্রকাশ করে, ‘‘থানা হাজতে নির্মম নির্যাতন” শিরনামে। কিন্তু এই ঘটনার আড়ালে ছিল এক বিস্তৃত ষড়যন্ত্রের জাল তা সুরমা টাইমস’র তদন্তে বেরিয়ে আসে। উদ্দেশ্য ছিল পুলিশ কমিশনারের কাছে দেয়া অভিযোগের ভিত্তিতে ‘সিন্ডিকেট’ সংবাদ পত্রিকায় পরিবেশন করা। অতঃপর এই সংবাদপত্রগুলোকে পুজি করে উচ্চ আদালতকে প্রভাবিত করে জয়ী উদ্ধারকাজ বিঘিœত করা। ইতোমধ্যে এই কাজে সফলও হয়েছে তারা। থমকে গেছে নিখোঁজ শিশুকন্যা জয়ী উদ্ধারের যাবতীয় কার্যক্রম। সুকৌশলে থানা হাজতে নির্যাতনের ঘটনাকে ফলাও করে প্রচার করে তার আড়ালে হিমায়িত করে ফেলেছে মূল মামলার কার্যক্রম। যদিও আসামী অনিতার পাকস্থলিতে অ্যালকোহল থাকার কোন ডাক্তারি সার্টিফিকেট, ভ্যাজাইনাল ইনজুরির কোন ডাক্তারি সার্টিফিকেট কিংবা চাক্ষুষ কোন স্বাক্ষী পাওয়া যায় নাই তবুও বিষয়টি নিয়ে মাত্রারিক্ত প্রচার প্রপাগান্ডায় ভিকটিমাইজড করা হয়েছে আইন ও শালিশকেন্দ্র নামক প্রতিষ্ঠানটিকেও। অনিতাকে থানা হাজতে নির্যাতনের সংবাদ যে কয়টি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে সবকটিতেই আক্ষরিক মিল খুজে পাওয়া গেছে। সংবাদটি স্থানীয় ও জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশনার লিজগ্রহীতার নামও জানা গেছে।
অনিতার স্বামী কিশোর ভট্টাচার্যের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তার মোবাইল বন্ধ পাওয়া যায়। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অনিতার এক নিকটআত্মীয়ের কাছ থেকে পাওয়া গেছে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। রাজনৈতিক বলয় থেকে প্রশাসনেও রয়েছে তার যথেষ্ট প্রভাব।
অনিতাকে রিমান্ডে নেয়া থেকে শুরু করে হাসপাতালে কিংবা আদালতে তার ব্যাপক তৎপরতা দেখা গেছে। তাকে প্রশ্ন করা হল অনিতাকে পাইপ দিয়ে কিংবা যেভাবেই মদ খাওয়ানো হোক, তার মেডিকেল রিপোর্ট, ভেজাইনাল ইনফেকশন কিংবা অভ্যন্তরীন আঘাতের কোন মেডিকেল রিপোর্ট আছে কি? অনীতাকে কি কোন গাইনি চিকিৎসা দেয়া হয়েছিল? কারা অভ্যন্তরে হাসপাতাল থাকা স্বত্তেও সে সাভাবিক মহিলা ওয়ার্ডে রাখা হয় কেন? তাহলেকি সবই ‘ভনিতা’ ? তার কোন সদুত্তর দিতে পারেননি তিনি। এসব প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানান তাৎক্ষনিক ভাবে তিনি এসব পরীক্ষা করানোর কথা ভাবেন নাই। পুলিশের বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন ধরনের নির্যাতনের লিখিত অভিযোগ পড়ে।
প্রশাসন অভিযোগের তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা গ্রহন করে। অনিতার বেলায় অভিযগের দুই ঘন্টার মধ্যেই দুই পুলিশ অফিসারকে ক্লোজ করা হল, এখানে কোন ধরনের প্রভাব বিস্তার করা হয়েছিল নাকি? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন কোন ধরনের প্রভাব বিস্তার করা হয়নি। অভিযগে মামলার মূল তদন্তকারী অফিসারকে অভিযুক্ত না করে উর্ধতন অফিসারদেরকে অভিযুক্ত করা হল কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান তদন্তকারী কর্মকর্তা সিরাজুল ইসলাম কোন নির্যাতন করেননি। তবে তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই সিরাজুল ইসলাম আদালতের কাছে তার লিখিত জবানবন্দীতে বলেছিলেন, আসামী রবিউল ১৬৪ ধারায় এবং শংকর তার কাছে অপহরনকান্ডের সাথে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছেন।
এ ব্যাপারে এসআই সিরাজুল ইসলাম জানান, শিশুকন্যা জয়ী অপহরনের সাথে অনিতা ও শংকর জড়িত এটা ইতোমধ্যেই প্রমানিত হয়েছে। পুলিশের কাছে রবিউল, অনিতা ও শংকরের জাবানবন্দী রেকর্ড আছে। অনিতা আন্তর্জাতিক নারী ও শিশু পাচারকারী দলের সাথে জড়িত কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অনিতাকে ভারতের সীমান্ত এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে। সে সময় সেখানে অনেক ভারতীয় নাগরিক দেখে তিনি প্রশ্ন করেছিলেন এরা কারা? জবাবে অনিতা বলেছিলেন এরা তার শ্বশুরের মুরিদান। তিনি জানান তখনই তার মনে এমন সন্দেহ হয়েছিল। তবে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আদালত মামলার চার্জসিট দেয়ার সময় সীমা বেধে দেয়ার কারনে আমরা শিশু জয়ী উদ্ধারকার্য সম্পাদন না করেই আদালতে মামলার চার্জসিট দিতে বাধ্য হচ্ছি। তিনি জানান মামলার জয়ী উদ্ধারকাজে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা নতুন করে নিয়োগ করে আদালত থেকে সময় বাড়ানো যেতে পারে। অন্যতায় মামলাটি র‌্যাব, ডিবি অথবা সিআইডি’র কাছে হস্তান্তর না করলে ভিকটিম উদ্ধার না করেই নির্দিষ্ট তারিখের মধ্যে অবশ্যই আদালতে চার্জশিট জমা দিতে হবে। এক্ষেত্রে ভিকটিম উদ্ধারের কোন সম্ভাবনাই থাকবে না।
ইতোমধ্যে নিখোঁজ কন্যাশিশু জয়ী’র মা শর্বানী দেব তুলির মোবাইলে এসেছে বিভিন্ন ধরনের হুমকি এবং মামলা তুলে নেয়ার জন্য ক্রমাগত চাপ। এমনকি জয়ীকে হত্যা করা হবে বলেও হুমকি এসেছে। এসব বিষয়ে শর্বানী দেবী অনেকগুলো জিডিও করেছেন।