শুরু হলো বিজয়ের মাস
সুরমা টাইমস ডেস্কঃ আজ থেকে শুরু হলো বিজয়ের মাস। দীর্ঘ নয় মাসের সংগ্রাম শেষে এ মাসেই বাঙালি জাতি পেয়েছিল তাদের কাঙ্খিত বিজয়। ত্রিশ লাখ শহীদ আর দু’লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমহানির মাধ্যমে অর্জিত হয়েছিল একটি স্বাধীন পতাকা। বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনা আর ভাবগাম্ভীর্যের মধ্য দিয়ে এবারের বিজয়ের মাসটি পালন করা হবে।
বাংলাদেশের সুদীর্ঘ রাজনৈতিক ইতিহাসে শ্রেষ্ঠতম ঘটনা হলো ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ। মহান স্বাধীনতার নায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামের এক ঐতিহাসিক ঘটনার মধ্য দিয়ে বাঙ্গালি জাতির কয়েক হাজার বছরের সামাজিক রাজনৈতিক স্বপ্নসাধ পূরণ হয় এ মাসে।
বাঙালি জাতির সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন মুক্তিযুদ্ধের অবিস্মরণীয় গৌরবদীপ্ত চুড়ান্ত বিজয় এ মাসের ১৬ ডিসেম্বর অর্জিত হয়। স্বাধীন জাতি হিসেবে সমগ্র বিশ্বে আত্মপরিচয় লাভ করে বাঙালিরা। অর্জন করে নিজস্ব ভূ-খন্ড। আর সবুজের বুকে লাল সূর্য খচিত নিজস্ব জাতীয় পতাকা। ভাষার ভিত্তিতে যে জাতীয়তাবাদ গড়ে উঠেছিল, এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে ঘোষিত স্বাধীনতা পূর্ণতা পায় এ দিনে।
বাঙালির হাজার বছরের স্বপ্নপূরণ হবার পাশাপাশি বহু তরতাজা প্রাণ বিসর্জন আর মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে এই অর্জন হওয়ায় বেদনাবিঁধূর এক শোকগাঁথার মাসও এই ডিসেম্বর।
এ মাসেই স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকার-আলবদর আল-শামসদের সহযোগিতায় দেশের মেধা, শ্রেষ্ঠ সন্তান-বুদ্ধিজীবী হত্যার নৃশংস হত্যাযজ্ঞে মেতে ওঠে। সমগ্র জাতিকে মেধাহীন করে দেওয়ার এ ধরণের ঘৃণ্য হত্যাযজ্ঞের দ্বিতীয় কোন নজির বিশ্বে নেই।
১৯৭১ সালের নভেম্বর পর্যন্ত সারাদেশে বিভিন্ন জেলায় গেরিলারা আক্রমণ শুরু করলেও ডিসেম্বর মাসের শুরু থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা আক্রমণ আর ভারতীয় মিত্রবাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত যৌথবাহিনীর জল, স্থল আর আকাশপথে সাঁড়াশি আক্রমণের মুখে বর্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর পরাজয়ের খবর চারদিক থেকে ভেসে আসতে থাকে।
এ বছরের ১৬ ডিসেম্বর ঢাকার ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। যেখান থেকে ৭ মার্চ স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম,’ বলে স্বাধীনতার ডাক দেন, সেখানেই পরাজয়ের দলিলে স্বাক্ষর করেন পাক জেনারেল নিয়াজী। ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয়। আর জাতি অর্জন করে হাজার বছরের স্বপ্নের স্বাধীনতা।
৭১ এর ২৫ মার্চ কালো রাতে পাকিস্তানী জল্লাদ বাহিনী নিরস্ত্র জনগণের উপর অতর্কিত সশস্ত্র আক্রমণ চালিয়ে হাজার হাজার মানুষ হত্যা করে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর এক অসম যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়। বঙ্গবন্ধু একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতে পাক বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হবার আগে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন এবং তার ডাকে সাড়া দিয়ে বাঙালি জাতি ঐক্যবদ্ধভাবে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
২৫ মার্চ রাতেই রাজারবাগ পুলিশ লাইনে সশস্ত্র প্রতিরোধের সম্মুখীন হয় পাক হানাদার বাহিনী। এর আগে গাজীপুরে ১৯ মার্চ বাঙালি পুলিশ ও ইপিআর সদস্যরা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অবস্থান নিয়ে পাকিস্তানী বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধযুদ্ধে লিপ্ত হন।
দীর্ঘ ৯ মাসের সশস্ত্র জনযুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদ এবং দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমহানির মধ্য দিয়ে ১৬ ডিসেম্বর জাতির চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয়।
তবে ৭১ এর ঘাতক-দালাল, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্ন করে তাদের শাস্তির রায় কার্যকর করা গেলেই মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতা পূর্ণতা লাভ করবে বলেই মুক্তিযোদ্ধা, সুশীল সমাজসহ সর্বস্তরের মানুষের অভিমত।
যদিও এর মধ্যেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হয়ে গেছে এবং অনেকের বিচারের রায় প্রকাশ এবং কার্যকরও হয়েছে। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিও দিন দিন বাড়ছে। আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, বৈদেশিক বাণিজ্য, শিল্পায়ন, বিদেশি বিনিয়োগ এবং আন্তর্জাতিক কুটনৈতিক ক্ষেত্রে সাম্প্রতিককালের বাংলাদেশ এখন একটি মর্যাদাশীল জাতি হিসেবেই সমগ্র বিশ্বে অধিষ্ঠিত।
মহান এ বিজয়ের মাস উদযাপনে জাতীয় কর্মসূচির পাশাপাশি বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও পেশাজীবী সংগঠনের পক্ষ থেকে বিস্তারিত কর্মসূচি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
বিজয়ের মাসের প্রথম দিনেই বিভিন্ন সংগঠন বিস্তারিত কর্মসূচি পালন করবে। সম্মিলিত আওয়ামী সমর্থক গোষ্ঠী বিজয়ের মাসকে স্বাগত জানিয়ে বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে সমাবেশ মানববন্ধন, মোমবাতি প্রজ্জ্বলন ও জাতীয় পতাকা উত্তোলনের কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।
বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সোমবার দুপুরে শাহবাগ চত্বরে আলোচনা সভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র প্রদর্শনের আয়োজন করেছে। ন্যাশনাল এফ এফ ফাউন্ডেশন বিজয়ের মাসের প্রথম দিন মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে জাতীয় প্রেসক্লাব থেকে শিখা চিরন্তন পর্যন্ত বিজয় র্যালি বের করবে।
মুক্তিযোদ্ধাদের দাবি বাস্তবায়ন ও মুক্তিযোদ্ধা দিবস উদযাপন জাতীয় কমিটি সকাল সাড়ে ৭টায় মিরপুর মুক্তিযোদ্ধা কবরস্থানে শ্রদ্ধা নিবেদন এবং সকাল সাড়ে ৯টায় শাহবাগ প্রজন্ম চত্বর থেকে শিখা চিরন্তন অভিমুখে বিজয় শোভাযাত্রা কর্মসূচি পালন করবে। বঙ্গবন্ধু পরিষদ সকালে রিপোর্টার্স ইউনিটি মিলনায়তনে আলোচনা সভার আয়োজন করেছে।
মুক্তিযোদ্ধাদের দাবি বাস্তবায়ন ও মুক্তিযোদ্ধা দিবস উদযাপন কমিটি বিজয়ের মাস উদযাপনের অংশ হিসেবে আগামীকাল ১ ডিসেম্বরকে মুক্তিযোদ্ধা দিবস হিসেবে পালনের আহ্বান জানিয়েছেন।