মিডিয়া জগতে ছবি ব্যবহার

dog bites policeমুহাম্মদ আবদুল কাদির: শত বছরের একজন বৃদ্ধা। পরণে ছেড়া কাপড়। বার্ধক্য, অনাহারে আর অর্ধাহারে শরীরটা একেবারে ক্ষীণকায় হয়ে গেছে। ইচ্ছে করলে হাঢ়গুলো গণনা করা যাবে। জীবন-বাতি নিভে যাওয়ার উপক্রম। পেটের ক্ষিধা সহ্য করতে না পেরে শহরের ফুটপাত থেকে হোটেলের ভাসি খাবার তোলে মুখে দিচ্ছে। পাশে দু’টি কুকুর! বৃদ্ধার খাবার নিয়ে টানাহেচড়া করছে! ছবিটি ছাপা হল একটি পত্রিকায়। ছবির নিচে লেখা ছিল ‘ছবি কথা বলে’।
ছবি আবার কীভাবে কথা বলে! হ্যাঁ বলে। এমন ছবি যারা দেখেন তারাই বলতে পারবেন ছবি কিভাবে কথা বলে! তবে ছবির ভাষা আমাদের মতো নয়। তার মুখ আমাদের মতো নয়। তার কথা আমাদের মতো নয়। তার কথা নীরব। তার ভাষা মর্মষ্পশী; হৃদয় বিদারক। ছবি মানুষের অন্তরে নির্মমভাবে রেখাপাত করে। মনের অন্তঃস্থলে নিদারুণ দাগ কাটে। ছবি ইতিহাসকে জীবন্ত করে রাখে। কালের সাক্ষী হয়ে থাকে বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ।
ভারতবর্ষের মিডিয়াজগতে ছবির ব্যবহার শুরু হয় ১৯৩০ সাল থেকে। বাংলাদেশের মিডিয়ায় ছবি আসে পঞ্চাশের দশক থেকে। তখন কাঠের বাক্সে ছবি আঁকা হত। বিশেষ কোনো ব্যক্তি বা ঘটনার ছবি আঁকতে কয়েকদিন সময় লেগে যেত। ছাপা হত কয়েক সপ্তাহ পর। আজকের মতো আধুনিক প্রযুক্তি ছিল না। কেবি-এমবি-গিগাবাইটের পরিমাপ ছিল না। আনলিমিটেড এক্সপোজের ব্যবস্থা ছিল না। ওয়াইড, টেলি, জুম লেন্স ব্যবহারের কোনো সুযোগ ছিল না। রঙিন ছবির কল্পনাই ছিল না। কালের বিবর্তনে মানুষ এনালগ প্রযুক্তিকে পেছনে ফেলে আসে। ১৯৯৫ সাল থেকে শুরু হয় রঙিন ছবির ব্যবহার।
প্রযুক্তির উৎকর্ষতায় ছবির ব্যবহার ক্রমেই সহজ হয়ে আসছে। ব্যবহারের ক্ষেত্র ও চাহিদা দিনদিন সম্পসারিত হচ্ছে। বিশেষ করে মিডিয়াজগতে। প্রিন্ট মিডিয়া আর ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া যাই বলুনÑসবখানেই ছবির চাহিদা অপরিসীম। ছবি ছাড়া যেন একটি নিউজের পূর্ণতাই আসে না। আর তা-ই সত্য। একটি দীর্ঘ প্রতিবেদন কিংবা প্রবন্ধ-নিবন্ধ যা বুঝাতে পারে না, সামান্য একটি ছবি কিংবা কার্টুন তা অনায়াসে বুঝাতে পারে। মাও সে তুংয়ের মতেÑ ‘একটি ছবি দশ হাজার শব্দের চেয়েও বেশি শক্তিশালী।’ তাতে একদিকে যেমন সময় বাঁচে, অপরদিকে সাক্ষর-নিরক্ষর সবাই বুঝতে পারে। এই সত্যকে অস্বীকার করার উপায় নেই।
তবে জীবজন্তুর ছবি ব্যবহারের ক্ষেত্রে ধর্মীয় কিছু বিধি-নিষেধ আছে। সেগুলো অবশ্যই আমাদেরকে মেনে চলতে হবে। ইসলামের পূর্ব যুগে মানুষ মূর্তি পূজা করত। জীবজন্তুর ছবি নির্মাণ করত। তারা এগুলোর সম্মান করত। মূর্তিকেই তাদের উপাস্য মনে করত। তাদের কাছেই ভালো-মন্দ প্রার্থনা করত। এমনকি তারা আল্লাহকেই ভুলেই গিয়েছিল।
ইসলাম এসে তাদের এই কর্মকা-ে বিধি-নিষেধ জারি করে। আলাহর রাসুল ঘোষণা করেন, আজ থেকে আর কেউ মূর্তি পূজা করতে পারবে না; জীবজন্তুর ছবি নির্মাণ করতে পারবে না। এগুলোকে সম্মান দেখাতে পারবে না। কোনো মূর্তিকে উপাস্য মনে করতে পারবে না। তাদের কাছে ভালো-মন্দের কোনো প্রার্থনা করতে পারবে না। আমাদের উপাস্য একমাত্র আলাহ। ভালো-মন্দের মালিক একমাত্র আলাহ। তিনিই পূজা-আর্চনা ও উপাসনার উপযোগ্য। একমাত্র উপযুক্ত।
রাসুলের এই ঘোষণার পর থেকে মানুষের টনক নড়ে গেল। বিবেকের দরজা খুলে গেল। সম্বিৎ ফিরে এল। তারা ভাবলÑ হ্যাঁ, সত্যিই তো, আমরা একি করছি! আমাদের উপাস্য তো একমাত্র আলাহ। তিনিই তো পূজা-আর্চনা ও উপাসনার একমাত্র উপযুক্ত। মূর্তি-ভাস্কর জীবজন্তুর আকৃতি ওসব তো শুধুই ছবি। ওদের তো কোনো জ্ঞান-বুদ্ধি নেই; কোনো ক্ষমতা নেই; কোনো অনুভূতি নেই। তারা তো নিজেরই কোনো উপকার করতে পারে না। নিজের গায়ে একটি মাছি বসলে সেটিও তাড়াতে পারে না। আমরা তো মূর্খতার তিমির আঁধারে আচ্ছন্ন ছিলাম। অজ্ঞতার মহাসমুদ্রে নিমজ্জিত ছিলাম। রাসুল এসে আমাদের বিবেকের দরজায় করাঘাত করলেন। ঘুমন্ত হৃদয়কে জাগ্রত করলেন। ধন্যবাদ সেই মহামানবকে…।
এভাবে মানুষের বিবেকের কপাট খুলে যায়। সত্য উপলব্ধি করতে থাকে। ধীরে ধীরে ছবির প্রতি সনাতন ধারণা পাল্টে যায়। রাসুল যে ‘কারণে’ ছবির ওপর বিধি-নিষেধ আরোপ করেছেন এখন আর সেই ‘কারণ’ বিদ্যমান নেই। এখন আর কেউ ছবির পূজা করে না। ছবিকে নিজের ভাগ্যনির্মাতা বলে দাবি করে না। ছবির কাছে কিছু প্রার্থনা করে না। আমাদের আশেপাশে দেখা যায় অনেক ছবি। পত্রিকার পাতায় পাতায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে অসংখ্য ছবি। চারিদিকে ছবি আর ছবি। কেউ তো এগুলোকে সীমাহীন শ্রদ্ধা করে না। সম্মানের চোখে দেখে না। এমনকি পায়ের নিচে অনেক ছবি পড়ে থাকে। কেউ এগুলো কুড়িয়ে নেয় না। ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করে রাখে না। এতেই বুঝা যায় ছবির প্রতি মানুষের সনাতন সেই ধারণা আর নেই।
ছবির প্রতি মানুষের ধারণা পাল্টেছে; কিন্তু চাহিদা বেড়েছে। প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। ছবির সাথে অনেক জ্ঞান-বিজ্ঞানেরও সম্পর্ক আছে। ছবির মাধ্যমে শিক্ষাদীক্ষার অনেক ব্যাপার সহজ হয়ে যায়। জটিল বিষয় অনায়াসে বুঝা যায়। বিশেষ করে সাংবাদিকতা ও মিডিয়াজগত ছবি ছাড়া অস¤পূর্ণই থেকে যায়। ছবিহীন পত্রিকা যেন প্রমাণহীন কথা হয়ে দাঁড়ায়। মানুষ সেগুলো পড়তেই চায় না। আর ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া তো ছবি-ভিডিও ছাড়া কল্পনাই করা যায় না।
ছবি হারাম হওয়ার অজুহাত দেখিয়ে ওলামায়ে কেরাম আজ মিডিয়াজগত থেকে একশ’ হাত দূরে! আর এই সুযোগ লুফে নিচ্ছে ইসলাম বিরোধীরা। রীতিমতো ছবির অপব্যবহার করছে ওরা। আমাদের ঈমান-আকিদা হরণ করছে অতি সন্তর্পণে। বিশ্বজোড়ে আজ নোংরা ছবির জয়জয়কার। উলঙ্গপনা আর বেহায়াপনার ছড়াছড়ি। বিশ্বমুসলিম আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। কিন্তু আমাদের অবস্থান নিরাপদ (!) দূরত্বে। অথচ এ ব্যাপারেও শরিয়তের বিধান আছে। সুষ্ঠু-সুন্দর সামাধান আছে। সচেতন উলামায়ে কেরাম সে ব্যাপারটি অনেক আগে থেকেই আঁচ করতে পেরেছেন। অনেকের কাছে বিষয়টি এখনো পরিষ্কার হচ্ছে না।
আল্লামা শায়খ রাফি ওসমানি, বিচারপতি মুফতি তাকি ওসমানিসহ অন্যান্য আলেম এব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। অবশেষে তারা প্রমাণ করেছেন যে, আমাদের মিডিয়াজগতে যেসব ছবি ব্যবহার হয় সেগুলো শরিয়তের নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়ে না। বরং সেগুলোকে ‘তাসবির’ই বলা যায় না। আর ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় যেসব ভিডিও ব্যবহার করা হয় তাতে হারাম হওয়ার কোনো কারণ বিদ্যমান নেই। প্রয়োজনের তাগিতে সেগুলোর ব্যবহার আবশ্যকই বলতে হবে।
আলামা নুরুল ইসলাম ওলিপুরি সুন্দরই বলেছেনÑ ‘‘ইসলামি শরিয়তের বিধানে সাধারণ অবস্থায় জীবজন্তুর ছবি হারাম বলে উলেখ থাকায় যারা এখনো ছবি-মিডিয়াতে আসতে হিম্মত করছেন না, তাদের জন্যও ইসলামি শরিয়তের বিধানেই এর সুরাহা আছে। আর তা হচ্ছে, ইসলামি শরিয়তের পরিভাষায় ‘বিশেষ প্রয়োজন’Ñএর বেলায় প্রয়োজনীয়তার গ-ির ভেতরে বিভিন্ন হারাম কাজ করারও বৈধতা স্বীকৃত। তবে এক্ষেত্রে বিষয়টাকে প্রয়োজনের আওতাভুক্ত বলে একটা ফতোয়া জারি করার শর্ত আছে। আমি (নুরুল ইসলাম ওলিপুরি) মনে করি, উল্লিখিত প্রক্রিয়ামতে জাতীয় মুফতি সাহেবানের মধ্যে একটা ফতোয়া জারি হয়ে গেলেই আমাদের মিডিয়াসৈনিকরা মিডিয়াযুদ্ধের উন্মোক্ত ময়দানে নেমে যেতে পারেন অনায়াসে।”
হ্যাঁ, আমরাও আলামা নুরুল ইসলাম ওলিপুরির কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে বলতে চাইÑ জাতির বিবেক ওলামায়ে কেরাম এবং মুফতিয়ানে এজাম, আপনারা আন্তর্জাতিকভাবে একটি সেমিনারের আয়োজন করুন। দেশ-দশ, জাতি ও মিল্লাতের কথা বিবেচনায় রেখে সঠিক-সুন্দর একটি সমাধান বের করুন। মিডিয়াজগতের লাগাম আপনাদের হাতে তুলে নিন। ছবি-ভিডিও’র অপব্যবহার রোধ করুন। বিশ্বমুসলিমকে ধ্বংসের অতল গহবর থেকে রক্ষা করুন। বেহায়া-বেলেলাপনার নোংরা পরিবেশ থেকে দেশ, জাতি ও মানবতাকে উদ্ধার করুন।
লেখক
সহকারী সম্পাদক
আল কলম গবেষণা পরিষদ বাংলাদেশ
[email protected]