গণহত্যায় মোবারকের ফাঁসি, কাদের হত্যায় যাবজ্জীবন
সুরমা টাইমস ডেস্কঃ মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সাবেক আওয়ামী লীগ নেতা মোবারক হোসেনের বিরুদ্ধে আনা পাঁচটি অভিযোগের মধ্যে দুটি ( প্রথম ও তিন নম্বর অভিযোগ) অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। ট্রাইব্যুনাল তাকে ফাঁদির আদেশ দিয়েছে।গণহত্যা অর্থাৎ আখাউড়ায় ৩৩ জনকে হত্যার অভিযোগে রাজাকার কমাণ্ডারের ফাঁসি দেয়া হয়।এছাড়া মুক্তিযোদ্ধা খালেক হত্যায় তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে।যাবজ্জীবন কারাদণ্ড মানে তাকে আমৃত্য কারাদণ্ড দেয়া হয়।তার বিরুদ্ধে আনা পাঁচটির অভিযোগের মধ্যে এই দুটি প্রমাণিত হলেও বাকি তিনটি অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় তাকে ঐসব অভিযোগ থেকে খালাস দেয়া হয়েছে।চেয়ারম্যান বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ সোমবার ফাঁসির রায় ঘোষণা করেন।
এর আগে ৯২ পৃষ্ঠার রায়ের দ্বিতীয় অংশ পড়ে শোনানোর সময় বিচারক জাহাঙ্গীর হোসেন বলেছেন, মোবারকের বিরুদ্ধে আনার রাষ্ট্রপক্ষের অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে।এর আগে সোমবার সকাল ১১টা ২২ মিনিটে এ রায় পড়া শুরু করেন বিচারপতি আনোয়ারুল হক। ৯২ পৃষ্ঠার রায়ের দ্বিতীয় অংশ পড়েন বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন। রায়ের শেষ অংশ পড়েন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম।তিনিই ফাঁসির রায় ঘোষণা করেন।
এর আগে সোমবার সকাল ৯টা ২৯ মিনিটে মোবারককে নিয়ে পুলিশের একটি প্রিজন ভ্যান পুরাতন হাই কোর্ট এলাকায় পৌঁছায়। এরপর তাকে নিয়ে যাওয়া হয় ট্রাইব্যুনালের হাজতখানায়।বেলা ১১টার পর তাকে ট্রাইব্যুনালে নেয়া হয়। এর পর পরই বিচারকরা রায় পড়া শুরু করেন।
এক নম্বর অভিযোগে মোবারকের ফাঁসির আদেশ দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। এই অভিযোগে বলা হয়, একাত্তরের ২২ আগস্ট মোবারক ও অন্য রাজাকারেরা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া থানার টানমান্দাইল গ্রামের ২৬ জন ও জাঙ্গাইল গ্রামের সাতজনকে বাছাই করে তেরোঝুড়ি হাজতখানায় নিয়ে যান। ২৩ আগস্ট পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারেরা ওই ৩৩ জনকে দিয়ে গঙ্গাসাগর দীঘির পশ্চিম পাড়ে গুলি করে হত্যা করে মাটিচাপা দেয়।
তিন নম্বর অভিযোগে মোবারককে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। ওই অভিযোগে বলা হয়েছে, একাত্তরের ১১ নভেম্বর রাত আটটা-নয়টার দিকে মোবারক তাঁর সশস্ত্র রাজাকার সহযোগীদের নিয়ে ছাতিয়ান গ্রামের আবদুল খালেককে অপহরণ করে সুহিলপুর ইউনিয়ন পরিষদের রাজাকার ক্যাম্পে নিয়ে যান ও শারীরিকভাবে নির্যাতন করেন। ওই রাতেই খালেককে তিতাস নদীর পশ্চিম পাড়ে বাকাইল ঘাটে নিয়ে গুলি ও বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করা হয়।
২, ৪ ও ৫ নম্বর অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় খালাস পেয়েছেন মোবারক।
দ্বিতীয় অভিযোগে বলা হয়, মুক্তিযুদ্ধকালে মোবারক ও অন্য স্বাধীনতাবিরোধীরা মিলে ‘আনন্দময়ী কালীবাড়ী’ নামের একটি হিন্দু মন্দিরের মূর্তি ভাঙচুর ও মালামাল লুটের পর এটি দখল করেন, পরে মন্দিরটির নাম রাখেন ‘রাজাকার মঞ্জিল’। ২৪ অক্টোবর মোবারক শিমরাইল গ্রামের আশুরঞ্জনকে অপহরণ করে আহত অবস্থায় চার দিন রাজাকার মঞ্জিলে আটকে রাখেন এবং ২৮ অক্টোবর তাঁকে কুড়লিয়া খালের পাড়ে নিয়ে গুলি করে হত্যা করেন।
চতুর্থ অভিযোগ হলো, একাত্তরের ২৪-২৫ নভেম্বর বেলা দুইটা-আড়াইটার দিকে মোবারকের নেতৃত্বে রাজাকারের একটি দল খড়মপুর গ্রামের খাদেম হোসেন খানকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর থানার স্টেশন রোড থেকে অপহরণ করে ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজে স্থাপিত সেনাক্যাম্পে আটকে রেখে নির্যাতন করে। ৬ ডিসেম্বর অন্য কয়েকজন বন্দীর সঙ্গে তাঁকেও কুড়লিয়া খালের পাড়ে নিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়।
পঞ্চম অভিযোগ অনুসারে, একাত্তরের ২৮-২৯ নভেম্বর রাত ১১টার দিকে পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারদের সঙ্গে নিয়ে মোবারক খড়মপুর গ্রামের আবদুল মালেক ও আমিরপাড়া গ্রামের মো. সিরাজকে অপহরণ করেন। ৬ ডিসেম্বর সিরাজকে কুড়লিয়া খালের পাড়ে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে।
রায়ের জন্য মোবারককে রবিবারই গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগার থেকে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়।
সোমবার সকাল ৯টার ২০ এ ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে তাকে নিয়ে পুলিশের একটি প্রিজন ভ্যান ট্রাইব্যুনালের দিকে রওনা হয় বলে চকবাজার থানার ওসি আজিজুল হক জানান।
চেয়ারম্যান বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের নেতৃত্বে গঠিত তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ রায় পড়া শুরু করেন।
মোবারকের বিরুদ্ধে একাত্তরে হত্যা, অপহরণ ও লুটতরাজের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ রয়েছে।
যুদ্ধাপরাধের পাঁচ ঘটনায় অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে ২০১৩ সালের ২৩ এপ্রিল মোবারকের বিচার শুরু হয়। সাক্ষ্য ও যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ গত ২ জুন মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রাখে।
২০১৩ সালের ২০ মে মোবারক হোসেনের বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের সাক্ষীদের সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। প্রসিকিউশনের মোট ১২ জন সাক্ষী এ মামলায় সাক্ষ্য দেন।
এরা হলেন- মামলার মুক্তিযোদ্ধা দারুল ইসলাম,শহীদ আব্দুল খালেকের মেয়ে খোদেজা বেগম ও ছেলে রফিকুল ইসলাম,মো.খাদেম হোসেন খান,আলী আকবর, মো.আব্দুল মালেক,মুক্তিযোদ্ধা ননী গোপাল মল্লিক,আব্দুস সামাদ,শহীদজায়া ভানু বিবি,আব্দুল হামিদ,ব্রাহ্মণবাড়িয়া ইন্ডাস্ট্রিয়াল স্কুলের সুপারিনটেনডেন্ট চমন সিকান্দার জুলকারনাইন এবং তদন্তকারী কর্মকর্তা শ্যামল চৌধুরী।
গত ২৫ নভেম্বর প্রসিকিউশনের সাক্ষীদের সাক্ষ্যগ্রহণ এবং তাদের আসামিপক্ষের জেরা শেষ হয়।
আর আসামিপক্ষে সাফাই সাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দিয়েছেন আসামি মোবারক হোসেন নিজে ও তার বড় ছেলে মোহাম্মদ আসাদ উদ্দিন। উভয় সাক্ষীকেই সাক্ষ্য দেয়া শেষ হলে জেরা করে প্রসিকিউশন।
প্রসিকিউশনের বক্তব্য অনুযায়ী, ব্রাক্ষণবাড়িয়ার আখাউড়ার নয়াদিল গ্রামের মোবারক একাত্তরে স্থানীয় রাজাকার বাহিনীর কমান্ডার ছিলেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা প্রশাসনের তৈরি রাজাকারের তালিকায়ও তার নাম রয়েছে।