স্মৃতিচারণা: স্মৃতির ক্যানভাসে প্রিয় মুখ

এক

হঠাৎ বৃষ্টির মতই এক শুভাকাঙ্ক্ষির মুখে শুনলাম একটি দুঃসংবাদ- “রশিদ হেলালী স্যার আর নেই”। আমার বিশ্বাস হল হল না। সন্দেহের দৃষ্টি নিয়ে আমি তার দিকে তাকিয়ে থাকি। সে আমাকে দিব্যি দিয়ে বলে- “অপ্রত্যাশিত হলেও ঘটনাটি সত্য”। মুহূর্তেই আমার চোখ ছলছল করে ওঠে। মনের ভিতরটাতে মোচর দিয়ে ওঠে। অনুভূতির গহীন অরণ্যে হুহু করে বাতাস বইতে শুরু করে। আমি দূর আকাশের দিকে তাকাই। আকাশের গায়ে খণ্ডিত নির্বাক কালোমেঘ। আজ এই অপ্রত্যাশিত সংবাদে তাদেরও বুঝি মন খারাপ!

আমার মনে পড়তে লাগলো –এই তো সেদিন ওনার পা ছুঁয়ে সালাম করেছিলাম। উনিও মাথা ছুঁয়ে আশীর্বাদ করেছিলেন। আমি মাথায় হাত দেই। মনে হল ওনার আশীর্বাদ পুষ্ট হাতের স্বর্গীয় স্পর্শ যেন এখনো আমার মাথা ছুঁয়ে আছে। মনে পড়ল আমাকে দেয়া ওনার শেষ ডায়লগও- “বেশ খরি পড়বায়, মানুষের মত মানুষ অইবায়”। শ্রদ্ধেয় হেলালী স্যার, মানুষের মত মানুষ হতে পেরেছি কিনা জানি না, তবে বেশি বেশি করে এখনো বই পড়ি।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গানের ভাষায় বলেছিলেন, “মনে রবে কিনা আমারে…” এই পৃথিবীর মানুষ তাঁকে মনে রাখবে কিনা- গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ যেমন গানের বাণীতে প্রশ্নটি করেছিলেন তেমনি প্রশ্নটি সকল মানুষের। আর এই প্রশ্ন আছে বলেই আজন্ম মানুষ স্মৃতি সৃষ্টিতে মারিয়া হয়ে ওঠে। যে কোন সৃষ্টিশীল কর্মে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার প্রাণান্তকর চেষ্টা চালায়। মূলত মনের ভেতরের সেই স্বপ্ন থেকেই সৃষ্টিশীল, সৃজনশীল কর্মের এত তাড়া কিংবা এত প্রেরণা আসে। মানুষ নিজেকে আবিষ্কার করে নানা কর্মে। তন্ন তন্ন করে খোঁজতে থাকে স্মৃতি রক্ষার এক চিলতে চারণক্ষেত্র।

শ্রদ্ধেয় রশিদ হেলালী স্যার বৃহত্তর জৈন্তাপুর উপজেলায় শিক্ষা প্রসারের ক্ষেত্রে এক আলোকিত নাম। সমাজকে সুশিক্ষার আলোয় আলোকিত করতে, যুগোপযোগী করে গড়ে তুলতে হলে উচ্চ শিক্ষার প্রয়োজন। সেই কারণেই তিনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়তে আত্মনিয়োগ করলেন। নিজেদের পৈত্রিক সম্পত্তি দিয়ে, ব্যক্তিগত টাকা পয়সা, মানসিক শ্রম, শাররীক শ্রমের মাধ্যমে দেখতে দেখতেই বেশ কয়েকটি স্কুল এবং কলেজ প্রতিষ্ঠা করে ফেললেন। নিজের দূরদর্শিতা ও কৌশলী বুদ্ধিবৃত্তির মাধ্যমে এমপিওভুক্তও করে ফেললেন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা খুব একটা বেশি না থাকলেও নিজের সে অপূর্ণতা তিনি ভুলে গেছেন অসংখ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করে, বৃহত্তর জৈন্তা গোয়াইনঘাটের অসংখ্য ছেলেমেয়েদের উচ্চ শিক্ষার আলো বিতরণের মাধ্যমে। শিক্ষার আলো বিতরণকে তিনি শুধু নিজের দায়িত্ব হিসেবে নয়, বরং মিশন হিসেবে নিয়ে ছিলেন। প্রতিটি কাজই তিনি অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে করতেন। আর এই কারণেই বুঝি তিনি সফল হতেন। আজকের যুগের আধুনিক ছেলেমেয়েদের কাছে ওনার সৃষ্টকর্ম ও বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তা নিঃসন্দেহে প্রেরণা হয়ে থাকার মত।

প্রকৃত মানুষ জ্ঞান বিস্তারে আজীবন ব্রতী থাকেন। জীবন সম্পর্কে জ্ঞান লাভে এভাবে মানুষ বিভিন্ন মাধ্যমে নিজেকে প্রকাশে মারিয়া হয়ে ওঠে। সেই তাড়না থেকে জন্ম হয় নব জাতকের। সৃষ্টি হয় সৃজনশীল কর্মের। এ রকমই একজন সৃষ্টিশীল মানুষের সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল ২০০১ সালে। তাঁর নাম রশিদ হেলালী। বাবার নাম তৈয়ব আলী। জৈন্তাপুর নিজপাট ইউনিয়নে তৈয়ব আলী ডিগ্রি কলেজ সংলগ্নই তাঁর বাড়ি। পোশাকে আশাকে ছিলেন বেশ রুচিশীল একজন মানুষ। একাধারে তিনি ছিলেন মিষ্টিভাষী সুবক্তা, রাজনীতিবিদ, দক্ষ সংগঠক, সমাজ সংস্কারক, দানবীর, শিক্ষানুরাগী, সংস্কৃতিমনা বিজ্ঞ একজন ব্যক্তিত্ব। অবশ্য জৈন্তাপুর তৈয়ব আলী ডিগ্রি কলেজে ভর্তি হওয়ার কিছুটা আগেই তাঁর বহুমুখী গুণ সম্পর্কে সম্যক জেনে ছিলাম।

দুই
এই পৃথিবীতে কোন কোন মানুষ ক্ষণকাল পরে চিরতরে হারিয়ে যায়। যাকে বলা হয় অকালমৃত্যু। আবার কেউ কেউ এই স্বল্প সময়ে নিজেকে প্রকাশ করেন নানা সৃষ্টিশীল কর্মে। তাদেরকে মানুষ মনে রাখে বহুকাল, অনন্তকাল। রশিদ হেলালী ছিলেন তাদেরই একজন। তিনি স্বল্প পরিসরে নিজেকে জড়িয়ে ছিলেন সামাজিক, সাংস্কৃতি, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে। শিক্ষা প্রসারে ও জনকল্যাণমূলক কাজে তাঁর ছিল প্রচণ্ড ঝুঁক। এসব কারণেই এলাকার মানুষের কাছে তাঁর স্মৃতি অম্লান হয়ে আছে। সৃজনশীল এই মানুষের আকস্মিক মৃত্যু আমাকে বড়ই ব্যথিত করেছিল।

মহাকাল চিরায়ত। প্রকৃতির অমোঘ নিয়মেই চলছে এই বিশ্ব সংসার। মানব জীবনও তার ব্যতিক্রম নয়। মানবজীবন মহাসমুদ্রের স্রোতধারার মত গতিশীল। এই সোত মহাকালের আবর্তনে প্রতিনিয়ত আবর্তিত হচ্ছে। কালের খাতায় ইতিহাসের পাতায় ফুটে ওঠেছে তার স্বরূপ, আগমন ও তিরোধানের ছবি। মানবজীবনে সৎকর্মের পরিধি ও ব্যপ্তি খুবই বিস্তৃত। পাড়া প্রতিবেশী ও বন্ধু-বান্ধবদের নিয়েই মানবজীবন ফুলে ফুলে সুশোভিত হয়ে ওঠে। মানব জীবন আপনা আপনি রচিত হয় না। মানব জীবনকে রচনা করতে হলে ত্যাগ, সাধনা আর সংগ্রামের প্রয়োজন হয়। যারা জীবনের সাথে পাল্লা দিয়ে সাধনার দ্বারা জীবনসমুদ্র রচনা করেছেন তারাই ইতিহাসের শীর্ষে আরোহণ করে চিরস্মরণীয় হয়ে টিকে রয়েছেন। রশিদ হেলালী সেই সব অদম্য সাধনার মাধ্যমেই কালিক ইতিহাসে স্মরণীয় হওয়ার মত।

০৪.11.2014
gybwk Avwjg
Rvdjs, †MvqvBbNvU, wm‡jU
mvwe©K †hvMv‡hvM: 01741436851
Email: [email protected]