বালাগঞ্জের মার্ডার নিয়ে সর্বত্র বিরাজ করছে নানা গুঞ্জন : তদন্তে ব্যস্ত পুলিশ
শাহ মো. হেলাল, বালাগঞ্জঃ বালাগঞ্জ পূর্ববাজার জামে মসজিদের ইমাম মাওলানা আব্দুল হামিদ ওরফে আব্দুস শুকুর কালা হুজুর ও সিএনজি চালক আরশ আলীর হত্যাকান্ডের ঘটনার ১৫দিন অতিবাহিত হলেও নানা আলোচনা সমালোচনা অব্যাহত রয়েছে। তোলপাড় করা চাঞ্চল্যকর এ ডাবল মার্ডার নিয়ে সর্বত্র বিরাজ করছে নানা গুঞ্জন। আর হত্যাকান্ডের শিকার ইমাম ও সিএনজি চালকের পরিবার পরিজনদের মধ্যে এখনও চলছে কান্নার মাতম। কোন সান্ত্বনাতেই তারা শান্তি খুঁজে পাচ্ছেন না। এছাড়া উপজেলার জনপ্রতিনিধিসহ সুশীল সমাজের নেতৃবৃন্দ এ ঘটনায় দায়ীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছেন। অবশ্য হতাকান্ডের ব্যাপারে অভিযুক্ত শিমুল ও তার মা আফিয়া বেগম স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদান করলেও বালাগঞ্জ থানা পুলিশ বিস্তারিত কারণ ও প্রকৃত দোষীদের সনাক্ত করার ব্যাপারে জোর অনুসন্ধান চালিয়ে যাচ্ছে।
সরেজমিন পরিদর্শন ও সংশি¬ষ্টদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, হত্যাকান্ডের শিকার ইমাম ও সিএনজি চালকের লাশ উদ্ধার ও দাফনের এক সাপ্তাহ পরও এলাকায় এ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা সমালোচনা অব্যাহত রয়েছে। মর্মান্তিক এ ঘটনার বিষয়ে এখনও তিব্র ক্ষোভ বিরাজ করছে নানা পেশার নাগরিকদের মধ্যে। গত ২৪অক্টোবর নিহতদের দু’দফা জানাজায় শরিক হওয়া হাজার হাজার মানুষের কণ্ঠে খুনীদের শাস্তির যে দাবি উঠেছিল তা এখনও বাতাসে ভাঁসছে। জনপ্রতিনিধিসহ এলাকাবাসী কোন ভাবেই এ হত্যাকান্ড মেনে নিতে পারছেন না। বালাগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মো. আবদাল মিয়া, ভাইস চেয়ারম্যান মাওলানা সৈয়দ আলী আছগর, বালাগঞ্জ উপজেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক মো. আনহার মিয়া, বালাগঞ্জ সদর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এমএ মতিন, বোয়ালজুড় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হাজী মো. আব্দুন নূরসহ বিভিন্ন শ্রেণী পেশার নাগরিকরা প্রকৃত খুনীদের শাস্তির দাবি জানিয়েছেন।
অবশ্য হত্যাকান্ডের ঘটনায় নিজেদের জড়িত থাকার বিষয়ে ইতোমধ্যে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদান করেছেন গ্রেফতারকৃত শিমুল ও তার মা আফিয়া বেগম। তবে জবানবন্দিতে অভিযুক্ত শিমুল নিহত মাওলানা আব্দুল হামিদ ওরফে আব্দুস শুকুর কালা হুজুরকে জড়িয়ে তার মায়ের সাথে অনৈতিক সম্পর্কের যে অভিযোগ তুলেছেন তাতে বালাগঞ্জের নাগরিক সমাজকে আরও বিক্ষুদ্ধ করে তুলেছে। নিহত ইমামের পরিচিতজনরা দাবি করেছেন প্রায় ২৩ বছর যাবত তিনি বালাগঞ্জ পূর্ববাজার জামে মসজিদের ইমাম হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। কোনদিন তার বিরুদ্ধে এমন ঘৃণ্য অপবাদ ওঠেনি। তার হত্যাকান্ডের ঘটনায় বালাগঞ্জের হিন্দু মুসলিম সকল ধর্ম বর্ণের মানুষের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে। বালাগঞ্জের জনপ্রতিনিধি, স্থানীয় এলাকাবাসী ও রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ বলেন, অনৈতিকতার অভিযোগটি বিশ্বাস করা যায় না, প্রকৃত ঘটনাকে আড়াল করার জন্যই ষড়যন্ত্রমূলক ভাবে এমন অপবাদ প্রদান করা হচ্ছে। তাদের অভিযোগ, এই হত্যাকান্ডের সাথে শুধু মা-ছেলে জড়িত নয়, আরও অনেকেও থাকতে পারে। কারণ লাশ গুম করতে গিয়ে বাথরুমের ভেতরে যে ধরনের ঢালাই বা পাকাকরণ কাজ করা হয়েছে তাতে সংঘবদ্ধ তৎপরতার ব্যাপারে সন্দেহ থেকেই যায়।
এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নিষ্ঠুর হত্যাকান্ডের শিকার ইমাম ও সিএনজি চালকের বাড়িতে এসে তাদের স্বজনদের এক নজর দেখে যাওয়ার জন্য বিভিন্ন এলাকার লোকজন এখনও ভিড় করছেন। নিহতদের পরিবারে এখনও কান্নার মাতম চলছে। বিশেষ করে সিএনজি চালক আরশ আলীর পরিবারের আহাজারি থামছেই না। দু’সন্তান ৬ বছরের কন্যা ইমা আর ৪ বছরের পুত্র তামিমের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা ভেবে দিশেহারা আরশ আলীর স্ত্রী রায়না বেগম। অসহায় দৃষ্টি নিয়ে বারবার জানতে চাইছেন কে চালাবে তার সন্তানদের ভরণ-পোষণ, কিভাবে চলবে সংসার। অবশ্য বালাগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মো. আবদাল মিয়া নিহত সিএনজি চালকের বাড়িতে গিয়ে তার পরিবাবের খোঁজ খবর নিয়েছেন এবং আর্থিক অনুদান দিয়েছেন। ভবিষ্যতেও সার্বিক সহযোগীতা অব্যাহত রাখার প্রতিশ্র“তি দিয়েছেন বলে জানা গেছে।
এদিকে হত্যাকান্ডের বিষয়ে সর্বশেষ আলাপকালে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই অরুপ কুমার চৌধুরী জানিয়েছেন, আটককৃত আসামী শিমুল ও তার মা আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদান করেছে। বালাগঞ্জ থানার অফিসার ইন-চার্জ অকিল উদ্দিন আহমদ বলেন, প্রাথমিক পর্যায়ে নিখোঁজ ঘটনার পর থেকেই আমরা অক্লান্ত পরিশ্রম করেছি। রাতদিন খেটে অনেক চেষ্টা-তদবির করে লাশের সন্ধান এবং অভিযুক্তদের ধরতে সক্ষম হয়েছি। হত্যাকান্ডের রহস্য উদঘাটন এবং প্রকৃত দোষীদের চিহ্নিত করার ব্যাপারে আমরা এখন সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। অপরাধীদের ধরতে পুলিশের গড়িমসি বিষয়ে বিভিন্ন মহলের অভিযোগ প্রসঙ্গে অকিল উদ্দিন আহমদ বলেন, আমরা আমাদের দায়িত্ববোধ থেকেই অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথেই জোরদার তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছি। এ ব্যাপারে অনেক অগ্রগতি হয়েছে। যে বা যারা অপরাধের সাথে জড়িত তারা প্রত্যেকেই শাস্তির আওতায় আসবে।
উল্লেখ্য বালাগঞ্জ পূর্ববাজার জামে মসজিদের ইমাম খারমাপুর গ্রামের হাফেজ আব্দুল হামিদ ওরফে আব্দুস শুকুর কালা হুজুর (৫৫) ও সিএনজি চালক কাশিপুর গ্রামের আরশ আলী (৩০) গত ১৮ অক্টোবর রাতে নিখোঁজ হন। এরপর ২৩ অক্টোবর বালাগঞ্জের ইলাসপুর বড়চর গ্রামে ইমামের শালিকার বাড়িতে লাশ দু’টির সন্ধান পায় পুলিশ। ওইদিন সন্ধ্যায় বসতঘরের নির্মাণাধিন নতুন একটি বাথরুমের ভিতরে ইট পাথরের ঢালাই ভেঙ্গে ইমাম ও সিএনজি চালকের লাশ উদ্ধার করা হয়। এসময় ঘটনাস্থল থেকে ইমামের শালিকা আফিয়া বেগম (৪৫), তার পুত্র মারজানুল আলম ওরফে শিমুল (২১), শাকিল (১৬) ও মেয়ে সারমিন (১৭) কে আটক করে। পরদিন নিহত ইমাম মাওলানা আব্দুল হামিদের ভাই আব্দুল খালিক বাদী হয়ে বালাগঞ্জ থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। (নম্বর ১৬, তারিখ ২৪/ ১০/ ২০১৪)। একই দিন আসামী শিমুল ও আফিয়া বেগমকে আদালতে হাজির করা হলে তারা হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত থাকার বিষয়ে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদান করে। আটককৃত আফিয়া বেগমের মেয়ে সারমিন ও ছেলে শাকিলকে ইতোমধ্যে তাদের স্বজনদের জিম্মায় ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। লাশ দু’টির ময়না তদন্ত শেষে ২৪অক্টোবর রাতে দাফন সম্পন্ন হয়।