৮ মাস ধরে পানির নিচে মোটর সাইকেল চালকের লাশ
সুনামগঞ্জে বিয়ের পাত্রী দেখার কথা বলে মোটর সাইকেল ভাড়া করে নিয়ে গিয়ে চালককে ঠান্ডা মাথায় খুন করে ঘাতকরা
হাবিব সরোয়ার আজাদঃ প্রথমে পরিকল্পনা ছিল মহিষ চুরি করার কিন্তু মহিষ চুরি করতে না পেরে অবশেষে চুরির ক্ষতি পুষিয়ে নিতে বিয়ের পাত্রী দেখার কথা বলে মোটর সাইকেল ভাড়া করে নিয়ে গিয়ে ৪ সংঘবদ্ধ চোর পরিকল্পিত ভাবে ঠান্ডা মাথায় চালককে খুন করে হাওরে পুতে রাখে হতাভাগ্য শামিম আহমদের লাশ।
পুলিশের অভিযানে মোটর সাইকেল উদ্যার ও একে একে ৩ খুনী ধরা পড়লেও গত ৮ মাস ধরেই হাওরে পানির নিচে পড়ে রয়েছে সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার সদর ইউনিয়নের মধ্য-তাহিরপুরের হত দরিদ্র আবুল হোসেনের পুত্র গাড়ি চালক শামিম আহমদ (১৮)’র লাশ। নিখোঁজ হওয়ার পর পুলিশী তদন্তে ৮ মাসের মাথায় শামিম খুনের রহস্য উন্মোচিত হওয়ার পর গোটা তাহিরপুর উপজেলা জুড়ে বইছে শোকের মাতম। ঘাতকদের ফাঁসির দাবিতে গতকাল শুক্রবার বেলা ১২ টা থেকে ২ টা পর্য্যন্ত ভাড়ায় চালিত কয়েক শ’মোটর সাইকেল চালক তাহিরপুর-সুনামগঞ্জ সড়কে অবস্থান নিয়ে কর্মবিরতি পালন করেন। জেলা সদরের সঙ্গে সরাসরি সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা না গড়ে উঠায় তাহিরপুর , বিশ্বম্ভরপুর, ধর্মপাশা ও জামালগঞ্জ সহ বেশ ক’টি উপজেলায় গত দু’যুগেরও বেশী সময় ধরে হাজারো মোটর সাইকেল চালক শুস্ক মৌসুমে ভাড়ায় যাত্রী পরিবহন কাজে নিয়োজিত রয়েছেন। আর এই প্রথমারের মত এক চালক খুন হওয়ায় তাদের মধ্যে দেখা দিয়েছে উদ্ভেগ । এ ঘটনায় সুনামগঞ্জ ,বিশ্বম্ভরপুর ও তাহিরপুর এলাকায় যাত্রী পরিবহনে কাজে নিয়োজিত মোটর সাইকেল চালকদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।
এ নির্মম খুনের ঘটনা জানতে পুলিশ ও ভিকটিমের পারিবারীক সুত্রে গতকাল সরজমিনে গিয়ে আলাপকালে জানা যায়, তাহিরপুর উপজেলার সীমান্তবর্তী লাউড়েরগড়ের ছড়ারপাড় গ্রামের মৃত কালু ফকিরের পুত্র পেশাদার চোর আশিক মিয়া (৩০) ও তার এক সহযোগীকে নিয়ে চলতি বছরের ৯ মার্চ প্রথমে নিজ এলাকা সহ দু’টি হাওরে মহিষ চুরি করার উদ্দ্যেশে বের হয়। শেষ পর্য্যন্ত মহিষ চুরি করতে ব্যর্থ হয়ে সদর উপজেলার রঙ্গারচর গ্রামের তাদের সর্দার মৃত আসকর আলীর পুত্র আব্দুর রউফ (৩৫)’র সাথে মোবাইল ফোনে শলাপরামর্শ করে জানায় মহিষ মেলাতে পারেনি তাই বিকল্প হিসাবে কোন ভাড়া করে মোটরসাইকেল চালককে নিয়ে আসলে গাড়ি রেখে অন্যত্র বিক্রি করে ক্ষতি পুষিয়ে নেয়া যাবে। নিজেদের পরিচয় গোপন করে পরিকল্পনা মাফিক তাহিরপুর উপজেলা সদর থেকে আশিক ও তার সহযোগী দু’জন মিলে সদর উপজেলার রঙ্গারচর গ্রামে বিয়ের পাত্রী দেখার কথা বলে শামিমকে তার মোটর সাইকেল সহ আসা যাওয়া বাবত ৫’শ টাকা ভাড়া নির্ধারণ করে সন্ধায় সর্দার রউফের বাড়িতে হাজির হয়। রউফের বাড়িতে সেদিন আদৌ ছিলনা পাত্রী দেখানোর কোন আয়োজন। সময় ক্ষেপন করে রাত ঘনিয়ে এলে শামিমের পরিচয় নিশ্চিত হয়ে ঝামেলা এড়াতে রাতের খাবার খাওয়ানোর পর পরিকল্পিত ভাবে আশিক শামিমের গলায় গামছা পেছিয়ে ধরে তার শাসরোধ করে ঠান্ডা মাথায় খুন করে । খুনের কাজে চোরের সর্দার রউফ সহ আরো ২ সহযোগী সহযোগীতা করে। এরপর রাতের আধারেই গ্রামের পার্শ্ববর্তী কালনার হাওরের কোদাল দিয়ে গর্ত করে শামিমের লাশ পুত্রে রাখে। বর্তমানে হাওরের ৮ হাত পানির নিচে পড়ে রয়েছে হতভাগ্য শামিমের লাশ রয়েছে।
এ ঘটনায় প্রথমে শামিমের দরিদ্র পিতা থানায় নিখোঁজ উল্ল্যেখ করে একটি সাধারন ডায়রী করেন। এক পর্যায়ে পুলিশ বর্ণণা অনুযায়ী কয়েকদিনের মাথায় শামিমের লাল রঙের প্লাটিনা ১০০ সিসি মোটর সাইকেলটি এক চালকের নিকট থেকে উদ্যার করে প্রথমে তাকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারকৃত চালকের নাম রিপন মিয়া (২২)। সে রউফের গ্রামের মৃত আসকর আলীর পুত্র। তাকে আদালতের মাধ্যমে জেল হাজতে পাঠিয়ে রিমান্ডে আনার পরও তেমন কোন তথ্য পাওয়া যায়নি। এরপর নিখোঁজ শামিমের পিতা ১৯ মার্চ তার পুত্রকে অপহরণ ও দস্যুতার অভিযোগ এনে থানায় ৩ জনকে অভিযুক্ত করে আরেকটি নিয়মিত মামলা দায়ের করেন। মামলা দায়েরের পর শামিমের নিখোঁজ রহস্য উন্মোচনে দ্বিতীয় দফায় তদন্তে নামেন থানার উপ-পরিদর্শক (এইআই) শাহ আলম ভুইয়া। তদন্তকাজে তথ্য প্রযুক্তিকাজে নিবিড় ভাবে সহায়তা করেন থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) জামাল উদ্দিন। পরবর্তীতে ঘাতকদের শনাক্ত করা হয়। এর পর নিবিড় তদন্তে শামিমের মোবাইল ফোনের কললিষ্ট ও সিডিআর পর্যবেক্ষণ করে আরো ২ জনকে ঘাতক হিসাবে নতুন করে শনাক্ত করা হয়। এরপর পুলিশের ধাওয়া খেয়ে দ্বীর্ঘ দিন পালিয়ে থাকার পর কিছুদিন আগে চোরের সর্দার রউফ আদালতে আত্বসমর্পণ করলে গত সোমবার তাকে থানায় রিমান্ডে নিয়ে আসার পর রউফ অকপটে স্বীকার করে নেয় শামিমকে শাসরোধ করে খুন করার পর তার লাশ হাওরে পুতে রাখা এবং রিপনের নিকট গাড়িটি মাসিক ৫ হাজার টাকায় ভাড়া দেয়ার বিষয়টি। এরপর এঘটনায় আরেক চোর ও শামিম খুনের মুল হোতা আশিককে নিজ বাড়ি থেকেই বৃহস্পতিবার রাতে পুলিশ গ্রেফতার করে। এভাবেই উন্মোচিত হয় পাত্রী দেখার নাঠক তৈরী করে একদল চোর ঠান্ডা মাথায় দরিদ্র পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম গাড়ি চালক শামিমকে শাসরোধ করে খুন করার পর তার গাড়ি ছিনিয়ে নেয়ার ঘটনা।
এদিকে গতকাল ঘটনার খোঁজ নিতে গিয়ে সরজমিনে গিয়ে দেখা যায়, শামিমের পরিবারে চলছে শোকের মাতম। শামীমের মা ফাতেমা খাতুন পুত্র হারানোর শোঁকে অঝরধারায় কেঁদে কেঁদে বার মুর্চা যাচ্ছিলেন আর বলছিলেন তরা (খুনিরা) আমার মানিককে (শামিম) কে কেরে জানে মারলি , না মাইরা গাড়িঢা নিয়া গেলেই তো পারতি। আত্বীয় স্বজনকে ধরে মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে বলছিলেন হতভাগ্য মা ফাতেমা “তোমরা আমার ছেলের লাশটা উদ্যার করে দিয়া যাও। আমার মানিকের মুখটা শেষ বারের মত দেখতাম চাই’।
প্রায় বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ে থাকা শামিমের বাবা আবুল হোসেন (৪৫) কাঁপা কাঁপা ঠোটে এ প্রতিনিধিকে বলছিলেন, আমার দু’ছেলের আর ১ মেয়ের মধ্যে শামিম ছিল ছেলেদের মধ্যে বড়। আমি বর্গাচাষী দরিদ্র কৃষক, কিছু সঞ্চয় আর প্রতিবেশীদের নিকট থেকে ধার দেনা করে মৃত্যুর মাত্র ১ মাস ১০দিন আগে ১ লাখ ১৫ হাজার টাকায় তাকে গাড়িটি কিনে দিয়েছিলাম। দরিদ্রতার কারনে আরেক ছোট ছেলেকে সিলেটের এক দোকানে দিয়েছি কাজ করার জন্য। প্রতিদিন শামিম মোটর সাইকেল চালিয়ে ৫ থেকে ৮’শ টাকা আয় করত। কথা ছিল গাড়ির দেনা পরিশোধ করে সংসারে কিছুটা স্বচছলতা ফিরে আসলে শামিমকে বিয়ে করিয়ে ঘরে পুত্রবধু তুলবেন। কিন্তু দেনা পরিশোধ আর স্বচছলতা ফিরে আসার আগেই শামিমকে শুধু মাত্র একটি মোটরসাইকেলের জন্য ঘাতকদের হাতে প্রাণ দিতে হল। ঘরে পুত্র বধু আনার কাজটি অধরাই রয়ে গেল। একমাত্র উপার্জক্ষম পুত্র শামিমকে হারিয়ে নিভে গেল একটি পরিবারের আশার প্রদীপ।
থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. আনিছুর রহমান খাঁন বললেন, শামিম খুনের ঘটনায় আরো ২ ঘাতককে ধরতে পুলিশী অভিযান চলছে, আমরা সর্ব্বোচ্য গুরুত্ব দিয়েই তার হত্যার রহস্যটি উদঘাটন করতে পেরিছে।
পুলিশ সুপার মো. হারুন অর রশীদ বললেন, শামিমের লাশ উদ্যারের জন্য স্থানটি শনাক্ত করে দু’এক দিনের মধ্যেই হাওরে ডুবুরি নামানো হবে এরপর যদি লাশ উদ্যার না হয় তাহলে পানি কমার সঙ্গে সঙ্গে দ্রুত শামিমের লাশ উদ্যার করার আশ্বাস প্রদান করেছেন তিনি।