সেই মমতাজ এখন নিজেই ইতিহাস
সুরমা টাইমস ডেস্কঃ ‘বীরাঙ্গনা মমতাজ বেগম ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রায় শেষভাগে পাক বাহিনীর পাশবিক নির্যাতনের ক্ষত বয়ে বেড়িয়েছেন দীর্ঘ ৪৪ বছর। এ বীরাঙ্গনার মৃত্যুতে একটি জীবন্ত ইতিহাসের বিদায় হলো। যার মুখ দিয়ে দেশবাসী পাক হানাদারদের প্রত্যক্ষ নির্যাতনের ইতিহাস শুনতো। সেই মমতাজ এখন নিজেই ইতিহাস হয়ে গেলেন। তবে তার ত্যাগকে চেতনায় ধারণ করে এ প্রজন্ম এগিয়ে যাবে, এটিই আমাদের প্রত্যাশা।’
স্থানীয় মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক নূর মোহাম্মদ ফকির বীরাঙ্গনা মমতাজের জানাজা শেষে অত্যন্ত আবেগভরা কণ্ঠে কথাগুলো বলেন।
১৯৭১ সালে পাক বাহিনীর পাশবিক নির্যাতনে পেটের ক্ষত নিয়ে শেষ পর্যন্ত আর বেঁচে থাকতে পারলেন না শ্রীপুরের বীরাঙ্গনা মমতাজ বেগম (৬৫)।
তিনি গাজীপুর জেলার শ্রীপুর উপজেলার লতিফপুর গ্রামের মৃত রমিজ উদ্দিন মোড়লের স্ত্রী। টানা আড়াই মাস ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থেকে ২৯ অক্টোবর বুধবার সন্ধ্যে সাড়ে ৬টায় মারা যান। (ইন্নালিল্লাহে…….রাজিউন)।
মমতাজের দেবর অব্দুল মুহিত (৭০) জানান, ১৯৭১ সনের শেষ দিকের সকাল বেলা ১৮ জন নারীর মধ্য থেকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী মমতাজ বেগমকে বাছাই করে। একুশ বছর বয়সী মমতাজ বেগম সুশ্রী হওয়ায় হানাদার বাহিনীর নজরে পড়েন। ১০ থেকে ১২ জন পাকসেনা তাকে নিয়ে যায় তার বাড়ির পাশের একটি আখ ক্ষেতে। সেখানে চলে পাশবিক নির্যাতন। উপর্যুপরি ধর্ষণে আট মাসের সন্তান সম্ভবা মমতাজকে গ্রামবাসী অচেতন অবস্থায় প্রায় চারঘণ্টা পর উদ্ধার করেন।
কিন্তু ওইদিনই তিনি মৃত ছেলে সন্তান প্রসব করেন। শরীরে প্রাকৃতিক ডাকে সাড়া দেয়ার রাস্তা দুটি চিরদিনের জন্য এক হয়ে যায়। স্বাধীনতার পর মোট আটবার অপারেশন করতে স্বামীর সহায় সম্বল হারাকে হয়েছে। কিন্তু স্বাভাবিক প্রাকৃতিক কাজ তিনি সারতে পারেন না। ৪০ বছর ধরে চিকিৎসকের পরামর্শে বিকল্প পথে পেট ফুটো করে প্রাকৃতিক কাজ সেরেছেন আমৃত্যু। সেই ঘটনার পর কানেও শুনতে পেতেন না। বেশিরভাগ সময় তাকে ইশারা করে বুঝাতে হয়েছে। এক মাস আগে পেটের ক্ষত স্থানে আরও দুইবার অপারেশন করা হয়েছে। এজন্য মোট ১০ বার অপারেশন হয়েছে তার ক্ষত স্থানে।
দেবর আব্দুল মুহিত আরো জানান, স্বাধীনতার চল্লিশ বছর পর্যন্ত বীরাঙ্গনা মমতাজ কিছু পায়নি। এ লজ্জা শুধু আমাদের নয়, সারা দেশের। রাজাকাররা তাকে নির্যাতনের জন্য পাক হানাদারদের সহযোগিতা করেছে। ওই সময়ে আমরা প্রতিবাদ করলে তারা আমাদের গুলি করে মেরে ফেলার হুমকি দিয়েছে। গত দুই বছর আগে বর্তমান সরকার তাকে তার বাসস্থানে ছাদ বিশিষ্ট একতলা পাকা বাড়ি তৈরি করে দেন।
লতিফপুর গ্রামের সাহেরা খাতুন (৯৫) জানান, দেশ স্বাধীনের পর লোকলজ্জার ভয়ে কাউকে নির্যাতনের কথা জানায়নি তার পরিবার। স্বামী রমিজ উদ্দিন মোড়ল তার সহায় সম্বল বিক্রি করে স্ত্রী মমতাজের চিকিৎসা করান।
একটি জীবন্ত ইতিহাসের বিদায়এর মধ্যেই তার দুই কন্যা নিলুফা ইয়াসমিন ও জাকিয়া সুলতানাকে পার্শ্ববর্তী কাপাসিয়া উপজেলায় বিয়ে দেন। সব শেষ করে এক পর্যায়ে মানুষের কাছে হাত বাড়ান। কেউ তাকে সাহায্য করেন না। বাঁচার তাগিদে অবশেষে নির্যাতনের কাহিনী বলতে বাধ্য হন মমতাজ বেগম। দেশ স্বাধীনের প্রায় ১৫ বছর পর স্থানীয় গণমাধ্যম কর্মীরা তার নির্যাতনের কাহিনী তুলে ধরেন। সামান্য যা সাহায্য পান তা দিয়ে কয়েকদিন চলে। আবার কোনো গণমাধ্যমে ছাপা হলে আবার কিছু সাহায্য মেলে। সহায় সম্বল হারিয়ে জীবনের শেষ দিনগুলো স্বামীর বোনের সম্পত্তির ওপর বসবাস করেন বীরাঙ্গনা মমতাজ বেগম।
গত আট মাস আগে স্বামী রমিজ উদ্দিন মোড়ল (৭৫) বার্ধক্যজনিত কারণে মারা যান।
বীরাঙ্গনার দুই মেয়ে নিলুফা ইয়াসমিন ও জাকিয়া সুলতানা জানান, সরকারের তৈরি করে দেয়া ঘর-বাড়ি সবই আমার মা পেয়েছে। কিন্তু ভোগ করে যাওয়া তার কপালে হয়নি। রাষ্ট্রের কাছে আমাদের দাবি সময় থাকতেই যেন বীরাঙ্গনাদের সম্মান দেয়া হয়।
গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের কমান্ডার সিরাজুল হক বলেন, ‘শ্রীপুর উপজেলায় পাঁচ জন মুক্তিযোদ্ধাকে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে আবাসন তৈরি করে দেয়া হয়েছে। বীরাঙ্গনা মমতাজ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এ প্রকল্পের আওতায় সর্বপ্রথম একটি বাড়ির মালিক হয়েছেন।’
৩০ অক্টোবর বৃহস্পতিবার বেলা ১১টায় তার স্বামীর কবরের পাশেই তাকেই দাফন করা হয়। মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় নাম না থাকায় তার দাফন রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় হয়নি।
তবু শ্রীপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সাদেকুর রহমান, শ্রীপুর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আবুল কাশেম, উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কামান্ডার সিরাজুল হক, উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট শামসুল আলম প্রধানসহ বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ জানাজা নামাজে অংশগ্রহণ করেন।