উদ্বোধনের অপেক্ষায় বহুল প্রতিক্ষিত পানি শোধানাগার প্রকল্প

water treatment plantসুরমা টাইমস ডেস্কঃ সিলেট নগরীতে দৈনিক পানির চাহিদার পরিমাণ প্রায় ৮ কোটি লিটার। ৩০টি উৎপাদক নলকূপের মাধ্যমে দৈনিক মাত্র ২ কোটি ৫০ লাখ লিটার পানি নগরবাসীর জন্য সরবরাহ হচ্ছে। যা চাহিদার মাত্র শতকরা ৩০ ভাগ। অসহনীয় এ সমস্যা সমাধানে ১০ টি উৎপাদক নলকূপ স্থাপন করা হচ্ছে। পাশাপাশি সিলেট-বরিশাল প্রকল্পের আওতায় পানি শোধনাগার প্রকল্পের কাজ প্রায় সম্পন্ন এখন উদ্বোধনের অপেক্ষায়। এতে দৈনিক ২ কোটি ৮০ লক্ষ লিটার পানি সরবরাহ বৃদ্ধি পাবে।
আশার কথা, সারি নদীকে উৎস ধরে দৈনিক ৫ কোটি লিটার পানি সরবরাহের লক্ষ্যে ৩২১ কোটি টাকা ব্যয়সাপেক্ষ একটি নতুন প্রকল্প প্রণয়ন করা হয়েছে।
সিলেট মহানগরীসহ আশপাশের এলাকার বিশুদ্ধ পানির সংকট নিরসনের লক্ষে সিলেট সদর উপজেলার খাদিমপাড়া ইউনিয়নে নবনির্মিত পানি শোধানাগার প্রকল্পের কাজ প্রায় শেষ হয়েছে। এখন চলছে ফিনিশিংয়ের কাজ। সিলেটবাসীর বহুল প্রতিক্ষিত এবং অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের অগ্রাধিকার এই প্রকল্পটি এখন উদ্বোধনের অপেক্ষায় রয়েছে। ৮ একর ভূমির উপর ১শ’ ৩২ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এ প্রকল্পটি পুরোপুরি চালু হওয়ার পর সিলেট সিটি করপোরেশন ও আশপাশের ১শ’ ২৫ কিলোমিটার এলাকার মধ্যে প্রতিদিন ২ কোটি ৮০ লাখ লিটার বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করা সম্ভব হবে। যা সিলেট মহানগরীর দীর্ঘদিনের বিশুদ্ধ পানির সংকট সমাধানে অনন্য ভূমিকা রাখবে।
বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠান সিলেট জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রকল্পটি চালু হলে সিলেট মহানগরীর ৭০ ভাগ পানির সমস্যা সমাধান হবে। বর্তমানে প্রকল্পটির ২টি পানি শোধানাগারের মধ্যে একটি পরিক্ষামূলকভাবে চালু করা হয়েছে। সরকারে অর্থায়নে সিলেট-বরিশাল মহানগরীতে পানি সরবরাহ, স্যানিটেশন ও ড্রেনেজ প্রকল্পের আওতায় বিগ বাজেটের এই প্রকল্পটির বাস্তবায়ন কাজ করছে সিলেট জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর। হস্তান্তরের পর প্রকল্পটি সিলেট সিটি করপোরেশনের অধীনে থাকবে।
২০০৬/০৭ অর্থবছরে বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে প্রথমে এই প্রকল্পটির উদ্যোগ গ্রহন করা হয়। প্রাথমিকভাবে যার প্রকল্প ব্যয় নির্ধারণ করা হয় ২৪ কোটি টাকা। কিন্তু সেই সময় আর প্রকল্পটি আলোর মুখ দেখেনি। পরবর্তীতে ২০০৯ সালের নভেম্বর মাসে জাতীয় নির্বাহী পরিষদ একনেকে নতুন করে পানি শোধানাগার প্রকল্পের জন্য ১শ’ ৫কোটি টাকার ডিপিপি অনুমোদন হয়। পরে ওই বছর সিলেট সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র, মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি বদর উদ্দিন আহমদ কামরানের আমলে প্রকল্পটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। পরবর্তীতে ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে প্রকল্পের জন্য আরো ২৭ কোটি টাকা পাস হলে প্রকল্পটি ১শ’ ৩২ কোটি টাকায় উন্নিত হয়।
সিলেট সিটি করপোরেশন এলাকার পার্শ্ববর্তী সদর উপজেলার খাদিমপাড়া ইউনিয়নের সুনাপুর-নয়াবস্তী ও মীরেরচক এলাকার মধ্যবর্তী স্থানে প্রকল্পটি গড়ে উটেছে। প্রতিদিন ২ কোটি ৮০ লক্ষ লিটার ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন এ প্রকল্পের মধ্যে ২টি প্রকল্প রয়েছে। যার একটি ২ কোটি লিটার (২০এমএলডি) অন্যটি ৮০ লক্ষ লিটার (৮এমএলডি) । ইতোমধ্যে প্রকল্পটির কাজ প্রায় শেষ হয়েছে। তবে তা খতিয়ে দেখার জন্য সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীর উপস্থিতে গত জুলাই মাসে পরিক্ষামূলকভাবে একটি প্রকল্প কর্তৃপক্ষ চালু করলেও এখনো ফিনিশিং, সীমানা প্রাচীরসহ আনুষঙ্গিক কিছু কাজ বাকী আছে। যা আগামী সেপ্টেম্বরের মধ্যে শেষ হবে বলে জানান জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্টরা।
সরজমিনে দেখা যায়, মীরেরচক এলাকার সুরমা নদীর পারে দ্বীতল ভবনের সমান একটি ইনটেক নির্মাণ করা হয়েছে। সেখান থেকে ১৮ ইঞ্চি ডায়ামিটারের ২টি বড় লোহার পাইপ দিয়ে পানি শোধানাগার প্রকল্পের খননকৃত বিশাল আকৃতির পুকুরে সংযোগ প্রদান করা হয়েছে। ২টি পাইপের মধ্যে একটি পাইপ দিয়ে সুরমা নদী থেকে পুকুরে পানি নিয়ে আসা হচ্ছে। পুকুরে পানি আনার সাথে মাছ, শামুক, কচুরীপানাসহ যে সমস্ত ময়লা আসবে তা পুকুরের তলদেশে চলে যাবে। এরপর উপরের পানি চলে যাবে সরাসরি পানি শোধানাগারে। সেখান থেকে ধাপে ধাপে পানি বিশুদ্ধ হওয়ার পরে তা সরবরাহ করা হবে জনসাধারণের জন্য। স্লাশ ট্যাংক নামে আরেকটি ছোট পুকুর রয়েছে। সেখানে পানি বিশুদ্ধ করার সময় যে ময়লা বের হবে তা চলে আসবে এই পুকুরে। এমন পদ্ধতিতে পানি বিশুদ্ধ করার কাজ হবে বলে জানালেন বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠানের সাথে সংশ্লিষ্ট মোহন নামের একজন।
২০০৯ সালে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় থাকাকালিন সাবেক সিটি মেয়র, মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি বদর উদ্দিন আহমদ কামরানের আমলে নগরবাসীর দীর্ঘদিনের বিশুদ্ধ পানির সমস্যা নিরসনের লক্ষে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত প্রকল্পটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। এরপর একাধিকবার তিনি নির্মাণাধীন এই প্রকল্পটি পরিদর্শন করেন। কারণ নগরী থেকে স্থানান্তরিত হয়ে শহরতলীর বাদাঘাটে নির্মাণাধীন সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগার প্রকল্প, বাদাঘাট-বিমানবন্দর বাইপাস সড়ক প্রকল্প এবং খাদিমপাড়ায় নির্মিতব্য পানি শোধানাগার প্রকল্পটি অর্থমন্ত্রীর অগ্রাধিকার প্রকল্প হিসেবে পরিচিত। নিজেই তিনি তদারকি করছেন এই প্রকল্পগুলো।
সিলেট জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মাদ হানিফ জানান, সিলেট সিটি করপোরেশনসহ আশপাশের মোট ১শ’ ২৫ কিলোমিটার এলাকায় এ প্রকল্প থেকে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করা হবে। এর মধ্যে দক্ষিণ সুরমার ৩৫ কিলোমিটার এলাকায় এবারই প্রথম পানি সরবরাহ করা হবে। কারণ এর আগে দক্ষিণ সুরমায় পানির লেয়ার না পাওয়ার কারণে পানি সরবরাহ করা হতোনা। এখন সরাসরি ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট থেকে পানি সাপ্লাই দেওয়া হবে। বর্তমান প্রকল্পটি নির্মাণের আগে নগরবাসীকে ১৮টি প্রোডাকশন টিউবয়েল(উদপাদক নলকূপ) দিয়ে পানি সরবরাহ করা হতো। বর্তমানে এই ১৮টি উৎপাদক নলকূপের সাথে আরো ১২টি উৎপাদক নলকূপ স্থাপন করা হচ্ছে।
তিনি আরো জানান, অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের একক প্রচেষ্ঠার ফলে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হচ্ছে। কোন জনপ্রতিনিধি একটি প্রকল্প নিয়ে এতো তদারকি করতে আমি কাউকে দেখিনি। তিনি যেখানেই থাকেন না কেনো নিয়মিত প্রকল্পটি কোন অবস্থায় আছে তার খোঁজখবর নিতেন। কারণ তিনি মনে প্রাণে চাইতেন মহানগরের যে পানির সংকট তা যেনো দ্রুত সমাধান হয়। আশা করি প্রকল্পটি চালু হলে নগরবাসীর ৭০ভাগ পানির সমস্যা সমাধান হবে।
এদিকে আগামী ১৩ তারিখ অর্থমন্ত্রনালয়ে সিলেট জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের নিয়ে বসবেন অর্থমন্ত্রী। সেদিনই প্রকল্পটির চালুর বিষয়ে সিদ্ধান্ত হতে পারে বলে জানান জনস্বাস্থ্যের নির্বাহী প্রকৌশলী। আগামী সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে প্রকল্পটি চালু হতে পারে বলেও তিনি আশা প্রকাশ করেন।
এ ব্যাপারে সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী বলেন, সিটি করপোরেশনের কাজ গুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে পানির সমস্যা সমাধানে। নগরীতে দৈনিক পানির চাহিদার পরিমাণ প্রায় ৮ কোটি লিটার। অথচ ৩০ টি উৎপাদক নলকূপের মাধ্যমে আমরা দৈনিক মাত্র ২ কোটি ৫০ লাখ লিটার পানি অর্থাৎ চাহিদার মাত্র শতকরা ৩০ ভাগ সরবরাহ করতে পারছি, যা কোনমতেই সহনীয় নয়। সে অনুযায়ী যথাশীঘ্র সমস্যাটি লাঘবের লক্ষ্যে নগরীতে ১০ টি উৎপাদক নলকূপ স্থাপনের জন্য দরপত্র আহবান করে যথারীতি কাজ শুরু করা হয়েছে। কিছুদিনের মধ্যেই এ কাজ সম্পন্ন হবে। পাশাপাশি সিলেট-বরিশাল প্রকল্পের আওতায় পানি শোধনাগার প্রকল্পের কাজ অত্যন্ত ধীর গতিতে চলছিল। এ ক্ষেত্রেও অর্থমন্ত্রীর সহায়তায় এবং ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় সহকর্মী কাউন্সিলরদের নিয়ে কাজটি তরান্বিত করতে পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। এ প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন হলে দৈনিক পানি সরবরাহ ২ কোটি ৮০ লক্ষ লিটার বৃদ্ধি পাবে। বর্তমানে সুরমা নদীর পানি শোধন করে সরবরাহ করা হয়। সারি নদীকে উৎস ধরে দৈনিক ৫ কোটি লিটার পানি সরবরাহের লক্ষ্যে ৩২১ কোটি টাকা ব্যয়সাপেক্ষ একটি নতুন প্রকল্প প্রণয়ন করেছি। প্রকল্পটি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর পর গত ২ জুলাই মন্ত্রণালয়ে এ সংক্রান্ত এক সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
আশা করছি প্রক্রিয়াধীন এ প্রকল্পের কাজও আমরা এ বছর শুরু করতে পারব। চলমান এ সব প্রকল্পের পাশাপাশি জরুরী ভিত্তিতে ৪০০০ লিটার ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন দু’টি পানিবাহী গাড়ী ক্রয় করা হয়েছে।