অখিল পোদ্দারের উপর হামলাকারী সেই এএসআই কালামের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা
সুরমা টাইমস ডেস্কঃ একুশে টেলিভিশনের বিশেষ প্রতিনিধি অখিল পোদ্দারকে নির্মম নির্যাতনের ঘটনায় ২৪ ঘন্টার মধ্যে মামলা নিতে হাইকোর্টের নির্দেশের পর অবশেষে মামলা নিয়েছে পুলিশ। ১২ সেপ্টেম্বর (শুক্রবার) কুষ্টিয়ার কুমারখালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা লুৎফর রহমান আলোচিত মামলাটি গ্রহন করেন। মামলার নম্বর ৮। গত ২৬ আগস্ট রাতে অখিল পোদ্দারের উপর পুলিশি হামলার পর কুষ্টিয়ার সকল স্তরের সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে মজিবুল শেখ মামলা করতে গেলে তা গ্রহণ করেনি কুমারখালী থানা। এরই প্রেক্ষিতে গেল রোববার হিউম্যান রাইটস এ্যন্ড পিচ ফর বাংলাদেশের চেয়ারম্যান এডভোকেট মনজিল মোরশেদ সাংবাদিকদের ন্যায়বিচার চেয়ে উচ্চ আদালতে রিট করেন। বিচারপতি মঈনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি আশরাফুল কামালের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ রিটের শুনানি শেষে ২৪ ঘন্টার মধ্যে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৫৪ ধারায় ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে দায়ী এএসআই আবুল কালাম আজাদের বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নেয়া হবে না এ মর্মে চার সপ্তাহের রুলও জারি করেন। মহামান্য হাইকোর্টে রিট পিটিশন নম্বর ৮১৭২/১৪। রিটের বিবাদীরা হলেন স্বরাষ্ট্র সচিব, পুলিশের আইজিপি, কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, কুমারখালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা লুৎফর রহমান ও নির্যাতনকারী সেই এএসআই আবুল কালাম আজাদ।
উল্লেখ্য মহামান্য হাইকোর্ট দোষী পুলিশের বিরুদ্ধে ২৪ ঘন্টার মধ্যে ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দিলেও এই ক’দিনে আদালতের কপি হাতে না পাবার কথা বলে মামলার নেয়ার ব্যাপারটি এড়িয়ে যান কুমারখালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। পরে মহামান্য আদালতের অবিকল নকল কপি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী, স্বরাষ্ট্র সচিব থেকে শুরু করে কুমারখালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বরাবর পাঠানো হলে শুক্রবার মামলাটি গ্রহণ করে সংশ্লিষ্ট থানা।
এ ব্যাপারে মহামান্য হাইকোর্টে রিটের আবেদকারী এডভোকেট মনজিল মোরশেদ বলেন, দেশের সাংবাদিক সমাজ আজ নানাভাবে আক্রান্ত। হত্যা, গুম ছাড়াও প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে নানাভাবে নির্যাতন ও নাজেহালের শিকার মহান পেশার সাংবাদিকরা। অখিল পোদ্দারের মতো প্রত্থিতযশা ও জনদুর্ভোগখ্যাত নন্দিত সাংবাদিক যিনি দিন-রাত গণমানুষের উপকারে নিবেদিতপ্রাণ, তাঁর উপর হামলার ঘটনায় মামলাটি তখনই গ্রহণ করা অবশ্যই উচিত ছিল পুলিশের। অখিল পোদ্দারের অনেক রিপোর্টে আইন শৃঙ্খলাবাহিনী নিজেও উপকৃত হয়েছে বহুবার। আমি মনে করি পুলিশ মামলাটি ঐদিন রাতে গ্রহণ না করার মানে রাষ্ট্রের একধরণের ব্যর্থতা। এ রকম ব্যর্থতা এর আগেও আমরা দেখেছি। অনেক সাংবাদিক নির্যাতিত হয়েছেন কিন্তু সুবিচার পাননি। যে কারণে নির্যাতিতদের পক্ষে হিউম্যান রাইটস এ্যন্ড পিচ ফর বাংলাদেশের হয়ে আমরা এগিয়ে এসেছি। যারা আইনশৃঙ্খলাবাহিনীতে আছেন তারা খুব ভালোভাবেই জানেন যে কেস করার অধিকার সবারই আছে। আর তারা তা গ্রহণ না করে রীতিমতো অন্যায় ও রাষ্ট্রবিরোধী কাজ করেছেন। ঘটনাটি ঐসময় সমস্ত টেলিভিশন চ্যানেল খবরের পাশাপাশি লাইভ সম্প্রচার করেছে। এমনকি অনলাইন পত্রিকা ও পরদিন জাতীয়-আন্ত—র্জাতিক মিডিয়ায় ফলাও করে প্রচার হয়েছে। এটি দেখে পুলিশের আইজিপি কিংবা এডিশনাল আইজিপি লোকাল থানার ওসিকে নির্দেশ দিয়ে মামলাটি করাতে পারতেন। কিন্তু তাঁরা সম্পূর্ণ গাফিলতি করেছে, যা খুবই দুঃখজনক। সাংবাদিক অখিল পোদ্দার দেশ-বিদেশে প্রবাসী বাঙালিদের নানান সমস্যার কথা তুলে ধরেন। প্রচার করেন অন্যায়, অবিচার, অত্যাচার ও বড় ধরণের সব ক্রিমিনালদের অনুসন্ধানী প্রতিবেদন। ঘটনার সময় পুলিশের ঐ সদস্য তাঁর পরিচয় পাওয়ার পরই হাতে হনন্ডকাপ পড়িয়ে অত্যাচার করেছে রাতের আঁধারে, নির্জন স্থানে। এ ধরণের নির্যাতন চার্জ ৩২৬ এবং এ্যাটেম টু মার্ডার ৩০৭ এর ক্রিমিনাল প্রসিডিউর প্যানেল কোড এই দুই ধারায় হওয়া উচিত।
উল্লেখ্য গত ২৬ আগস্ট কুষ্টিয়া থেকে খোকসায় গ্রামের বাড়ি ফেরার পথে কুমারখালীর বাটিকামারা রেলগেট সংলগ্ন নির্জন স্থানে অখিল পোদ্দার ও মোহনা টেলিভিশনের স্থানীয় প্রতিনিধি মনিরুল ইসলামকে বেধড়ক মারধোর করে কুমারখালী থানার ক্যাশিয়ার এএসআই কালাম। মনিরুল ইসলামের মোটরবাইকের কাগজ সঙ্গে না থাকায় প্রথমে তাকে মারধোর ও সাংবাদিকদের বাবা-মা তুলে গালমন্দ করলে তাঁর সঙ্গে থাকা অখিল পোদ্দার ঘটনার প্রতিবাদ করেন। পরে অখিলের পরিচয় পাবার পর তাঁকে হ্যান্ডকাপ লাগিয়ে বেধড়ক মারধোর করে। ঘটনা জানতে পেরে কুষ্টিয়ার সকল সাংবাদিক ও বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষেরা সম্মিলিতভাবে ঘটনার বিচার চেয়ে কুমারখালী থানা ঘেরাও করেন। পরে ঘটনাস্থলে কুষ্টিয়ার ডিসি, এসপি, এডিশনাল এসপিসহ উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এলে পরিস্থিতি শান্ত হয় এবং তাৎক্ষনিকভাবে এএসআই কালামকে ক্লোজ করে পুলিশ লাইনে পাঠানো হয়। নির্যাতনের পর অখিল পোদ্দারকে স্থানীয় হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হয়। অবস্থার অবনতি হলে সেখান থেকে তাঁকে স্থানান্তর করা হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সিটি স্ক্যান, এক্সরেসহ সবধরণের পরীক্ষার পর ঢাকা মেডিকেলের নিউরোসার্জাারি বিভাগের প্রফেসর ডা. অসিত চন্দ্র সরকার ও ডা. মনসুর আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, অখিল পোদ্দারের মাথায় একাধিক আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দুটি কান ও চোখ। কারণ এরইমধ্যে ডান কানের পর্দা ফেটে যাওয়ায় তিনি কানে কম শুনতে পাচ্ছেন। আর বাম কানের ভেতরের একটি হাড় সরে যাওয়ায় চারম ব্যথা অনুভব করছেন। আলাদা আলাদাভাবে বিশেষজ্ঞ চিকিৎকরা তাঁর দেখভাল করছেন। এদিকে গত ৪ সেপ্টেম্বর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অখিলকে দেখতে গিয়ে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, প্রয়োজনে মেডিকেল বোর্ড গঠন করে তাঁকে উন্নত চিকিৎসা করানোর জন্য বিদেশে পাঠানো হবে। ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করে দোষী এএসআই কালামকে ‘খবিশ’ ‘গন্ডমূর্খ’ ও লাফাঙ্গা আখ্যা দিয়ে বিচারের আশ্বাস দেন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী। একইভাবে অখিলকে দেখতে যান পুলিশের এডিশনাল আইজি এ কে এম শহিদুল হক, এআইজি জালাল আহমেদ, জনসংযোগ কর্মকর্তা কামরুল আহসানসহ পুলিশের বিভিন্ন দফতরের কর্মকর্তারা। আইন সালিস কেন্দ্রের পরিচালক নূর খান লিটনসহ মানবাধিকার সংগঠন ও সাংবাদিক নেতৃবৃন্দ ও বিভিন্ন সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের বিশিষ্টজনেরা তাঁর চিকিৎসার খোঁজখবর নেন। অখিল পোদ্দারের উপর হামলার ঘটনায় উদ্বেগ জানিয়ে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে একাধিকবার বিক্ষোভ সমাবেশ করেছে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি, ক্রাইম রিপোর্টার্স এসোসিয়েশন, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন, আমরা মুক্তিযোদ্ধার সন্তানসহ আরও অনেক সংগঠন। নিন্দার ঝড় উঠেছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। ঘটনার দ্রুত বিচার দাবি করে কুষ্টিয়ায় একাধিকবার বিক্ষোভ সমাবেশ, মানববন্ধন করেছে সাংবাদিক সমাজসহ বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ। বিক্ষোভ করেছে রাজবাড়ি, বগুড়া, বালিয়াকান্দি, নেত্রকোনা, গোপালগঞ্জ, নড়াইল, রাজবাড়ির পাংশা, কুষ্টিয়ার খোকসা, গাজীপুর, ময়মনসিংহ, মাদারীপুর, টঙ্গী, পঞ্চগড়, কুড়িগ্রাম, নীলফামারী, গাইবান্ধাসহ বিভিন্ন জেলা-উপজেলার সাংবাদিকদের সংগঠন। ঘটনার বিচার ও দোষী পুলিশের এএসআই আবুল কালামের বিচার না হওয়া পর্যন্ত সাংবাদিকদের এ বিক্ষোভ প্রতিবাদ সমাবেশ অব্যাহত থাকবে বলে সাংবাদিক নেতৃবৃন্দ জানান। উল্লেখ্য অখিল পোদ্দার দেশের সেরা রিপোর্টার হিসেবে প্রেস ইন্সটিটিউটের পিআইবি সোহেল-সামাদ পুরস্কার, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি পুরস্কার, মোনাজাত উদ্দিন স্মৃতি পুরস্কার, ইউনেস্কো পুরস্কারসহ দেশ-বিদেশের পুরস্কার ও ফেলোশিপ পেয়েছেন।