আমাদের গ্রাম্য সালিশী বিচার-একাল ও সেকাল
~নাজমুল ইসলাম মকবুল~
ট্রান্সপারেন্সী ইন্টারন্যাশন্যাল এর রিপোর্টমতে গত ক’বছর পূর্বে আমাদের বাংলাদেশ টানা পাঁচবার দূর্নীতিতে বিশ্বসেরা হবার ঈর্ষনীয় মহাগৌরব অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিল বহুবিধ কর্মতৎপরতার মাধ্যমে! গ্রীনেজ বুক অফ ওয়াল্ড রেকর্ড এর কর্তাব্যক্তিরা বাংলাদেশের পাঁচবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নের তকমাটি সেখানে প্রতিস্থাপন করেছেন কি না জানিনা। তবে আমি নালায়েকের প্রস্তাব হলো দেশতো কোন অপরাধ করার শক্তি রাখেনা, তাই দেশের নাম না লিখে যারা এজন্য দায়ী ও দূর্নীতির শীর্ষস্থান ছিনিয়ে আনতে এবং তা পরপর পাঁচবার অব্যাহতভাবে অক্ষুন্ন রাখার দায়িত্ব গৌরবের সাথে সুনিপুণভাবে পালন করে ঈর্ষনীয় খ্যাতি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন তাদের শানদার নামটি কুড়িয়ে এনে যতন করে সেখানে লিখে রাখাই বেহতর। আমরা সাধারণতঃ ঘুষ, দূর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতা, লুটপাট ও স্বজনপ্রীতির জন্য দায়ী করি সরকারী নিচতলার চৌকিদার বা কেরানী থেকে শুরু করে উর্ধ্বতন সচিব পর্য্যায়ের কর্তা ব্যক্তিদের। আবার কেহ কেহ মেম্বার চেয়ারম্যান থেকে শুরু করে রাজনৈতিক নেতা, পাতিনেতা ও এম.পি মন্ত্রীদের পর্যন্তও দায়ী করে থাকেন। কিন্তু আমাদের দেশের এককালের মহৎ গুণাবলীর অধিকারী ন্যায়ের প্রতিক সালিশ বিচারক গ্রাম্য মোড়লরাও বর্তমানে নাসির বিড়ি, চুরট, লাল চা, দুধ চা থেকে শুরু করে নগদ অর্থ উৎকোচ হিসেবে গ্রহণ করে উল্টা পাল্টা বিচার করেন এবং ন্যায়কে অন্যায় ও অন্যায়কে ন্যায়ে পরিণত করতে প্রায়ই দেখা যায়। এ বিষয়টা প্রায় সবারই জানা থাকলেও পত্র পত্রিকায় লেখালেখি হয় বিলকুল কম। তবে দূর্নীতির এ মহাপ্লাবনে হাতেগোনা কিছু লোক এখনও ন্যায় নিষ্ঠা ও সততা বজায় রেখে চলছেন নিতান্ত কষ্ট ও ত্যাগ স্বীকার করেও। আলোচ্য নিবন্ধে গ্রাম্য দূর্নীতিবাজ মোড়লদের মুখোশ কিছুটা হলেও উন্মোচন করার চেষ্টা করা হয়েছে এবং এর অতীত ঐতিহ্যের একটা সংক্ষিপ্ত রূপরেখা তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে।
গাঁও গেরামের বিচার সালিশ পঞ্চায়েত মুরব্বী মাতবর পাঁচগাঁও সাতগাঁও বিশগাঁও পরগনা পাড়া আমানত খেয়ানত মুচলেকা ইত্যাদি শব্দের সাথে আমাদের দেশের বিশেষ করে গ্রামবাংলার সকলেই কমবেশী পরিচিত। গ্রাম্য সালিশী বিচার ব্যবস্থা আমাদের পূর্ব পুরুষের আমলেও ছিল হাল আমলেও বহাল তবিয়তে আছে, তবে এর মডিফাই হয়েছে বিভিন্নভাবে। আগেকার গ্রাম্য সালিশী বিচার সাধারণতঃ সাদা দাঁড়িওয়ালা বয়স্ক মুরব্বীয়ানরা করতেন। যাদের ছেলে মেয়ে নাতি নাতনী আছে, তারা অনেকেই লাটি (ছড়ি) ভর করেই বিচারের আসরে যেতে দেখা যেত। বিচারের আসরে অত্যাবশ্যকীয় হিসেবে থাকতো বিভিন্ন ধরনের হুক্কা যেমন খাসি হুক্কা, নারিকেলের হুক্কা, চুরুট, বিড়ি, মিস্কার, সিগারেট প্রভৃতি। মোড়লরা আয়েশের সঙ্গে হুক্কায় গুড়–ম গুড়–ম টান দিতেন আর বিচার কার্য্য পরিচালনা তথা বাতচিৎ করতেন ভেবেচিন্তে। কথায় কথায় পই প্রবাদ ছিল্লক (প্রবাদ প্রবচন) তো বলতেনই কথা প্রসঙ্গে হাল ও পুরনো আমলের বিভিন্ন ধরনের উপমা এবং মিনি সাইজের পুরনো কিচ্ছা কাহিনীও উপস্থাপন করতেন অত্যন্ত রসালোভাবে। সে সব আচার বিচারে এখনকার মতো কম বয়সী ছাবাল (বাচ্ছা) মুরব্বীদের দাপট ও সুযোগ তেমন একটা ছিলনা এবং ঘুষের প্রচলনও তেমন ছিলনা বললেই চলে। তবে বিচার কার্য্যে যথেষ্ট সততা ছিল, তাই মানুষ অধিকাংশ ক্ষেত্রে ন্যায় বিচার পেত। অধিকন্তু বয়স্ক বিচারকদের মনে এচিন্তা বদ্ধমূল ছিল যে ‘এক পাও গাতো (কবরে) আর এক পাও গাতর পারো’ দাঁড়ি গোফ সাদা হয়ে যাওয়ায় বুড়ো বয়সে বে-ইনসাফী করলে আল্লাহর কাছে পরপারে আটকে পড়তে হবে। তবে যদ্দুর শোনা যায় তৎকালে কোন কোন এলাকায় সবাই চেয়ারে বসতে পারতেন না। বংশের একটা রেওয়াজ ছিল প্রকট। যিনি উচ্চ বংশের লোক ছিলেন, তিনি চেয়ারে বসতেন, আবার তথাকথিত নিম্ন বংশের লোক স্তর অনুযায়ী বেঞ্চে, খাটে, চাটাইয়ে এমনকি মাটিতেও বসতে হতো। তখনকার সময়ে ধনী তথা জমিদারদের দাপট ছিল বেশি। যার বংশ যত বড় তথা যার লাটি যত গরম তার কথা বেশি প্রাধান্য পেত এবং এধরনের প্রভাবশালী ব্যক্তিরা বিচারে না আসলে বিচারকার্য্য ব্যাহত হত বা আটকে থাকত। বছর কয়েক পূর্বে বি-বাড়িয়ার মফস্বল এলাকায় দেখলাম এক গ্রাম্য সালিশী বিচার চলছে। সেখানে কেহ চেয়ারে, কেহ বেঞ্চে আবার কেহবা মাটিতে বসে আছেন এবং মাটিতে অনেক বয়বৃদ্ধ লোকও বসে আছেন। ভাবলাম সেসব এলাকায় হয়ত আগেকার মতো বংশ এবং টাকার স্তর হয়তোবা এখনও বহাল আছে। তবে আগেকার সালিশী বিচারকার্য্য যারা পরিচালনা করতেন তাদের কথার মূল্য ও ওজন ছিল। এখানে এক কথা আবার ওখানে আরেক কথা বলতেন না। কারো মুখের দিকে চেয়েও কথা বলতেননা। এক কাপ চা বা এক খিলি পান খেয়ে বিক্রি হয়ে যেতেননা। দাওয়াত দিয়ে আসলেই নির্দিষ্ট সময়েই চলে আসতেন বিচারের আসরে।। বার বার গিয়ে তৈল মর্দন ও তোষামোদ করতে হতোনা।
বর্তমান গ্রাম্য সালিশী বিচার কার্য্য আগের তুলনায় অনেকটা ভিন্নরূপ ধারন করেছে এবং মারামারিও আগের তুলনায় যথেষ্ট পরিমানে হ্রাস পেয়েছে বলে জানা যায়। তবে ব্যক্তিগত বা বংশগত মারামারি হ্রাস পেলেও রাজনৈতিক হানাহানি বৃদ্ধি পেয়েছে। আর রাজনৈতিক হানাহানির বিচার সাধারণত গ্রাম্য সালিশের মাধ্যমে সমাধান দেয়া মুশকিল বরং তা আদালতেই বেশি গড়াতে দেখা যায়।
হাল জমানার বিচারক বা মুরব্বীদের সিংহভাগের মধ্যে দুরবীণ দিয়ে সততা খুজে পাওয়া মুশকিল হলেও আগের মতো সৎ বিচারক অত্যান্ত স্বল্প সংখ্যক হলেও আছেন এবং হক কথা বলেই যাচ্ছেন। তবে ভেজালের ভীড়ে তারা নিতান্ত কোনটাসা বলেই মনে হয়।
বিচার আচার সংগঠিত হওয়ার পেছনে দুপক্ষের বিরোধ ঝগড়া বা মারামারির সম্পর্ক থাকতেই হয়। যেমন কারো জমিতে অন্যের গরু, ছাগল ধান বা সবজি খেয়ে সাবাড় করলো, কারো জমির আইল কেটে দেয়া হলো, কারো স্ত্রীকে তালাক দেয়া বা স্বামী স্ত্রীর ঝগড়াঝাটি, কারো কোন কিছু চুরি হওয়া বা জোর করে নিয়ে যাওয়া অথবা পাড়ার মসজিদে ইমামসাহেব বা মুয়াজ্জিন সাহেব নিয়ে দাবার গুটি খেলা, এলাকায় বিভিন্ন ক্ষেত্রে আধিপত্য বিস্তার, রাজনৈতিক বা সামাজিক প্রতিহিংসা ইত্যাদি নানা বিষয় ও ইস্যূ নিয়ে প্রায় সময়ই শুরু হয় মারামারি, লাটালাটি, ঠেলাঠেলি, ধাক্কাধাক্কি, লাটি টানাটানি, ডাকাডাকি, লুঙ্গী উপরে তুলে বা কাছা দিয়ে (পেছকুন্দা মেরে) গালিগালাজ ইত্যাদি। পরক্ষনে হাক ডাক চিল্লা চিল্লি শুনে অথবা সংঘর্ষের খবর পেয়ে মুরব্বীরা (যারা এলাকায় সালিশী বিচারকার্য্য করেন) উপস্থিত হয়ে উভয় পক্ষকে বিচারে বসতে রাজী করান। যখন উভয় পক্ষ বিচারে বসতে রাজী হন তখন তাদেরকে নির্দিষ্ট অংকের টাকা জামানত দিতে হয় নির্দিষ্ট এক মুরব্বীর কাছে। সংঘর্ষ বা কাইজ্যা যত বড় ধরনের হয় জামানতের টাকার অংকও ততো বেশি নির্ধারন করা হয়। তখন জামানতদার (সিলেটের আঞ্চলিক ভাষায় আমানতদার) নিয়োগ করা হয় একজনকে। তাঁর কাছে বিচারের নির্ধারিত সময়ের পূর্বেই ধার্য্যকৃত টাকাগুলো জমা দিতে হয় এবং তাঁকেই সাধারনত হাউসের সভাপতি নিয়োগ করা হয়। জামানত নেয়ার উদ্দেশ্য হলো উভয় পক্ষকে বাউন্ড করা যাতে ওরা মুরব্বীদের রায় মেনে নিতে বাধ্য হয় এবং তাদের কব্জা থেকে ছুটে যেতে না পারে। এরপর সময় সুযোগমতো উভয় পক্ষকেই মোড়লদের বাড়ী বাড়ী বার বার ধর্না দিয়ে তৈল মর্দন করতে হয়। পঞ্চাইতের লোকদের বাড়ী বাড়ী গিয়ে বার বার ইনিয়ে বিনিয়ে দাওয়াত দিতে হয়। তবে টাকার জোর ও লাটি গরম হলে ভিন্ন কথা। যে সকল মুরব্বীদের সাথে খাতির আছে তাদের সাথে আরও ভালভাবে খাতিরানা ঝালাই করে বুদ্ধি শুদ্ধি নিতে হয়, মিল মহব্বত আরও বাড়াতে হয়, টাকা-টুকা পাওনা থাকলে চাওয়া থেকে বিরত থাকতে হয়। তবে এখনকার সালিশী বিচারে কম বয়সী ছাবাল বা বাচ্চা মুরব্বীরাই বেশি সক্রিয়। আগের মতো বয়স্কদের তেমন একটা প্রাধান্য নেই। যে কোন পক্ষই পরামর্শের জন্য মোড়লদের কাছে গেলে তাকে একটা না একটা বুদ্ধি বাতলিয়ে দেয়া হয়, যাকে বলে “কেউ ফিরেনা খালি হাতে’’। সামনাসামনি হক কথা নিতান্ত কমই বলা হয়, কারণ ‘‘গরম ভাতে বিলাই বেজার’’ বলে কথা। অনেকেই নগদ টাকা, কেহবা এক কাপ চা, আবার কোন কোন মোড়লকে বাজারে বড় মাছ খরিদ করে দিয়ে নিজের পক্ষে টানতে দেখা যায়। সিংহভাগ বিচারকই “চোরকে বলেন চুরি কর, আর গৃহস্থকে বলেন সজাগ থাক’’। অন্যভাবে বলতে গেলে “দিনে দেন বাধা, রাতে নেন চাঁদা, সকালে উঠে বলেন প্যচ লাগানো কথা’’। কারণ পকেটে মাল ঢুকলে এগুলাতো কোন এক উপায়ে হালাল করতে হয়। গ্রাম্য বিচারের মাধ্যমে টু-পাইস কামানো বর্তমানে এক রকম রসম-রেওয়াজে পরিণত হয়ে গেছে। কোন কোন বিচারকরা এ অপেক্ষায় বা এ প্রচেষ্টায় থাকেন, যেকোনভাবে একটা ঝগড়া বিবাধের মাধ্যমে একটা বিচার কিভাবে দাঁড় করানো যায়। কেহবা ঝগড়া বিবাধ সৃষ্টি করতে নেপথ্যে কলকাঠি নাড়তেও কসুর করেননা এবং এটা কারো কারো নেশা ও পেশাও বঠে। অনেকেই বিচারের দাওয়াত পাওয়ার অপেক্ষায় অপেক্ষমান থাকেন দারুন আগ্রহভরে। কারণ প্রচুর সম্মানতো পাওয়া যাবে, সাথে চা-বিস্কিট, সিগারেট বা নাসির বিড়ি ইত্যাদি ভাগ্যে জুটবে বিনা মেহনতে। সুবিধে করতে পারলে ঘুষ অর্থাৎ “ঘাটে কালারুকায় মিলাইয়া’’ হাছা মিছা কথা বলতে পারলে সময়মতো কিছু মায়নাও পাওয়া যাবে।
প্রবাদ আছে ‘‘কথার আছে শতেক বাণী, যদি কথা কইতে জানি’’। বিচার বৈঠকের নির্দিষ্ট সময় যদি থাকে সন্ধ্যা সাতটা তবে আরম্ভ হবে রাত দশ-এগারোটায়। কারণ বাঙালী টাইম। তাছাড়া মোড়লদের কদর ওই সময় হয়ে যায় আকাশচুম্বী। বার বার বাড়িতে গিয়ে দাওয়াততো দিতেই হবে এবং সময়মতো তাকে বাড়িতে গিয়ে ইস্তেকবাল দিয়ে নিয়ে আসতে হবে গাড়ি বা রিকসা দিয়ে। মোবাইল ফোনে রাখতে হবে ঘন ঘন যোগাযোগ। যিনি যত বিলম্বে আসবেন তাঁর দাম ও যশ ততো বেশী, তিনি ততো বড়ো মোড়ল বলেই যেন মনে করেন নিজেকে।
বিভিন্ন গল্প, গুজব, রাজনৈতিক, সামাজিক আলাপ-আলোচনা, সমালোচনা শেষে সবাই বিচারের আসরে চলে আসার পর নির্দিষ্ট সময়ের কয়েক ঘন্টা পর পূর্বনির্ধারিত জায়গায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বিবাদীর বা তৃতীয় কারো বাড়ীর টংগী ঘরে কিংবা সুবিধাজনক স্থানে শুরু হয় কাঙ্খিত বিচারকার্য। উভয় পক্ষের জবানবন্ধী গভীর মনোযোগের সাথে শোনা হয় প্রথমে। নির্দিষ্ট সময়ে সায় স্বাক্ষীদেরও জবানবন্দি নেয়া হয় এবং ক্ষেত্রবিশেষে পক্ষ বা স্বাক্ষীদেরকে বিভিন্ন ভংগীমায় জেরা করা হয়। পূর্ব থেকেই যার টাকা ও লাটি গরম আধিপত্য বা প্রতিপত্তি বেশি তার পক্ষে থাকেন বেশির ভাগ মোড়ল। ন্যায়কে অন্যায় আর অন্যায়কে ন্যায় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে ওদিকেই নজর দেয়া হয় গভীরভাবে ‘‘জিলাপীর প্যচ’’ খ্যাত কুটবুদ্ধির মাধ্যমে। কিন্তু উভয় পক্ষ সমান সমান হলে যার যার খাতিরের মুরব্বী তাদের পক্ষাবলম্বন করে শুরু হয় বক্তব্য, পাল্টা বক্তব্য, বাক বিতন্ডা, অনেকটা আদালতের উকিলদের মতো। আদালতে উকিলরা কথা বলেন হাকিমের অনুমতিক্রমে আর সেখানে সমবেত লোকজন কথা বলেন পূর্বনির্ধারিত সভাপতির অনুমতিক্রমে। মাঝে মধ্যে ব্যতিক্রমও ঘটে এবং কোন কোন ক্ষেত্রে বিচারের আসরেই এলোমেলো কথা কাটাকাটির এক পর্য্যায়ে ডাকাডাকি, হাতাহাতি, ধাক্কাধাক্কি, কুস্তি, ভয়বহ সংঘর্ষ বা বিচার ভন্ডুল হতেও দেখা যায়। আবার কোন কোন ক্ষেত্রে পাল্টা তারিখ পড়ে। এভাবে বিভিন্ন তারিখে তারিখে মুরব্বীদের কাছে গিয়ে ধর্না দিতে হয় আর খাটি সরিষার তৈল বা গাওয়া ঘি মালিশতো আছেই। কেহ কেহ লম্বা তারিখের সুযোগে জমাকৃত টাকাগুলা বিনিয়োগ করেন ব্যবসা বাণিজ্য বা অন্য কোন খাতে। এদিকে বাদী-বিবাদী ওইসব বিচারকদের দ্বারে দ্বারে হাটতে হাটতে পরান শেষ। স্যান্ডেলের তলার বেশির ভাগ ক্ষয়ও হয়। প্রায় ক্ষেত্রে মসজিদ সংক্রান্ত বিষয় বা মসজিদের ইমাম মুয়াজ্জিন নিয়ে গ্রাম্য কোন্দল হতে দেখা যায়। আমাদের মসজিদের সাবেক এক ইমাম সাহেব বলতেন “যার নাই কোন গতি তার কাজ ইমামতি’’। অথচ ‘ইমাম’ শব্দটি আরবী। যার অর্থ হচ্ছে সাঈয়িদ, ছরদার বা নেতা (সম্মানিত ব্যক্তি)। যার নেতৃত্বে তথা যার পথনির্দেশনায় ও পরামর্শমতে ওই গ্রাম বা পাড়ার লোকজন পরিচালিত হবেন তাকেই ইমাম বলা যায়। কিন্তু অধিকাংশ মসজিদের ইমামগণ গ্রামের প্রত্যেকটি মানুষকে উল্টো নেতা বা বস না মানলে বা তোষামোদ না করলে এবং তাদের কথায় জি হুজুর! জি হুজুর না বললে ইমামতি টুটে যাবে হুট করে। একজন চাইবে ইমাম বিদায় করতে, আরেকজন চাইবে রাখতে। তখন শুরু হয় আধিপত্যের লড়াই। রাতের আধারে গণসংযোগ শলাপরামর্শ ও দল ভারি করা। অনেক ক্ষেত্রে এধরনের মারামারির মাধ্যমে বিচার পাড়া বা গ্রাম পঞ্চায়েত থেকে বহিস্কার (পঞ্চায়েতের বাদ), পাঁচর বাদ, পল্টা মসজিদ নির্মাণ, দাঙ্গা হাঙ্গামা, হাজর মাইর, প্রতিপক্ষকে গায়েল করার নানা ফন্দি ফিকির ইত্যাদি ঘটতে শুনা যায়। শেষ পর্য্যায়ে তিনগাঁও, পাঁচগাঁও, সাত গাঁয়ের বিচার হয়।
আমাদের দেশে বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে যে সকল মসজিদে ইমাম সাহেবরা ইমামতি করেন তারা বড় অসহায়। সামান্যতম ভাতা পেয়েই চলতে হয়, আবার খতম-টতমের দাওয়াত ঠিকমতো পেতে হলে সবার সাথে সু-সম্পর্ক রাখতে হয় হেকমতের সাথে। কেরামতি না জানলে কোন সময় যে ইমামতি যায় তার কোন হদিস নেই। প্রায় গ্রামেই কিছু সংখ্যক বেকার ক্রিমিনাল থাকে যারা কোন একটি সংঘর্ষ বাঁধাতে পারলেই বেজায় খুশি। তাদের কদর বাড়বে, লোকজন তাদের কাছে বারংবার ধর্না দেবে এবং সেইফাকে পকেটাটাও গরম করা যাবে।
গ্রাম্য সালিশী বিচার ব্যবস্থায় কোন কোন ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমও আছে। কারণ আপোষ নিস্পত্তিতে যে কোন সমস্যার সমাধান করতে পারলে উভয় পক্ষেরই কল্যাণ হয়। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় আদালতে গিয়ে লাখ লাখ টাকা খরচ করেও কোন সুরাহা তো হয়ই না বরং ঘাটে ঘাটে চেলা চামুন্ডাদের পকেট ভরতে ভরতে নিরুপায় হয়ে গ্রাম্য সালিশের মাধ্যমে আপোষ মিমাংসার মাধ্যমে উভয় পক্ষই সস্তি পেয়ে ঘরে ফিরেন। এক্ষেত্রে এখনও কিছু কিছু সৎ খোদাভীরু এবং যোগ্য বিচারক আছেন, তবে তাদের সংখ্যা নিতান্ত অল্প। তাইতো দেখা যায় এখনও পাহাড় সমান সমস্যা দু একজন সৎ লোকের সততা ও বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমেই দ্রুত নিস্পত্তি হয় এবং এলাকায় শান্তি ও সৌহার্দ ফিরে আসে। তখন সুযোগ সন্ধানী চামচারা মুখ কালো করে অন্তরজ্বালায় পুড়তে থাকে এবং বিরোধ নিস্পত্তিকারী ব্যক্তিকে মনে মনে ভৎসনা করতে থাকে। দিন দিন বিচার আচারে সততা বিলুপ্ত ও আমানতের ব্যাপক খেয়ানত হওয়ায় আমাদের দেশে প্রায়ই গ্রামে গঞ্জে পাড়ায় মহল্লায় মারাত্মক কোন্দল দেখা দেয়। যদ্দরুন অপরাধীরা আস্কারা পেয়ে যায়। এজন্য সমাজে চুরি ডাকাতি ছিনতাই রাহাজানি হাইজ্যাক চাঁদাবাজি ধর্ষন এসিড নিক্ষেপ ইভটিজিং হত্যা লুন্টন গুম মারামারি ইত্যাদি দিন দিন বেড়েই চলেছে। থানায় মামলা রুজু করতে টাকার খেলা তথা প্রশাসনের অধিকাংশ স্তরে তথা ‘‘টপ টু বটম’’ পর্যন্ত ঘুষ দূর্নীতির ধ্বংসাত্মক প্রচলন থাকায় এমনকি রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা দালালীর পেশায় নিয়োজিত থাকার সুবাধে আমরা পরপর পাঁচবার দূর্নীতিতে গোটা বিশ্বকে টপকে এক নম্বরের ট্রপিটা ছিনিয়ে আনতে সামান্যতম বেগ পেতে হয়নি। দুঃখজনক হলেও সত্য যে দেশের অধিকাংশ মানুষ বিভিন্ন ক্ষেত্রে জালিমের জুলুম থেকে বাঁচতে পারছেনা এবং পাচ্ছেনা ন্যায় বিচার তথা উপযুক্ত ও সঠিক বিচার। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে সর্বক্ষেত্রেই সৎ ও গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিদের মাধ্যমে বিচারকার্য পরিচালনা করতে হবে। বিচারকের মনে রাখতে হবে আল্লাহভীতি। পরকালে সকল কৃতকর্মের জন্য আল্লাহর কাছে অবশ্যই জবাবদিহি করার প্রয়োজন হবে, একথা সব সময়ই স্মরণ রাখা অত্যন্ত জরুরী।
লেখকঃ প্রতিষ্টাতা সভাপতি, সিলেট লেখক ফোরাম।
Email: [email protected]
মোবাইল নং ০১৭১৮৫০৮১২২