পাঠ্য বইয়ে সিলেটের দুই কিংবদন্তি

রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পেলেন শাহ আব্দুল করিম ও কবি দিলওয়ার

Delowar-and-Karimঅহী আলম রেজাঃ আবারো প্রতিভার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পেলেন সিলেটের দুই কিংবদন্তী শাহ আব্দুল করিম ও কবি দিলওয়ার। মাধ্যমিকের বাংলা পাঠ্য বইয়ে এবার স্থান পেয়েছে দু’জনের কবিতা। শাহ আব্দুল করিমের বিখ্যাত গান- আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম ও কবি দিলওয়ারের ‘রক্তে আমার অনাদি অস্থি ’ কবিতা। দীর্ঘ ১৭ বছর পর বাংলা পাঠ্য বইয়ে এই প্রথমবারের মতো স্থান পেয়েছেন আনিসুজ্জামান, মুহম্মদ জাফর ইকবাল, আবু হেনা মোস্তফা কামাল, শহীদ কাদরী ও মহাদেব সাহা। বইটিতে রয়েছে বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্বজীবনী থেকে নেওয়া ‘বায়ান্নর দিনগুলো’। এছাড়া সহপাঠ হিসেবে রয়েছে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ’র বিখ্যাত ‘লালসালু’ উপন্যাস। গতকাল সোমবারই বইটি বাজারে এসেছে।

একুশে পদকপ্রাপ্ত বাউলসম্রাট শাহ আব্দুল করিম ও কবি দিলওয়ার’র সৃষ্টিকর্ম পাঠ্যবইয়ে স্থান দেওয়ার জন্য সিলেটসহ সারা দেশে সভা সেমিনারের মাধ্যমে দাবি জানানো হলেও জীবিত অবস্থায় এ স্বীকৃতি দেখে যেথে পারেননি তারা। তারপরও সিলেটের সকল মহলের পক্ষ থেকে সরকারকে অভিনন্দন জানানো হয়েছে। বাউল গানের কিংবদন্তী শাহ আবদুল করিম ১৯১৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি সুনামগঞ্জের দিরাই থানার উজানধল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। দারিদ্র ও জীবন সংগ্রামের মাঝে বড় হওয়া বাউল শাহ আবদুল করিমের সঙ্গীত সাধনার শুরু ছেলেবেলা থেকেই।
ভাটি অঞ্চলের মানুষের জীবনের সুখ প্রেম-ভালোবাসার পাশাপাশি তার গান কথা বলে সকল অন্যায় ,অবিচার, কুসংস্কার আর সাম্প্রদায়িকতার বিরূদ্ধে। তিনি তাঁর গানের অনুপ্রেরনা পেয়েছেন ফকির লালন শাহ, পুঞ্জু শাহ এবং দুদ্দু শাহ এর দর্শন থেকে।
বাউল শাহ আবদুল করিমের এ পর্যন্ত ৬টি গানের বই প্রকাশিত হয়েছে । বইগুলো হলো- আফতাব সংগীত, গণ সংগীত, কালনীর ঢেউ, ভাটির চিঠি, কালনীর কূলে এবং ধলমেলা।  বাউল শাহ আব্দুল করিম ২০০১ সালে একুশে পদক লাভ করেন। বাংলা একাডেমি তাঁর দশটি গানের ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশ করে। ২০০৯ সালের ১২ সেপ্টেম্বর বাউল সম্রাট শাহ আবদুল করিম মৃত্যু বরণ করেন।
বাংলা কবিতার বরপুত্র কবি দিলওয়ার। সাহিত্যের সকল শাখায় তিনি বিচরণ করেছেন। কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ প্রভৃতি ক্ষেত্রে ছিল তাঁর অসাধারণ পান্ডিত্য। দেশের সাহিত্যিকদের মধ্যে অন্যতম এ কবি সিলেটে অবস্থান করেও দেশ ও দেশের মানুষের কল্যাণে অবিরত লিখে গেছেন। সিলেট শহরের পাশ দিয়ে প্রবাহমান সুরমার তীরে হেঁটে আর সুরমার বুকে সাঁতার কেটে বেড়ে উঠেছেন কবি দিলওয়ার। সুরমা তাঁর শৈশবের নদী। সুরমা তাঁর খেলার সাথী। খেলার সাথী সুরমার সাথে তিনি পেয়েছেন জন্মস্থান ভার্থখলা গ্রামের অবাধ প্রকৃতি। প্রকৃতিকে তিনি খুব ভালবাসেন।
গণমানুষের কবি দিলওয়ার-এর ‘পদ্মা-মেঘনা সুরমা যমুনা গঙ্গা কর্ণফুলী, তোমাদের বুকের আমি নিরবধি গণমানবের তুলি’ এই শাশ্বত উচ্চারণের মাধ্যমে সিলেটের প্রাণ ইতিহাস-ঐতিহ্যের অন্যতম সাক্ষী লর্ডক্বীন কর্তৃক নির্মিত ক্বীনব্রীজকে নিয়ে লেখা তার কবিতা ‘ক্বীনব্রীজের সূর্যোদয়’ এবং তাঁরই লেখা ‘তুমি রহমতের নদীয়া’ গানটি সারাদেশে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলো যা আজো বহমান।
সিলেট জেলার সুরমা নদীর দক্ষিণ পারে ভার্থখলা গ্রামে একটি রক্ষণশীল পরিবারে ১৯৩৭ সালের ১ জানুয়ারী কবি দিলওয়ার জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৬৭ সালে তিনি দৈনিক সংবাদ-এর সহকারী সম্পাদক হিসাবে যোগদান করেন।
সেখানে দু’বছর কাজ করার পর ফিরে আসেন সিলেটে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি চলে যান ঢাকায়। ১৯৭৩-৭৪ সালে দৈনিক গণকন্ঠের সহকারী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৪ সালে তিনি ঢাকাস্থ রুশ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র থেকে প্রকাশিত মাসিক উদয়ন পত্রিকার সিনিয়র অনুবাদক হিসেবে প্রায় দুই মাসের মতো কাজ করেন।
কবি দিলওয়ার’র কাব্যগ্রন্থগুলো হলো- ঐক্যতান, পুবাল হাওয়া ,উদ্ভিন্ন উলস্নাস, স্বনিষ্ঠ সনেট, রক্তে আমর অনাদি অস্থি, নির্বাচিত কবিতা। ২০০৮ সালে তাঁকে একুশে পদক প্রদান করা হয়। ২০১৩ সালের ১০ অক্টোবর তিনি মৃত্যুবরন করেন।
এ ব্যাপারে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক, কবি জফির সেতু বলেন, একজন কবির জন্য রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি খুব জরুরি নয়। পাঠকের স্বীকৃতিই তাঁদের কাছে প্রধান হয়ে ওঠে। শাহ আব্দুল করিম ও কবি দিলওয়ার’র সৃষ্টিকর্ম বাংলা সাহিত্যের জন্য অমূল্য সম্পদ। তারপরও উচ্চমাধ্যমিকের পাঠ্যপুস্তককে তাঁদের কবিতা স্থান পাওয়ায় নতুন প্রজš§ শাহ আব্দুল করিম ও কবি দিলওয়ার সম্পর্কে জানার সুযোগ পাবে।
শাহ আবদুল করিম গবেষক ও প্রাবন্ধিক সুমনকুমার দাশ বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরেই প্রয়াত বাউলসম্রাট শাহ আবদুল করিম ও কবি দিলওয়ারের রচনা পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্তের দাবি ছিল তাঁদের অনুরাগীর-পাঠক-শুভানুধ্যায়ীদের।তাঁদের রচনা পাঠ্যবইয়ে স্থান পাওয়াটা আনন্দের ঘটনা বটে। যদিও কবি-সাহিত্যিকদের অঞ্চল বিশেষে বিবেচনা করার কোনো সুযোগ নেইÑসেটি মাথায় রেখেই বলছি, সিলেটের প্রখ্যাত এই দুইজনের রচনা পাঠ্যপুস্তকে স্থান পাওয়ায় আমরা উচ্ছ্বসিত এবং আনন্দিত।