এবার অনলাইন গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণে নীতিমালা
সুরমা টাইমস ডেস্কঃ টেলিভিশন ও রেডিও নিয়ন্ত্রণে জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালার বিতর্ক যেতে না যেতেই সরকার নজর দিয়েছে ক্রমবর্ধমান অনলাইন গণমাধ্যমের দিকে। জানা গেছে, সম্প্রচার নীতিমালার সঙ্গে মিল রেখে অনলাইন গণমাধ্যমের জন্যও বেশ কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করতে যাচ্ছে সরকার।
অনলাইন গণমাধ্যমের জন্য তৈরি খসড়া নীতিমালাতেও সশস্ত্র বাহিনী এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত কোনো বাহিনীর প্রতি কটাক্ষ বা অবমাননাকর তথ্যের প্রচার নিষিদ্ধ হচ্ছে। অপরাধীদের দণ্ড দিতে পারেন এমন সরকারি কর্মকর্তাদের ভাবমূর্তি বিনষ্ট করার মতো তথ্য-উপাত্তও প্রকাশ করা যাবে না। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে কোনো বিদ্রোহ, নৈরাজ্য এবং হিংসাত্মক ঘটনা প্রদর্শন করে এমন তথ্য-উপাত্ত প্রচার করা যাবে না।
এ রকম বিভিন্ন ধরনের বিধিনিষেধ আরোপ করে ‘জাতীয় অনলাইন গণমাধ্যম নীতিমালা-২০১৪’-এর খসড়া তৈরি করা হয়েছে। যার আওতায় প্রতিটি অনলাইন মাধ্যমকে সরকারের কাছ থেকে লাইসেন্স নিতে হবে।
আর সম্প্রচার নীতিমালার আদলে অনলাইন গণমাধ্যমের কার্যক্রম দেখভালের জন্যও একটি কমিশন গঠন করার কথা খসড়ায় বলা হয়েছে। তবে সম্প্রচার নীতিমালার মতো এখানেও শাস্তির ক্ষমতা রাখা হয়েছে সরকারের হাতে। এই কমিশনও কত দিনের মধ্যে হবে, তার সুনির্দিষ্ট সময় উল্লেখ নেই।
একই সঙ্গে এই নীতিমালায় বলা হয়েছে, রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে এমন ধরনের সামরিক বা সরকারি গোপন তথ্য ফাঁস করা যাবে না। কোনো ব্যক্তির ব্যক্তিগত গোপনীয়তা বা মর্যাদাহানিকর তথ্যও প্রচার করা যাবে না। অসংগতিপূর্ণ ও বিভ্রান্তিমূলক তথ্য বা উপাত্ত প্রচার বা প্রকাশ করা যাবে না।
অনলাইন গণমাধ্যম নীতিমালার খসড়ায় সরকার অনুমোদিত জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানের তথ্য-উপাত্ত প্রচারের বাধ্যবাধকতা আরোপ করারও প্রস্তাব রাখা হয়েছে। তথ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সম্প্রচার নীতিমালা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হওয়ায় এ নিয়ে কিছুটা ধীর গতিতে চলছেন তারা। তবে শিগগিরই সভা করে পরবর্তী কার্যক্রম শুরু করা হবে।
এ বিষয়ে তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেছেন, খসড়া জমা দেওয়া হয়েছে। তবে কী আছে তা এখনো দেখিনি। এ নিয়ে কমিটি গঠন করে দেওয়া হয়েছে। তারাই সব দেখভাল করছে।
তথ্য মন্ত্রণালয়ের সূত্রমতে, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার গঠনের পরে এই উদ্যোগটি শুরু হয়েছিল। তখন একটি প্রাথমিক খসড়া হলেও সেটি বাতিল করে প্রধান তথ্য কর্মকর্তার নেতৃত্বে ১৩ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। খসড়া প্রণয়নের জন্য আবার তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ মোস্তাফা জব্বারের নেতৃত্বে একটি উপকমিটি গঠন করা হয়। সেই উপকমিটি আলাপ-আলোচনা করে খসড়াটি করেছে। সেটি সম্প্রতি মূল কমিটির সদস্যদের কাছেও দেওয়া হয়েছে।
তবে মূল কমিটির প্রধান ও প্রধান তথ্য কর্মকর্তা তছির আহমেদ বলেন, আনুষ্ঠানিকভাবে তারা এখনো খসড়াটি পাননি। তিনি বলেন, নীতিমালা অনুযায়ী সব অনলাইন গণমাধ্যমকে সরকারের কাছ থেকে লাইসেন্স নিতে ফি দিতে হবে। অবশ্য এই ফির পরিমাণ বেশি নয়।
তছির আহমেদ জানান, বিদ্যমান অনলাইন গণমাধ্যমগুলো শর্ত পূরণ সাপেক্ষে লাইসেন্সে পাবে। লাইসেন্স পাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারি বিজ্ঞাপনসহ সরকারের সব সুযোগ-সুবিধা পাবে।
সূত্র জানায়, খসড়া অনুযায়ী মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ, চেতনা, রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি এবং বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় আদর্শ ও নীতিমালা সমুন্নত রাখতে হবে। সব প্রকারের তথ্য-উপাত্তে উভয় পক্ষের যুক্তিগুলো যথাযথভাবে উপস্থাপনের সুযোগ থাকতে হবে। কোনো বিদেশি রাষ্ট্রের অনুকূলে এমন ধরনের প্রচারণা যা বাংলাদেশ ও সংশ্লিষ্ট দেশের মধ্যে বিরোধের কোনো একটি বিষয়কে প্রভাবিত করতে পারে কিংবা বন্ধুভাবাপন্ন বিদেশি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে এমন ধরনের প্রচারণা যার ফলে সেই রাষ্ট্র ও বাংলাদেশের মধ্যে সুসম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হতে পারে এমন তথ্য-উপাত্ত প্রচার ও প্রকাশ করা যাবে না।
সব ধর্মীয় অনুভূতির প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতে হবে। উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড বিশেষ করে স্বেচ্ছাভিত্তিক কাজের উদ্বুদ্ধকরণ এবং এই লক্ষ্য বাস্তবায়নে তথ্য-উপাত্ত প্রচারে যথাসমম্ভব সচিত্র প্রতিবেদন উপস্থাপন করতে হবে। কৃষি ও শিল্পক্ষেত্রে উৎপাদন বৃদ্ধি এবং দেশকে স্বনির্ভর করে গড়ে তোলার আন্দোলনে জনসাধারণকে অনুপ্রাণিত করতে হবে।
অনলাইন গণমাধ্যমে শিশু বা নারীর প্রতি সহিংসতা, অসমূলক আচরণ বা হয়রানিমূলক কর্মকাণ্ডকে উদ্বুদ্ধ করে এমন অনুষ্ঠান প্রচার করা যাবে না। অপরাধীদের কার্যকলাপের কৌশল প্রদর্শন করা যাবে না। প্রত্যেক অনলাইন গণমাধ্যমের সুনির্দিষ্ট কর্তব্য ও সম্পাদকীয় নীতিমালা থাকতে হবে।
জাতীয় আদর্শ বা উদ্দেশ্যের প্রতি কোনো প্রকার ব্যঙ্গ বা বিদ্রূপ, বাংলাদেশের জনগণের প্রতি অবমাননা বা ব্যঙ্গ কিংবা বাংলাদেশের জনগণের জাতীয় চরিত্রের প্রতি কটাক্ষ বা স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অখণ্ডতা বা সংহতি ক্ষুণ্ন হতে পারে এমন তথ্য-উপাত্ত প্রচার করা যাবে না।
বিচ্ছিন্নতা বা অসন্তোষ সৃষ্টির লক্ষ্যে জাতি বা শ্রেণিবিদ্বেষ প্রচার এবং কোনো ধর্মের প্রতি বিদ্রূপ, অবমাননা বা আক্রমণ, বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়, বর্ণ বা মতাবলম্বীদের মধ্যে বিদ্বেষ বা বিভেদ সৃষ্টি করে এমন তথ্য প্রচার করা যাবে না।
বিজ্ঞাপনে বিধিনিষেধ: অনলাইন গণমাধ্যমে প্রচারিত, প্রকাশিত বা সম্প্রচারিত বিজ্ঞাপনের ভাষা, দৃশ্য কিংবা নির্দেশনা কোনো ধর্মীয় বা রাজনৈতিক অনুভূতির প্রতি পীড়াদায়ক হতে পারবে না। ধর্মীয় অনুভূতিকে ব্যবহারের মাধ্যমে পণ্যের বাণিজ্যক উদ্দেশ্য হাসিলের লক্ষ্যে মসজিদ, মন্দির, গির্জা ইত্যাদি স্থানের ধর্মীয় স্থিরচিত্র কিংবা চলমান চিত্র উপস্থাপন করা যাবে না।
অনলাইন গণমাধ্যমে বন্ধু রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে মতবিরোধ সৃষ্টি করতে পারে এমন বিজ্ঞাপন প্রচার করা যাবে না। বিভিন্ন ধর্ম বা মতাবলম্বীদের মধ্যে বিদ্বেষ বা বিভেদ সৃষ্টি করতে পারে এমন বিজ্ঞাপন প্রচার করা যাবে না।
সম্প্রচার নীতিমালার মতো অনলাইন গণমাধ্যমেও প্রচারিত বিজ্ঞাপনে পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণ সনদপত্র উপস্থাপন করতে হবে। এ ছাড়া বিজ্ঞাপনে রাষ্ট্রীয়ভাবে সংরক্ষিত গুরুত্বপূর্ণ ভবন, স্থাপনা, কার্যালয় যেমন জাতীয় সংসদ ভবন, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, আদালত ও আদালতের কার্যক্রম, সেনাবাহিনী এলাকা, শহীদ মিনার, জাতীয় স্মৃতিসৌধ প্রদর্শন করা যাবে না।
অনলাইন কমিশন: খসড় নীতিমালা অনুযায়ী একটি অনলাইন গণমাধ্যম কমিশন গঠন করা হবে। এই কমিশন হবে একটি সংবিধিবদ্ধ সংস্থা। একজন চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে প্রয়োজনীয়সংখ্যক সদস্য নিয়ে এই কমিশন গঠন করা হবে।
সম্প্রচার কমিশনের মতো এখানেও অনুসন্ধান কমিটির মাধ্যমে চেয়ারম্যান সদস্যদের নির্বাচন করার কথা বলা হয়েছে। অনলাইন গণমাধ্যম কমিশনের জারি করা নিয়মাবলি যথাযথভাবে প্রতিপালিত হচ্ছে কি না, তা তদারকি করবে।
কমিশনের কাছে কোনো অনলাইন প্রতিষ্ঠানের সংবাদ প্রচারে নীতিমালার পরিপন্থী মনে হলে ওই প্রতিষ্ঠানকে কারণ দর্শানোর নির্দেশ দিতে পারবে এবং এ-সংক্রান্ত প্রতিবেদন সরকারে কাছে পেশ করবে। এই কমিশন নীতিমালা পরিপন্থী বিষয়ের জন্য ওই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সরকারের কাছে সুপারিশ করবে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে সরকার আইন বা বিধি দ্বারা নির্ধারিত শাস্তির বিধান করবে।
উল্লেখ্য, ৪ আগস্ট মন্ত্রিসভার সভায় জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা অনুমোদন করে এবং ৭ আগস্ট এ নীতিমালার গেজেট প্রকাশ করা হয়। এরপর থেকে সাংবাদিকরা এ নীতিমালা বাতিলের দাবিতে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছে।
বিএনপি ‘কালা কানুন’ আখ্যায়িত করে সম্প্রচার নীতিমালা বাতিলে সরকারের প্রতি দাবি জানিয়েছে।