পদ্মায় লঞ্চ ডুবি : দেড়শ যাত্রীর সলিল সমাধি

Lanch-Sink_Munshigonjসুরমা টাইমস ডেস্কঃ পদ্মায় লঞ্চডুবির প্রায় ৩০ ঘণ্টা অতিবাহিত হলেও উদ্ধার কাজে এখনো উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি নেই বলে অভিযোগ ডুবে যাওয়া লঞ্চের স্বজনদের। উদ্ধার তো দূরের কথা, সর্বোচ্চ চেষ্টা এবং আধুনিক সব সরঞ্জাম ব্যবহার করেও নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না লঞ্চের অবস্থান। এদিকে, চাঁদপুরের হাইমচরে এক নারীসহ ২ জনের লাশ পাওয়া গেছে। প্রাথমিকভাবে লাশ দু’টিকে পদ্মায় লঞ্চডুবির ঘটনায় নিহতদের লাশ বলে ধারণা করা হলেও এ বিষয়ে নিশ্চিত নন কর্তৃপ। মাওয়া নৌ পুলিশ ফাঁড়ির উপ পরিদর্শক খন্দকার খালিদ হোসেন বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। মুন্সীগঞ্জ জেলা প্রশাসনের তথ্য কেন্দ্রে মঙ্গলবার দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত ১২৯ জন নিখোঁজের তালিকা জমা পড়েছে।
পিনাক-৬ এর অবস্তান এখনো সনাক্ত করতে পারেনি নৌবাহিনী এবং ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরিরা। আশংকা করা হচ্ছে নিখোজ দেড় শতাধিক যাত্রীর আর কেউই বেচেঁ নেই। বৈরি আবহাওয়ার কারণে লঞ্চটি উদ্ধার না হওয়ায় এসব যাত্রীর সলিল সমাধির আশংকা প্রকাশ করেছেন বিশিষ্ট জনেরা। আধুনিক উদ্ধারকারি জাহাজ জরিপ- ১০ বিশেষ ভেসেল রাতে পৌছালেও উদ্ধার তৎপরতা নিয়ে তেমন অগ্রগতি নেই। এদিকে গত দিনের চেয়ে মঙ্গলবার উদ্ধার তৎপরতা বাড়ানো হয়েছে। কাজ করছে বিআইডব্লিউটির ডুবুরিদলসহ ফায়ার সার্ভিস, র‌্যাব, পুলিশ ও সেনাবাহিনী।প্রথম দিনের চেয়ে দ্বিগুণ সেনাবাহিনী যুক্ত হয়েছে দ্বিতীয় দিনের উদ্ধার ?অভিযানে। যোগ দিয়েছে নৌবাহিনীর বিশেষ প্রযুক্তিসম্পন্ন জাহাজ। যারা সাইট স্ক্যানার সোনার ও হাইড্রোগ্রাফিক সার্ভের মাধ্যমে লঞ্চ সনাক্ত করার কাজ করছে।
চট্টগ্রাম থেকে রওনা হয়েছে জরিপ-১১ নামে অত্যাধুনিক জাহাজ। যা মাটির নিচে থাকা জলযান শনাক্ত করতে পারে। জাহাজটি মাওয়া এসে পৌঁছবে মধ্যরাতে।আপ্রাণ চেষ্টা চালানো হলেও তীব্র স্রোতের কারণে ?বার বার লঞ্চটি অবস্থান পরিবর্তন করছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।একজন নৌ বিশেষজ্ঞ জানান, স্রোতের টানে পিনাক-৬’র চেয়েও বড় ধরনের লঞ্চ কিংবা জাহাজ সরে যেতে পারে। এ প্রসঙ্গে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের ডেপুটি ডিরেক্টর (ডিডি) ভরত চন্দ্র বিশ্বাস জানান, আমাদের ১৪ জন ডুবুরিসহ মোট ৫৯ জন নোঙ্গর ফেলে লঞ্চ খোঁজার কাজ করছে। তবে এখনও কোনো ফলাফল পাওয়া যায়নি। পানির স্রোতে লঞ্চটি ভেসে যেতে পারে। বিআইডব্লিউটিএ এর চেয়ারম্যান শামসুদ্দোহা খন্দকার বলেন, মাঝ নদীতে প্রচন্ড স্রোতের
কারণে লঞ্চটি ভাটির (চাঁদপুর, শরিয়তপুর) দিকে ভেসে যেতে পারে। এ পর্যন্ত নদীর ২০ বর্গকিলোমিটার জায়গা অনুসন্ধান করা হয়েছে তবে এখনো লঞ্চটি পাওয়া যায়নি।
ঘটনাস্থলে উপস্থিত সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন নজরুল ইসলাম বলেন, গত রাতে বিআইডব্লিউটিএ এর সোনার দিয়ে লঞ্চ শনাক্ত না করতে পাড়ায় আমাদের ডিভাইস দিয়ে কাজ করছি। এ পর্যন্ত উজানে ২ কিলোমিটার এবং ভাটিতে ৫ কিলোমিটার অনুসন্ধান এবং প্রত্যদর্শীদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী ১০টি স্পটে অনুসন্ধান করে লঞ্চটি পাওয়া যায়নি। সোমবার বেলা ১১টায় মাওয়া ঘাটের একশ’ গজ দূরে পদ্মায় তলিয়ে যায় পিনাক-৬ লঞ্চটি। সাঁতরে তীরে উঠে আসেন ৪০-৪৫ জন যাত্রী। ?
দের মধ্যে হাসি ও হীরা নামে ২ জনের মৃতদেহ পাওয়া গেছে। তাদের লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। হীরা নৌপরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খানের খালাতো বোনের মেয়ে। স্থানীয়রা জানান, নিখোঁজ যাত্রীদের স্বজনদের আহাজারিতে সোমবার দুপুরের পর থেকেই ভারী হয়ে ওঠে পদ্মা তীরের
পরিবেশ। সারারাত অপোর পরও উদ্ধারকাজে কোনো অগ্রগতি না দেখে তারা প্তি হয়ে ওঠেন এবং মাওয়া ঘাটে ঢোকার রাস্তায় ভ্যান উল্টে ফেলে অবরোধ করেন। এ সময় শতাধিক বিুব্ধ স্বজনসহ স্থানীয়রা মাওয়া ঘাটের মুখে পদ্মা রেস্ট হাউসের সামনে দাঁড়িয়ে শ্লোগান দেয় এবং আইডব্লিউটি’র নৌযান ল্য করে ঢিল ছোড়েন।ফলে কয়েক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে যানজটের সৃষ্টি হয়।এ সময় আটকে পড়ে তিনশ’ থেকে চারশ গাড়িসহ ছোট-বড় যানবাহন। মাওয়া ফাঁড়ি ইনচার্জ খন্দকার খালিদ জানান, সকালে উদ্ধারকাজ নিয়ে স্বজনদের মধ্যে চরম অসন্তোষ দেখা গেছে। তারা সকাল সাড়ে ৭টা থেকে সাড়ে ৮টা পর্যন্ত মাওয়ায় বিক্ষোভ করে। এরপর জেলা প্রশাসকসহ সব কর্মকর্তারা এসে বিুব্ধ স্বজনদের বুঝিয়ে সরিয়ে নেন। তিনি আরো জানান,স্রোত ও বাতাসের কারণে উদ্ধার কাজ ব্যাহত হচ্ছে। তবে কিছুণ আগে উদ্ধারকারী জাহাজ রুস্তম ও ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধার বোর্ট ‘অগ্নি শাসক’ এর সঙ্গে উদ্ধারকারী জাহাজ নির্ভীক যুক্ত হয়েছে। সোমবার বেলা ১১টায় মাওয়া ঘাটের একশ’ গজ দূরে পদ্মায় প্রায় আড়াইশ যাত্রী নিয়ে তলিয়ে যায় পিনাক-৬ লঞ্চটি।
সাঁতরে তীরে উঠে আসেন ৪০-৪৫ জন যাত্রী। অন্যদের খোঁজ মেলেনি এখনো। মুন্সিগঞ্জের মাওয়ায় লঞ্চ দুর্ঘটনার পর থেকে চাঁদপুরের মেঘনা নদীতে লাশের খোঁজে নৌ-টহল পরিচালিত হচ্ছে।
বিআইডব্লিউটিএ চাঁদপুরের উপ-পরিচালক মোবারক হোসেন বিষয়টি নিশ্চিত করে জানান, নিমজ্জিত লঞ্চ পিনাক-৬ উদ্ধার না হওয়া পর্যন্ত টহল চলবে। নদীর স্রোতে কোনো লাশ ভেসে চাঁদপুরের সীমানায় আসছে কি না -এ বিষয়টি নজর রাখছে টহল দল। চাঁদপুর পুলিশ প্রশাসন, কোস্টগার্ড ও বন্দর কর্তৃপ পৃথকভাবে টহল পরিচালনা করছে। বিশেষ করে মতলব উত্তরের ষাটনল থেকে হাইমচরের শেষ সীমানা পর্যন্ত চলছে অভিযান।আপু আমার হাত ছেড়ে দিও না। আমাকে
ছেড়ে দিলে মরে যাব। লঞ্চ পিনাক-৬ ডোবার আগে বড় বোন হালানীকে জড়িয়ে ধরে এভাবে কথাগুলো বলছিলেন ছোট বোন দীপা। বড় বোন হালানী, ভাই রুবেল, ভাগ্নী সাদিয়া, রত্না, সামিরা সবাই মিলে মাঝির হাট থেকে রওয়ানা দিয়েছিলেন গাজীপুরের উদ্দেশ্যে। পথে মাওয়া-কাওড়াকান্দি লঞ্চ ডুবিতে হারিয়ে যান বোন হালানী ও ভাগ্নী সাদিয়া। দীপা কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ঘটনার সময় আমার বড় বোন হালানী সবাইকে জড়িয়ে ধরে শুধু আল্লাহর নাম নিচ্ছিলেন। লঞ্চটি ডুবে যাওয়ার পর সবাই উদ্ধার হলেও, আমার বোন হালানী ও তার মেয়ে সাদিয়াকে (৭) খুঁজে পাচ্ছি না।
নিখোঁজ বোন ও ভাগ্নীর নাম নেওয়ার পর অজ্ঞান হয়ে যান দীপা। ভাগ্যক্রমে নিজে বাঁচলেও, বাঁচাতে পারলেন না মায়ের মতো বড় বোন হালানী ও তার ছোট মেয়ে সাদিয়াকে।মাদারীপুর জেলার শিবচরের মানিকপুর এলাকায় বাড়ি হালানীর। কখনও ঢাকায় আসেন নি। ছোট ভাই রুবেল দীর্ঘদিন ধরে গাজীপুরে থাকেন। বেড়ানোর উদ্দেশ্যে ছোট ভাইয়ের সঙ্গে তিন মেয়ে রত্না, সামিরা, সাদিয়া ও ছোট বোন দীপাকে নিয়ে ঢাকা আসছিলেন। লঞ্চডুবিতে ছোট মেয়ে সাদিয়াসহ নিখোঁজ হয়েছেন তিনি। দীপার মতো অনেকেই হারানো স্বজনের জন্য মাওয়া ঘাটে পদ্মানদীর পাড়ে ২৪ ঘণ্টা পরও অপো করছেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত দুর্ঘটনাকবলিত লঞ্চ পিনাক-৬ শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। কাওড়াকান্দি থেকে মাওয়া আসার পথে লঞ্চ পিনাক-৬ আরেকটি ঘাট থেকে বাড়তি শতাধিক যাত্রী তুলেছিল জানিয়ে নৌ পরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান বলেছেন, এ ঘটনায় নিয়ম মাফিক
মামলা করা হবে। মঙ্গলবার মাওয়ায় পদ্মা নদীতে লঞ্চডুবির ঘটনাস্থল ঘুরে দেখে মন্ত্রী সাংবাদিকদের এ কথা বলেন। গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত নদী থেকে কেবল দুইজনের লাশ পাওয়া গেছে। স্বজনদের অভিযোগের ভিত্তিতে জেলা প্রশাসন ১২৭ নিখোঁজ যাত্রীর একটি তালিকা করেছে। নৌমন্ত্রী জানান, ওই লঞ্চে তার খালাত বোনের তিন মেয়েও ছিল।লঞ্চডুবির ঘটনায় কোনো কোনো পরিবারের ১০ জন পর্যন্ত লোক নিখোঁজ হয়েছে। এমনকি আমার খালাতো বোনের তিন মেয়েও লঞ্চে ছিল। তাদের নাম স্বর্ণা, হীরা ও লাকি। এই তিনজনের মধ্যে নূসরাত জাহান হীরা (২০) শিকদার মেডিকেল কলেজের
এমবিবিএসের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী ছিলেন। আর ফাতেমাতুজ জোহরা স্বর্ণা (১৮) চলতি বছর শিবচরের শেখ ফজিলাতুন্নেছা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাশ করে ঢাকার বীর শ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ পাবলিক কলেজে ভর্তি হন। মুন্সীগঞ্জের লৌহজংয়ে পদ্মায় ডুবে যাওয়া লঞ্চ পিনাক-৬ এ ধারণ মতার অতিরিক্ত ২০০ যাত্রী ছিল বলে স্থানীয়দের উদ্ধৃত করে জানিয়েছেন এক পুলিশ কর্মকর্তা। ঈদফেরত যাত্রীদের চাপের মধ্যে মাদারীপুরের কাওড়াকান্দি ঘাট থেকে মুন্সীগঞ্জের মাওয়া আসার পথে সোমবার বেলা ১১টার দিকে ডুবে যায় লঞ্চটি।ঈদ হয়ে যাওয়ার পর এখন কাওড়াকান্দি থেকে মাওয়া তথা ঢাকার দিকে যাত্রীর চাপ বেশি। অনেকে লঞ্চে নদী পেরিয়ে মাওয়ায় এসে বাস ধরেন। অনেক বাসও যাত্রীদের লঞ্চের মাধ্যমে পার করিয়ে আনে।